Sat. Mar 15th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

5kফরিদুর রহমান ।। খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ মে ২০১৬:  আবু ইসহাকের উপন্যাস পড়া না থাকলেও চলচ্চিত্রের দর্শকদের হয়তো ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ ছবির একটি দৃশ্যের কথা মনে আছে। জয়গুন ও শফির মা শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসে নানা ভয়ভীতি ও আশঙ্কার কারণে তাদের ছেড়ে যাওয়া ভিটায় বসবাসের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। সেই সময় একদিন নামকরা ফকির জোবেদ আলী এসে এই সংকট থেকে তাদের উদ্ধার করেন। সূর্য দীঘল বাড়ীর চার কোনায় চারটি তাবিজ পুঁতে দিয়ে জোবেদ আলী জানিয়ে দেন, ‘এইবার চউখ বুঁইজা ওড গিয়া বাড়িতে। আর কোনো ডর নাই। ধুলাপড়া দিয়া ভূত-পেতœীর আড্ডা ভাইঙা দিছি। চাইর কোনায় চাইড্যা আলিশান পাহারাদার রাইখা আইছি। সব বিপদ-আপদ ওরাই ঠেকাইব। বাড়ির সীমার মইদ্যে ভূত-পেতœী, জিন-পরি, ব্যারাম-আজার কিচ্ছু আইতে পারব না।’

সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক মহোদয়ের কথায় প্রায় ভুলে যাওয়া এই দৃশ্যটির কথা নতুন করে মনে পড়ল। নিয়মিত হত্যা-ধর্ষণ, খুনখারাবি, ছিনতাই-রাহাজানি ঠেকাতে না পেরে ও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও হত্যাকারী, ধর্ষক বা ছিনতাইকারী পাকড়াও করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে তিনি জনগণকে ‘নিজস্ব নিরাপত্তাবলয়’ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। আমি তাঁর কথায় মোটেও বিস্মিত হইনি, বরং এই পরামর্শ যথেষ্ট যৌক্তিক বলেই মনে করি। যখন এ দেশে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, যানবাহন ও নানা ধরনের ডিজিটাল ডিভাইসে সমৃদ্ধ পুলিশবাহিনী গড়ে ওঠেনি তখনো সাধারণ মানুষ তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গ্রামেগঞ্জে একসময় বাটি চালান দিয়ে চোর ধরা কিংবা বাড়ির চার কোনায় তাবিজ-কবচ পুঁতে বাড়ি বন্ধ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রচলন ছিল। কিছুদিন আগেও শহরে পাড়ায়-মহল্লায় ‘এলেম দ্বারা চোর ধরা হয়’ জাতীয় সাইনবোর্ড চোখে পড়েছে। এ ধরনের বায়বীয় ব্যবস্থায় চোর ধরা পড়েছে কি না অথবা বিপদের আশঙ্কায় থাকা মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে কি না জানা নেই, তবে এই প্রক্রিয়াগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ছিল, তা অনুমান করা যায়। কিন্তু বর্তমানে যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের প্রতি মানুষের আস্থা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশের জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।
এখন থেকে চার বছরেরও বেশি সময় আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিহত হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের পাকড়াও করা হবে। ঘটনার পরে এক এক করে দেড় হাজার দিনেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, হত্যাকারী গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, পুরো বিষয়টিই এখন মনে হয় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। এরপর একে একে লেখক-প্রকাশক-ব্লগার, দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার লোক, স্বঘোষিত নাস্তিকদের পাশাপাশি ধর্মবিশ্বাসী ইমাম-পুরোহিত-যাজক, সেতারবাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মফস্বল শহরের তরুণ নাট্যকর্মী ও নিরীহ সংগীত শিক্ষকসহ বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুসারে বছরের প্রথম সাড়ে তিন মাসেই খুন হয়েছে দেড় হাজার মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের তৎপরতা ও সাফল্য আশাব্যঞ্জক নয়। ফলে কোনো ঘটনার তদন্তেই দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্লিপ্ত-নিস্পৃহ পরিস্থিতিতে নিহত কোনো লেখক-প্রকাশক-অভিনেতা বা সংগীতশিল্পীর আপনজন যদি অভিযোগ করেন, ‘হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে পুলিশের সক্ষমতা ও আন্তরিকতা কোনোটাই নেই’—তাহলে তাঁর এই বক্তব্য শুধু স্বজন হারানো মানুষের মর্মবেদনা বা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। হয়তো সত্যিই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দ্রুত পলায়নপর খুনিদের পশ্চাদ্ধাবন, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার কিংবা ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশ্লেষণ ও ডিএনএ পরীক্ষার মতো যুগোপযোগী কর্মপদ্ধতির সঙ্গে এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি আমাদের পুলিশ। সক্ষমতার অভাব সত্যিই থেকে থাকলে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, দক্ষ লোকবল নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় ইনসেনটিভ প্রদানের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চয়ই সম্ভব। কিন্তু আন্তরিকতায় যদি ঘাটতি থাকে, তাহলে তা পূরণ হবে কী দিয়ে? এ ক্ষেত্রে অপরাধ দমনে অথবা অপরাধী নির্মূলে পুলিশ কেন আন্তরিক নয় অথবা তার আন্তরিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কোথায়—সেই কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে সবার আগে। আর তা করা সম্ভব না হলে পুলিশের মহাপরিদর্শকের পরামর্শ অনুসারে প্রত্যেককেই নিজ নিজ নিরাপত্তারব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।
গ্রামাঞ্চলে জোতদার-ভূস্বামীরা প্রয়োজনে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তুলতে পারেন। শহরে বিত্তশালী কেউ কেউ হয়তো বুলেটপ্রুফ গাড়ি বা নিরাপত্তারক্ষী সঙ্গে নিয়ে চলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে বন্দুক-পিস্তল, বডিগার্ড কিংবা গানম্যান সঙ্গে নিয়ে ঘোরা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে তন্ত্রমন্ত্র বা তাবিজ-কবচের বিকল্প কিছু ভাবা যায় কি?
আমাদের বন্ধু অকালপ্রয়াত কবি মোশতাক দাউদী আশির দশকের শুরুতে তাঁর কয়েকজন সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহরের যেখানে যত ‘এলেম দ্বারা চোর ধরা হয়’ ‘বিপদ হইতে মুক্তির জন্য ঝাড়ফুঁকের ব্যবস্থা আছে’ ও ‘গুণিন দ্বারা শরীর ও বাড়ি বন্ধ করা হয়’-এর মতো সাইনবোর্ড ছিল সেসব ধ্বংস করার অভিযানে নেমেছিলেন। এখন বেঁচে থাকলে তাঁকে বলা যেত, ‘বন্ধু, তোমার সিদ্ধান্তটি সময়োচিত ছিল না। ওঝা, গুণিন, ফকিরের মতো এলেমদার মানুষের প্রয়োজন আমাদের দেশে এখনো ফুরিয়ে যায়নি। অতএব সেসব পুরনো সাইনবোর্ড খুঁজে বের করে শহরের রাস্তায় নতুন করে ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
একটি নির্ভেজাল আড্ডায় নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় আমাদের এক স্নেহভাজন সমস্যার একটি সুদূরপ্রসারী ও সর্বব্যাপী সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর মতে, দেশের সব ওঝা-গুণিন-ফকিরের পক্ষে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করা সম্ভব নাও হতে পারে। তার চেয়ে সারা বাংলাদেশের চার কোনায় যদি চারটি বড় রকমের কার্যকর তাবিজ-কবচের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে হয়তো পুরো দেশই বিপন্মুক্ত করা সম্ভব। দেশে আইএসসহ ইসলামী জঙ্গিদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে কোনো আন্তর্জাতিক ওঝা যদি সেন্টমার্টিনস-মঙ্গলা-তেঁতুলিয়া ও জাফলংয়ে চারটি শক্তিশালী তাবিজ পুঁতে দেওয়ার জন্য খুঁটি গেড়ে বসে পড়ে, তাকে ঠেকানোর মতো যথেষ্ট সক্ষমতা ও আন্তরিকতা কি আমাদের আছে? আশঙ্কা অনাকাক্সিক্ষত হলেও সম্ভবত অমূলক নয়।