Sat. Mar 15th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

sirajul islam chowdhuryসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শ্রেণি বিভাজনও ছিল অমোঘ ও নিয়ামক সত্য। যাদের সহায় সম্বল ছিল ওপারে যাবার মতো, তারা দ্র“ত চলে গেছেন; অন্যরা গেছেন ধীরে ধীরে; কেউ কেউ আবার যেতে পারেনওনি। ওই যে অশ্বত্থ গাছের কথা বলেছেন লেখক, ১৯৯৭ সালে সেই গাছের ছায়াতেই তার দেখা হয়েছিল বাল্যকালের পরিচিত চৌকিদার বিশু হালদারের সঙ্গে। চৌকিদার বিশু হালদাররা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেননি, কোথায় যাবেন, পশ্চিমবঙ্গে তার কে আছে, কোথায় আছে?
রাজশাহীতে আমার নিজের সহপাঠী বন্ধুদের ভেতর ছিল রূপেন এবং রামকৃষ্ণ। রূপেনের সঙ্গে ক্লাস ফোর থেকে পড়েছি, লোকনাথ হাই স্কুলে, পাশাপাশি বসতাম শেষের দিকে এসে। শেষ মানে আমাদের রাজশাহী ছাড়া, ১৯৪৬-এ। রূপেন্দ্ররা রায়চৌধুরী, পুরোনাম রূপেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী। ওদের বাড়ি ছিল শহরের এক কোণে, মস্ত এলাকা নিয়ে, অনেক সেখানে গাছপালা, আমবাগানের কথাও মনে পড়ে, যে বাগান প্রসারিত ছিল রেললাইনের প্রান্ত পর্যন্ত, ওই রেললাইন ধরে রূপেনের সঙ্গে অনেক হাঁটাহাঁটি করেছি, বিকেলে, ওদের ওদিকে গেলে। রূপেনদের নিজস্ব ঘোড়ার গাড়ি ছিল; সেকালে সেটা সামান্য ব্যাপার নয়, একালে সর্বাধুনিক মোটরগাড়ি থাকার সমতুল্য; ওই গাড়িতে করে রূপেন কখনো স্কুলে আসেনি, তবে ওর বড় ভাই ও বোন গাড়িতে চেপে কলেজে যাচ্ছে এমনটা দেখেছি। রুপেনদের কেবল জমিদারি নয়, ইটখোলাও ছিল বলে জানতাম। ওরা বদলাচ্ছিল, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে। কিন্তু কোন বদল যে অপেক্ষা করছিল সেটা জানতো না।
রামকৃষ্ণদের পদবি কী ছিল? ঠিক মনে নেই। তবে তাকে আমি এখনো দেখতে পাই প্রায়-প্রতিবেশী হিসেবে। বোধ করি ওদের মুদির দোকান ছিল একটা। পড়াশোনায় খুব সুবিধা করতে পারতো না। ক্লাসটিচার একবার বলেছিলেন, ‘বাবা-মা তো বড় সখ করে তোমার নাম রেখেছিলেন পরমহংসের কাছাকাছি হবে এমন আশা নিয়ে, কিন্তু তোমার তো দেখি পাতিহাঁস হওয়াও কঠিন হবে।’ সারা ক্লাস হো হো করে হেসে উঠেছিল, হয়তো আমার কণ্ঠও যোগ হয়েছিল তাতে, কিন্তু পরে যতবার স্মরণ করেছি বড়ই নিষ্ঠুর ঠেকেছে ওই কৌতুককে। সেদিন রামকৃষ্ণের চেহারাটা কেমন দাঁড়িয়েছিল আমি কল্পনা করতে পারি না, ভয় লাগে।
দেশভাগের পর রূপেন ও রামকৃষ্ণ নিশ্চয়ই ওরা দুজনেই চলে গেছে। সেই কিশোর বয়সে রাজশাহী ছাড়ার পর ১৯৭২ সালে আমার আবার সেখানে যাওয়া হয়েছিল। রূপেনদের খোঁজ পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, নিশ্চয়ই ওরা জš§ভূমি ছেড়েছে একেবারে প্রথম স্রোতে, ওদের বাড়ি যেখানে ছিল সেখানে শুনলাম একটি উপশহর গড়ে উঠেছে। রূপেনদের বাড়িটা সম্ভবত পড়েছে মেডিকেল কলেজের এলাকার ভেতরে। ১৯৪৬ সালে রাজশাহীতে মেডিকেল হাসপাতাল ছিল, মেডিকেল কলেজ ছিল না। আর রামকৃষ্ণদের বাড়ি? সেটা তাদের নিজেদের ছিল, নাকি ওরা ভাড়া থাকতো জানতাম না। মনে হয় ভাড়াই থাকতো। ওই বাড়ি খুঁজতে চেষ্টা করিনি, জানতাম খুঁজে কোনো লাভ হতো না, রামকৃষ্ণরাও নিশ্চয়ই ‘৪৭-এ না হোক ‘৫০ সালে চলে গেছে। কিন্তু যে প্রশ্নটা আমার মনে আগে উঠেছে, এখনো ওঠে, সেটা হলো রূপেন ও রামকৃষ্ণ দুই বন্ধু আমার, দু’জনেই তো পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছে চলে, কিন্তু সেখানে তাদের দু’জনের ভেতর আর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে কি কখনো? কোথাও? হয়তো হয়েছে, কিন্তু হলে নিশ্চয়ই তা চকিতেই ঘটেছে, এবং পরস্পরের ভেতর কথা যদি কোনো হয়ে থাকে তবে তাতে অন্যকিছু ধরা পড়েনি এটুকু ছাড়া যে তারা একে অপর থেকে ইতিমধ্যে অনেক দূরে সরে গিয়েছে, দু’জনেই হয়তো বিষণœচিত্তে অনুভব করেছে যে দেখা না হলেই ভালো ছিল। স¤প্রদায় জিনিসটা ঠিকই মর্মান্তরিকরূপে সত্য হয়ে উঠেছিল দেশভাগের মুহূর্তে, কিন্তু তার চেয়েও বড় বাস্তবতা ছিল শ্রেণির, সাময়িকভাবে যা কিছুটা প্রচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল বটে, কিন্তু মোটেই মিথ্যা হয়ে যায়নি।
আমার রাজশাহীর সহপাঠী আরেক বন্ধু হাসিলউদ্দিন শেখ, ডাক নাম মাখন। সে ছিল হƒষ্টপুষ্ট, হাসিখুশি। আমরা এক সঙ্গে স্কুলে যেতাম, ফিরতামও একই সঙ্গে। হাসিলউদ্দিনদের বাড়িটা নিজেদের, তবে সেটা পাকা দালান ছিল না। বাড়ির সামনে ছিল মুদির দোকান, যেটাতে ওর বাবা বসতেন। মাখনদের যৌথ পরিবারে ওর ছোট চাচি ছিলেন নাকি আমাদের বিক্রমপুরেরই মেয়ে, যে খবর ওর মুখেই শুনেছি। মাখনকেও তো রাজশাহীতে রেখে এসেছিলাম, সেখানেই তার থাকার কথা। বাহাত্তরে গিয়ে ওদের বাড়ি খুঁজে পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু ওকে পাওয়া যায়নি, সে নাকি বাড়ি করেছে অন্যত্র। কিন্তু আমার আরেক বন্ধু মোতাহার, সে আছে, সে নাম করেছে পশু চিকিৎসক হিসেবে। তার সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার, দেখাও হয়, কথা হয় টেলিফোনে, আলাপের মধ্যেই নানা দার্শনিক প্রসঙ্গও এসে যায়। ওর আব্বা আমার আব্বার বন্ধু ছিলেন, দু’জনেই সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুবাদে ওরা নানা শহরে ঘুরেছে এবং পরে ঢাকায় নিজের কর্মজীবন শুরু করেছে। মোতাহারও সহপাঠী মাখনকে খুঁজেছে। এই তো সেদিন মোতাহার বললো, রাজশাহীতে বেড়াতে গিয়ে মাখনকে সে খুব করে খুঁজেছে, তাকে না পেয়ে ওর এক আত্মীয়ের কাছে নিজের টেলিফোন নম্বর দিয়ে এসেছে। বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছে যেন মোতাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু মাখন ওকে টেলিফোন করেনি। হয়তো ভেবেছে আলাপ করবার বিষয়ের অভাব ঘটবে, যা কি না ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে। কিন্তু একটা খবর দিতে পারল মোতাহার। রূপেনদের পুরনো বাড়িটার একাংশ নাকি মাখনরা কিনতে চেয়েছিল। এমনটা সাতচল্লিশের আগে ভাবা যেতো না, সাতচল্লিশের পরে অনেক কিছুই সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে জমি কেনা, জমিতে বাড়ি তোলা।
স্বল্প সময়ের জন্য একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, নাম বোধ করি উজ্জ্বল। উজ্জ্বলই হবার কথা, চঞ্চল নয়, কেননা সে ছেলে মোটেই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল না। ছোটখাটো গড়নের। স্কুলে এসেছে বাবার চাকরির সূত্র ধরে। ওর বাবা এসেছিলেন বদলি হয়ে। তিনি ডিস্ট্রিক্ট জজ ছিলেন বলে শুনেছি। সেকালের অবস্থা একালের মতো ছিল না, এক বন্ধু বলছিলেন সেদিন; সেকালে জজ সাহেবের ছেলে ভাগনে ভাতিজা এসবকে জানা যেত, কিন্তু জজ সাহেবটি কে তা কেউ জানতো না, তিনি দেখা দিতেন না, সামাজিক অনুষ্ঠান সজ্ঞানে পরিহার করে চলতেন। উজ্জ্বলদের বাসাটা ছিল রামকৃষ্ণদের বাসার লাইনে, কিন্তু ছিল একেবারেই আলাদা, ছোট ছিমছাম দোতলা বাড়ি। বাংলা ছোটগল্পে তখন মাধবীলতার উল্লেখ পাওয়া যেতো, সেই মাধবীলতাকে ওদের বাড়ি পেঁচিয়ে উঠতে দেখেছি বলে মনে পড়ে। উজ্জ্বলরাও নিশ্চয়ই রাজশাহীতে থাকেনি, দেশভাগের সময় ওর বাবা নিশ্চয়ই অপশন দিয়েছিলেন ভারতের পক্ষে এবং ওরা অবশ্যই চলে গেছে রাজশাহী ছেড়ে। ওর সঙ্গে যে দেখা হবে এমন সম্ভাবনা আর থাকেনি, দেখা হয়ওনি।
তবে রশীদুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রশীদ আমার সহপাঠী ছিল কলকাতার স্কুলে। পরে যখন কলেজে ভর্তি হয়েছি দেখি সেও এসে উপস্থিত ফরিদপুর থেকে ম্যাট্রিক পাস করে। বলাই বাহুল্য, দেখা হলো সা¤প্রদায়িক আত্মীয়তার কারণে নয়, শ্রেণিগত নৈকট্যের দরুনই। উজ্জ্বলের বাবার মতো রশীদের আব্বাও ছিলেন জেলা জজ, পরে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের জজ হয়েছিলেন। রশীদ আমার সহপাঠী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও, আমরা একই সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি। তবে রশীদ অনার্স পাস করেই চলে গেছে লন্ডনে, সেখান থেকে ব্যারিস্টার হয়ে এসেছিল। ওর কর্মজীবনের বেশির ভাগই কেটেছে চট্টগ্রামে। এখন সে আর নেই, চলে গেছে হঠাৎ করেই, মৃত্যুর আগে যখন চিকিৎসারত ছিল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তখন একদিন আমার হাত ধরে একান্তে তার জীবনের সেই অংশের কথা বলেছিল আমাকে, যেটির কথা আমি জানতাম না, অনুমানও করিনি। তাকে তো অসফল মানুষ বলবার কোনো উপায় ছিল না, কিন্তু গভীর দুঃখও ছিল ভেতরে, যেটি বহন করতে গিয়ে সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
ওই যে টলস্টয় লিখে গেছেন তার ‘আন্না কারেনিনা’ উপন্যাসের একেবারে প্রথম বাক্যটিতে, যেটি ক্লাস রুমে আমাকে বহুবার উল্লেখ করতে হয়েছে পাঠদান করতে গিয়ে, সেটি যে কেমন বাস্তবিক সত্য হতে পারে, রশীদের শয্যাপাশ বসে সেদিন তা আমার কাছে বড়ই প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল। টলস্টয়ের বাক্যটি হলো, সব সুখী পরিবারই এক রকমের হয়, কিন্তু প্রতিটি সুখী পরিবারই নিজের মতো করে অসুখী। রশীদ যে আমাকে অতটা আপন জানতো আগে তা জানবার সুযোগ পাইনি, জানলাম তার অকাল প্রয়াণের কয়েকদিন পূর্বে। তার সুখ-দুঃখের কথাগুলো নিঃসঙ্কোচে বলতে পারে সহানুভূতিপ্রবণ এমন শ্রোতাও হয়তো সে পায়নি। মানুষের জীবনে সেটাও মস্ত এক সমস্যা বটে, নিতান্তই করুণ- অনেক মানুষ অবশ্যই পাওয়া যায়, ভিড় করে থাকে চতুর্দিকে, কিন্তু সহানুভূতির সঙ্গে ব্যক্তিগত দুঃখের কথা শুনবে এ রকমের মানুষ খুঁজতে গেলে হয়রান হতে হয়।

খোলা বাজার২৪, সোমবার, ১৮ এপ্রিল ২০১৬