Mon. Aug 11th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

emaz-uddin-bdএমাজউদ্দীন আহমদ  ।। খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ১৭ মে ২০১৬: মুক্তিযুদ্ধের কথা যখন স্মরণ করি তখনই অনুধাবনে আসে যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এই জাতির চার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সমুদ্রসৈকতে বালুকারাশির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রতœভাণ্ডার সমুদ্রের বেলাভূমিতে, সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনী বাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালি দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে। সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ার শুরু কখন তা কেউ জানি না বটে, ইতিহাসবিদদের ধারণায় কিন্তু এই জনপদে মানুষের বসবাস শুরু হয় খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছরেরও আগে। ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এই জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সব সময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম অথবা মধ্য ভারতে প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে, যদিও এই জনপদ দীর্ঘদিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বপ্রথম এই জনপদ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় এবং এর শাসন-প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই মাটির সন্তানরা। এ কারণেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি মাইলফলক।

সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্রের উচ্চারণে যেমন ফ্রান্সের রাজনৈতিক আকাশে সূচনা হয়েছিল প্রলয়ংকরী ঝড়ের; সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অন্বেষণের স্বতঃস্ফূর্ত দাবি যেমন আমেরিকার ১৩টি কলোনিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে, বাংলাদেশের জনপদও তেমনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদন করে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সনদে তারই অনুরণন পরস্ফুৎট।
একাত্তরের ডিসেম্বরে প্রায় অসম্ভব কাজটি সম্ভব হয়েছে জনগণের সাহস, শৌর্য ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে। এ জন্য ডিসেম্বরকে আমরা বিজয়ের মাসরূপে চিহ্নিত করি। একাত্তরের মার্চে যার সূচনা, ডিসেম্বরেই তার চূড়ান্ত পরিণতি। তাই ডিসেম্বর এলেই আনন্দিত এক অনুভূতির সন্ধান পাই। ডিসেম্বরে পা দিয়েই অনুভূব করি পায়ের নিচে শক্ত মাটির স্পর্শ। লাভ করি অনির্বচনীয় আত্মবিশ্বাস। ফিরে পাই এক অনিন্দ্যসুন্দর আত্মশ্লাঘা।
এমন বৃহৎ অর্জনের পরও কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি বলে মনে হয়। মাত্র চার দশকের মধ্যেই জাতীয় ঐক্য খণ্ড-ছিন্ন হয়েছে। জাতীয় লক্ষ্যও অস্পষ্ট হয়েছে। জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণশক্তি আজ ক্ষয়িষ্ণু। জাতিসত্তার যে অমিত তেজ অসম্ভবের বিন্ধ্যাচল টলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল, তা যেন চলৎশক্তিহীন, নিশ্চল। কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর এই লেখায় নেই। শুধু এটুকু বলতে চাই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এ জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এই অর্জনের তাৎপর্য হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনাকে ধারণ করা এবং অগ্রগতির শত পথকে নির্বিঘœ করে তোলা, যেন কোনো অপরিণামদর্শী চিন্তা ও উচ্চারণ জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতে সক্ষম না হয়। এই অর্জনের মৌল তাৎপর্য হলো এই ঐতিহাসিক বিজয়কে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থপূর্ণ করে তোলা। প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে এই বিজয় সমগ্র জাতির বিজয়। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা কোনো দলের বিজয় নয়। এই সত্যের বিকৃতি ঘটানোর স্পর্ধা যেন কারো না হয়। তাই আমাদের ভাবতে হবে দেশের কোটি কোটি সন্তানের কথা। তাদের ভাবনাচিন্তা ও আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করার কথা। তাদের দুঃখ-বেদনার কথা। তাদের বঞ্চনার কথা। গত তিন দশকে যেভাবে সর্বগ্রাসী ব্যর্থতা আমাদের আড়ষ্ট করে রেখেছে তার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সার্থকভাবে মোকাবিলা করার কথা। দলীয় কোন্দলের নোংরা নর্দমা থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র সমাজে বলিষ্ঠ জীবনবোধ প্রতিষ্ঠার কথা।
মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ মূলধন ছিল জনসমষ্টির মধ্যে এক ইস্পাত কঠিন ঐক্যবোধ। কিছুসংখ্যক বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পদলেহনকারী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের বিপথগামী ছাড়া দেশের সব ধর্মের অনুসারী, সব মত ও পথের অনুসারী তাদের ভাগ্যকে সংশ্লিষ্ট করেছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের সঙ্গে। তাই জাতি-ধর্ম, নারী-পুরুষ, ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সংশ্লিষ্ট হয়েছিল ওই সংকটকালে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার সংগ্রামে। কেউ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছিল। কেউ তরুণদের প্রেরণা জুগিয়েছে। কেউ অর্থ বা অন্যান্য সামগ্রী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়ে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। কেউ কেউ সমূহ বিপদ মাথায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে। কেউ বা অংশ নিয়েছে সংগ্রামের গতি-প্রকৃতি জানিয়ে এবং সঠিক তথ্য সরবরাহ করে। মোটকথা, জাতীয় সংকটকালে জাতির মুক্তির জন্য এই জাতির সবাই অংশগ্রহণ করেছে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধে। তাই সম্ভব হয়েছে মাত্র ৯ মাসে বিজয় অর্জন—মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি।
মুক্তিযুদ্ধের আর একটি প্রকৃতি ছিল এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য। এই লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে রূপান্তর করা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে এমনভাবে সাজানো, যেখানে থাকবে না কোনো নির্যাতনের লেশমাত্র। থাকবে না নিপীড়নের কোনো চিহ্ন। শোনা যাবে না বঞ্চনার কোনো করুণ কাহিনী। দেখা যাবে না শোষণের কোনো ক্ষতচিহ্ন। কেউ শুনবে না শোষিতের ক্রন্দন। এমন প্রত্যাশা নিয়েই বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার এই সংগ্রামে স্বাধীনভাবেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কারো ওপর নির্ভর না করে, কারো নির্দেশ না মেনে, কারো ভয়ে ভীত না হয়ে অথবা কারো সাহসে সাহসী না হয়ে, নিজেদের ওপর আস্থা রেখে সবাই অগ্রসর হয়েছে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) দিকে না তাকিয়ে, বিশ্বের তাবত বড় শক্তি কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে গ্রহণ করবে সেদিকে কোনো দৃষ্টি না দিয়ে এ দেশের গণমানুষ ছুটে গিয়েছিল শত্রুনিধনে। এই জীবন-মরণ সংগ্রামে কেউ সহায়তা করবে কি না এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা কখনো সন্দেহপীড়িত হয়নি। কোন রাষ্ট্র ভালো বলবে এমন চিন্তাভাবনায় তো সেদিন আমাদের জাতীয় মানস বিচলিত হয়নি। তবে এখন কেন এই অসহায়ত্ব? যাঁরা শহীদ হয়েছেন জাতির শ্রদ্ধাসিক্ত হয়ে আজও তাঁরা মাথা উঁচু করেই রয়েছেন। থাকবেন অনন্তকাল। এই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার।
বাংলাদেশ ছোট্ট কোনো জনপদ নয়। জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রতি ৪৬ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি। বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশই সর্বশেষ স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র। জাতিসংঘের ১৩৩তম সদস্য। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার পরে যে ৫৯টি রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করেছে তাদের সব কটির জনসংখ্যার প্রায় সমান হলো বাংলাদেশের জনসংখ্যা। এমন বৃহৎ জনসমষ্টির বাংলাদেশ অন্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কিভাবে?
কারো কারো জীবজন্তু নিয়ে খেলা করার অভ্যাস রয়েছে বটে; কিন্তু ওই সব জীবজন্তু সব সময় হয় অতিক্ষুদ্র। সাদা ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, শশক বা ছোট পাখি। হাতি কিন্তু কারো খেলার সাথি হয় না। জনসংখ্যার নিরিখে বাংলাদেশ তো হাতি নিশ্চয়, হোক না এর জনগণ দরিদ্র, হোক না বাংলাদেশ হাজারো সমস্যাক্লিষ্ট। তাই বাংলাদেশকে কেউ খেলনা হিসেবে ব্যবহারে আগ্রহী হতে পারে না, যদি না বাংলাদেশ নিজেই অন্যের খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশকে প্রতি ক্ষেত্রে নির্দেশ দিতে সাহসী হয় কেন অন্যরা? কেন বাংলাদেশ অন্যের ইচ্ছাবরদার?
মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুসংখ্যক নরাধম মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে বটে, তবে শক্তি বলতে যা বোঝায় তারা তখনো ছিল না। এখনো নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো কোনো ব্যক্তির নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল সমগ্র জাতি। জাতীয় জীবনের এই সন্ধিক্ষণে এসব বাণী প্রচার অর্থহীন। এতে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে। ফাটল ধরতে পারে জাতীয় সংহতিবোধে। সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার সম্পর্কে। সেই জাতীয় সংকট থেকে উত্তরণে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়েছিল আমাদের জাতীয় জীবনের তিনটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্জন—আমাদের ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য, নেতৃত্বের আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য। এগুলোই আমাদের উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারগুলোকে প্রতিপদে প্রতিক্ষণে যদি আমরা শাণিত রাখতে পারি, তাহলে অতীতে যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে আমরা সংকটকাল অতিক্রম করেছি, বর্তমানেও তা সম্ভব হবে এবং যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা আত্মত্যাগের মহোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন তা-ও আমাদের নাগালের মধ্যে আসবে। জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
এই সত্য যত শিগগির অনুধাবন করব ততই আমাদের মঙ্গল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাইরের কোনো শক্তির নির্দেশ বা প্রণোদনায় নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই ওই পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। পথ চলতে চলতে কিছু সুহৃদের কোমল পরশ আমরা লাভ করেছিলাম, তা কিন্তু ছিল হঠাৎ পাওয়া সুখের স্পর্শ। লক্ষ্য কিন্তু নির্ধারিত হয়েছিল এ মাটিতেই, এ মাটির সন্তানদের দ্বারাই, এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়। এটি অবশ্য স্মরণে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে যতটুকু ঘৃণা ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার অদম্য স্পৃহা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। আবারও বলব, মুক্তিযুদ্ধের এই উত্তরাধিকার ধারণ করতে পারলে আমাদের পথচলা হয়ে উঠবে দুর্দমনীয়। আর দুর্দমনীয় হবে চলতি পথে যদি সংযুক্ত হয় জাতীয় মেধা আর ধীশক্তি। আমাদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে আমরা যেন উদাসীন না থাকি।

অন্যরকম