আহমদ রফিক ।। খোলা বাজার২৪, রোববার, ২২ মে, ২০১৬: সম্প্রতি আয়োজিত (এপ্রিল ২০১৬) বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষায় রুখে দাঁড়ানোর’ জন্য সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাতিসহ সব সংখ্যালঘুর পক্ষেই কথাগুলো বলেছেন।
স্থানীয় বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলেন : ‘আমরা একজন হিন্দুকে হিন্দু বলে, একজন খ্রিস্টানকে খ্রিস্টান বলে, একজন গারোকে গারো বলে তার ওপর নির্যাতন করি। তার ওপর আঘাত করি। তার বাড়িঘরে আগুন লাগাই। এটা কোনো সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। এটাকে আমাদের প্রতিরোধ করতেই হবে।’
বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীর এই অপ্রিয় সত্যের সরল স্বীকারোক্তিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এই নেতাকে তাঁর বক্তব্যের জন্য, অপ্রিয় সত্য ভাষণের জন্য অভিনন্দন জানাই, তাঁর মূল বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানাই। আবেগতাড়িত হয়ে নয়, সামাজিক বাস্তবতা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে একাট্টা হওয়ার প্রয়োজনবোধ থেকে ওই বক্তব্যের পক্ষে সমর্থনের কথা বলছি।
সত্য যত অপ্রিয় হোক, তাকে স্বীকার না করলে কোনো প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ সম্ভব হয় না। আর সমাজ এ সম্পর্কে সচেতন না হলে প্রতিরোধ তো দূরের কথা, অন্যায়-অত্যাচার লাগাতার ঘটতেই থাকে, সেটা পুরোদস্তুর অভ্যাসে পরিণত হয়। আমাদের সমাজে সাম্প্রদায়িক বিরূপতা ও সহিংসতা এমন পর্যায়েই পৌঁছে গেছে। তা না হলে একাত্তরে ধর্ম ও জাতি-নির্বিশেষে এদেশীয় সমাজ একটি রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধ সমাপনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে কেন পাকিস্তানি আমলের মতো সংখ্যালঘু পীড়ন চলবে? কেন পিতা-পিতামহের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে তাদের অনেককে ক্রমান্বয়ে দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অসহনীয় উদ্বাস্তু জীবন যাপন করতে হবে? কিন্তু তা হচ্ছে। ঘটনা, পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা এমন সত্যেরই প্রমাণ দেয়।
এ ঘটনার সূচনা তো পাকিস্তান আন্দোলনের উন্মাদনার জেরে ১৯৪৭ সালের আগস্টের দেশভাগ, বাংলাভাগের সময় থেকে। ভয়ে, আতঙ্কে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সংঘটিত মৃত্যু ও ইজ্জতহানির তাড়নায় বাস্তুত্যাগীর মিছিল চলেছে সীমান্তের দিকে। পাকিস্তানি শাসনের নীতিই ছিল পূর্ববঙ্গকে সংখ্যালঘুশূন্য করা এবং সেই সুবাদে পূর্ববঙ্গীয়দের পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার বিচারে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। একাত্তরের বর্বর হামলার সময়ও কোনো কোনো পাকিস্তানি সেনানায়কের কণ্ঠে এমন কথা শোনা গেছে।
দুই.
স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বঙ্গীয় সমাজ যে পূর্বোক্ত পথ ধরেই চলছে তার প্রমাণ বহু অবাঞ্ছিত ঘটনা ও কিছু পরিসংখ্যান। পাকিস্তান আমলে সংখ্যালঘু মানুষের জমি, দোকানপাট, বাস্তুভিটা বা ব্যবসা-বাণিজ্য জবরদখলের কথা যদি বাদও দিই, তবু সত্য যে সমাজের বেশ কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে পূর্বোক্ত পাকিস্তানি মানসিকতা এখনো বিরাজ করছে, তার প্রমাণ সংখ্যালঘু মানুষের ওপর হামলা ও তাদের সম্পদ আত্মসাতের ঘটনাবলি।
সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের পরিসংখ্যান বিবেচনা করতে গেলে সংখ্যাবৈষম্যের হার বিপজ্জনক মাত্রায়ই বলতে হয়। এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব সত্ত্বেও যত দূর জানা যায়, ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পূর্বক্ষণে পূর্ব বাংলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ছিল ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। দেশভাগের উন্মাদনায় বাস্তুত্যাগের কারণে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ শতাংশে, মতান্তরে ৩০ শতাংশে।
আর গণপ্রজাতন্ত্রী নামে পরিচিত বাংলাদেশে এরপর সংখ্যালঘুদের ওপর চলেছে নানা উপলক্ষে হামলা, জমি বা বাস্তুভিটা দখল, হুমকি, নির্যাতন; যে কারণে তাদের জনসংখ্যা এখন ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরে বাংলাদেশ প্রায় সংখ্যালঘুশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত হবে। হয়তো থেকে যাবে কিছুসংখ্যক অতিদরিদ্র সহায়হীন মানুষ। এমন আশঙ্কার কথা বেশ কিছুকাল ধরে দেশের সেক্যুলার চেতনার মানুষ বলে আসছেন।
কথাগুলো যে আমার ব্যক্তিক বিবেচনা বা সংখ্যালঘুপ্রীতির কারণে নয়, তার প্রমাণ মেলে শাসনযন্ত্রের প্রতিনিধি সৈয়দ আশরাফের পূর্বোক্ত বক্তব্যে। অলিখিত ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেক সৎ মানুষের জবানিতেও এ সত্য ধরা পড়ে। এমনকি এই অপ্রিয় বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর বক্তব্যে।
সম্প্রতি অর্থাৎ এ বছরের ১৪ মে ‘অস্তিত্ব রক্ষা ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত সাত দফা ভিত্তিক আলোচনা সভায়’ সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনের বক্তব্যে আমাদের পূর্বোক্ত আশঙ্কা ও তা প্রতিরোধের বিষয়টির প্রতিফলন ঘটেছে।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাসীন দলের বিশিষ্ট নেতা মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘সংখ্যালঘুদের ওপর যারা হামলা করে, যারা তাদের জমি দখল করে, তাদের কোনোমতেই ছাড় দেওয়া যাবে না। আপনাদের সাত দফার সঙ্গে আমি মোটামুটি একমত।’ জবরদখলের ঘটনা যে ঘটে চলেছে, মন্ত্রী জনাব নাসিমের বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
বামপন্থী নেতা ও মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের বক্তব্যও ভিন্ন কিছু নয়। তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রকে এখনো আমরা অসাম্প্রদায়িক করতে পারিনি। এখনো সংখ্যালঘু নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের জমি দখল হচ্ছে’ ইত্যাদি। তাঁর মতে, ‘জাতীয় ঐকমত্য না হলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।’
এই সম্মেলনে একাধিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্টজন একই ধারায় বত্তৃদ্ধতা করেন। যেমন—স্বনামখ্যাত সুলতানা কামালসহ বাম রাজনৈতিক দলের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ খালেকুজ্জামান, শিরিন আখতার এবং অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মেসবাহ কামাল প্রমুখ সমাজের বিভিন্ন স্তরের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব।
এমন একটি জমজমাট, প্রতিনিধিত্বশীল সমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে, বাংলাদেশি সমাজ বাস্তবিকই গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। বৃহত্তর সমাজে এই সব বিদগ্ধ মানুষের কোনো প্রভাব থাকলে সংখ্যালঘু তাড়না অবাধ গতিতে চলতে পারত না, সংখ্যালঘু জনসংখ্যা এক ডিজিটে পৌঁছত না।
যে কথাটি তাঁরা বলতে পারেননি বা বলেননি তা হলো, সংখ্যালঘুখেকোদের বেশির ভাগ শক্তিমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবশালী নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা বা তাদের সমর্থনপুষ্ট দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ। সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ‘আমার দিনাজপুরের সংখ্যালঘুরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’
আমাদের প্রশ্ন : কেন যাচ্ছে? শখ করে তো কেউ আপন বাস্তুভিটা ছেড়ে বিদেশে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমায় না। আর এই উদ্বাস্তু যাত্রার প্রতিরোধে তাঁরাই বা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? এ কথা সব রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই খাটে। তাঁদের সবাই যদি নিজ নিজ দলে বিরাজমান এই দুষ্ট প্রবণতার বিরুদ্ধে শক্তিমান অবস্থান গ্রহণ করেন তাহলে নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের হার কমে আসতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা খুবই জরুরি।
তা না হলে সভা, সমাবেশ, সেমিনার বা সম্মেলন অনুষ্ঠান এবং সেখানে জোরালো বক্তৃতা প্রদান সংবাদপত্রের কলামভর্তির সহায়ক হতে পারে, তার চেয়ে বেশি কিছু অর্জনের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এই মহতী সমাবেশে সমস্যা সমাধানের বাস্তব রূপরেখা প্রণীত হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। যদি হয়ে থাকে তাহলে তা বাস্তবায়নে উপস্থিত বক্তাদেরসহ আরো কিছু প্রভাবশালী বিশিষ্টজনকে নিয়ে ‘লক্ষ্য বাস্তবায়নে স্থায়ী কমিটি’ গঠন অপরিহার্য। তাদের সক্রিয় রাখার দায় হবে ঐক্য পরিষদের।
তিন.
সত্যি বলতে কি, সম্প্রদায়গত সমস্যা, পাহাড়ি জাতিগত সমস্যা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এসবের সমাধানে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দায় সর্বাধিক। সমাজে গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের সুপ্রভাব ঘটানো অপরিহার্য হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার পাশাপাশি দখলদারি ঘটনার প্রতিরোধে সব ধরনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জবরদখল অপরাধের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা না হলে এই প্রবণতা কমবে না। জনাব মেনন ঠিকই বলেছেন, এ ক্ষেত্রে ‘জাতীয় ঐকমত্য না হলে চলবে না।’ কিন্তু এ কাজটি তো ক্ষমতাসীন দলকেই শুরু করতে হবে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজ তাদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ। তা না হলে এ ধরনের অনুষ্ঠানে সুন্দর কথার, আকর্ষণীয় বক্তব্যের ফুলঝুরি ফোটানোই সার হবে; কাজের কাজ কিছু হবে না।
অবস্থা যে কতটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে তার আরো প্রমাণ সম্প্রতি ধীরেসুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এমনকি বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনাবলি। বিশিষ্টজনসহ সাধারণ স্তরের মানুষও এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার। তবে এ ক্ষেত্রে ঘাতকদের বিশেষ লক্ষ্য পাদ্রি, পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, এমনকি ভিন্নমতের মুসলমান ধর্মীয় প্রধান বা পীর।
এবার ভেবে দেখুন, সমাজের ঘাতক চরিত্র, দূষিত চরিত্র কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। আজ (১৫ মে) একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় মোটা শিরোনাম, ‘বৌদ্ধ ভিক্ষুকে গলা কেটে হত্যা’। হত্যার কারণ সম্পর্কে রয়েছে ভিন্ন মত। এ জন্যই বলছি, শুধু জঙ্গিবাদই নয়, দূষিত সমাজ বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কাজেই প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা সে হিসাবেই করতে হবে এবং তা হতে হবে সম্মিলিত ও সমন্বিত চরিত্রের।
সব শেষে বলি, সংখ্যালঘু সমস্যা ও সামাজিক দুর্বৃত্তপনা বর্তমানে জাতীয় সমস্যার চরিত্র ধারণ করেছে। স্বভাবতই সমাধানের ব্যবস্থাও হতে হবে জাতীয় পর্যায়ের এবং সর্বস্তরের মানুষজনকে নিয়ে। আরেকটি কথা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে হতে হবে সর্বধর্মীয়, সর্বমতের। এতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজনের অন্তর্ভুক্তি না ঘটলে তা সহজে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না। এই বাস্তব সত্যটি তাদের বুঝতে হবে। তাই মনে হয়, এই পরিষদ ঢেলে সাজিয়ে সর্বজনীন চরিত্রে গড়ে তোলা দরকার। এর পেছনে চাই সর্বদলীয় রাজনৈতিক সমর্থন।