ইকতেদার আহমেদ: নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সাংবিধানিকভাবে এটিকে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য আইনের অধীন নির্বাচন কমিশনকে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন উপরোক্ত দায়িত্বগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং ওই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের যেরূপ সহায়তার প্রয়োজন নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষ হতে সেরূপ সহায়তা পাওয়ার জন্য অধিকার প্রাপ্ত। যেকোনো নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান ও বিভিন্ন আইনের অধীন যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত। নির্বাচন কমিশনাররা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ৫ বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত; তবে একজন নির্বাচন কমিশনার তার মেয়াদান্তে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ লাভের জন্য যোগ্য। আমাদের দেশে অতীতে দলীয় সরকারের অধীন যারা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের প্রায় সকলেই দলীয় সরকারের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কাজ করে তাদের কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করে তাদের প্রতি যে অনুগ্রহ দেখানো হয়েছে তার প্রতিদান প্রদানে সচেষ্ট ছিলেন। দলীয় সরকারের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য যেকোনো নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে প্রতিদান প্রদানের ক্ষেত্রে অধিক সচেষ্ট তার প্রমাণ তারা একাধিকবার রাখতে সমর্থ হয়েছেন। দশম সংসদ নির্বাচনসহ তদপরবর্তী বর্তমান কমিশন যে সকল উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা করেছেন এর প্রত্যেকটি অস্বচ্ছ, ক্রটিপূর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট ও কালিমাযুক্ত ছিল।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনায় ব্যর্থ বিধায় ইতোমধ্যে এ কমিশনকে দেশের বিরোধী দলসমূহের পক্ষ হতে মেরুদ-হীন ও আজ্ঞাবহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা যে মেরুদ-হীন ও আজ্ঞাবহের পাশাপাশি দৃষ্টিহীন ও নির্বোধ তা সদ্য সমাপ্ত দুই ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণান্তে দেশের সচেতন জনমানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে।
যেকোনো নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গণ্য করতে হলে যে সকল বিষয় প্রাসঙ্গিক তা হলোÑ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে ইচ্ছুক প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিলের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা, নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা, ভোটারদের ভোটদানের ব্যাপারে কোনো ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে কিনা; ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে কিনা, প্রভাবশালী প্রার্থী কর্তৃক ভোট কেন্দ্রে দখলপূর্বক অবাধে ব্যালটে সিল মারা হয়েছে কিনা, নির্বাচনি কাজে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বশীভূত করে জাল ভোট প্রদানের ক্ষেত্র প্র¯‘ত করা হয়েছে কিনা প্রভৃতি।
ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায় সম্প্রতি দুই ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হয়ে নির্বাচন পূর্বসময়ে বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকায় যে গোলযোগ করেছেন তাতে প্রায় ৫০ জন নিহত এবং হাজারের ঊর্ধ্বে আহত হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ হতে ইউনিয়ন পরিষদের এ দুটি ধাপে ভোট প্রদানের যে হার দেখানো হয়েছে তা ৮০ ভাগের কাছাকাছি। সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদের দুটি ধাপের নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার কারণে এর অস্বচ্ছতা ও কলুষতা এবং ক্ষমতাসীনদের শক্তি প্রয়োগের মাত্রা এতো ব্যাপকতর ছিল যে তা এ দেশের সচেতন জনমানুষকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে। উপরোক্ত অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, কলুষতা এবং শক্তি প্রয়োগের বিষয় নির্বাচন কমিশন পূর্বাপর অবহিত। কিন্তু সংক্ষুব্ধ প্রার্থী ও দল তাদের নিকট একাধিকবার যাওয়ার পরও তারা তাদের ওপর অতীতে আরোপিত বিশেষণ মেরুদ-হীন ও আজ্ঞাবহের যথার্থতায় এ সকল কোনো কিছুকে আমলে না নিয়ে যে আচরণ করেছেন তা দৃষ্টিহীনতা ও নির্বোধতার পরিচায়ক।
যেকোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যয় জনগণের প্রদত্ত করের টাকায় রাষ্ট্রের পক্ষে নির্বাচন কমিশন নির্বাহ করে থাকে। এ ব্যয় বিষয়ে জনগণ তখনই স্বার্থকতা পায় যখন নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলনে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বীয় সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সক্ষম। আর এর যেকোনো ধরনের ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে দেশের সচেতন জনমানুষের উপলব্ধি নির্বাচন কমিশন যেন এভাবে জনগণের করের টাকা অপব্যয় না করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবর্তে তাদের কার্যালয় হতে যাদের কার্যসিদ্ধির জন্য তারা নিয়োগপ্রাপ্ত তাদের আকাক্সক্ষানুযায়ী নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করে দৃষ্টিহীন ও নির্বোধের যথার্থতার প্রমাণ রাখেন।
লেখক : সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ৮ এপ্রিল ২০১৬: