Mon. Mar 17th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

এই চাপাতি-হত্যার অন্তরালে কারা?আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ।। খোলা বাজার২৪, বুধবার, ২৫ মে, ২০১৬: আরো দুটি চাপাতি-হত্যার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। বান্দরবানে এক বৌদ্ধ পুরোহিত ও কুষ্টিয়ায় এক নিরীহ হোমিও চিকিৎসককে হত্যা করা হয়েছে। এই হোমিও চিকিৎসক বাউলপ্রেমী ছিলেন। বাউলদের প্রতি জামায়াতিদের অসীম বিদ্বেষ। মুসলমান বাউলদেরও তারা মুসলমান মনে করে না, মনে করে ধর্মবিরোধী। এ জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বহরমপুরে বাউল সম্প্রদায়ের ওপর বামফ্রন্টের রাজত্বকালে নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল সীমান্ত অঞ্চলে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশের জামায়াতিরা। পশ্চিমবঙ্গের জামায়াতিরাও তাদের সহযোগী ছিল—এ কথা বলাই বাহুল্য। সে কথায় পরে আসছি।
কুষ্টিয়ার হত্যাকাণ্ডের জন্য যথারীতি আইএসের নামে দায়িত্ব স্বীকার করানো হয়েছে। পুলিশও যথারীতি বলেছে, কুষ্টিয়ায় আইএসের অস্তিত্ব নেই। তাহলে এই গায়েবি হত্যা কারা চালাচ্ছে এবং কারা আইএসের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেরা আড়ালে থাকার চেষ্টা করছে? তাদের আসল পরিচয়ও পুলিশ এখন পর্যন্ত উন্মোচন করতে পারেনি। কয়েকটি হত্যাকাণ্ডে দু-একজন ধরা পড়েছে। তারা বলেছে, তারা জামায়াত-শিবিরের লোক।
আমার নিজেরও সন্দেহ, এই চাপাতি-হত্যাকাণ্ডের পেছনে জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীর, হুজি ইত্যাদি জঙ্গি উপদল থাকতে পারে; কিন্তু মূল হোতা জামায়াতের শিবির। রাজপথে পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার সন্ত্রাস ব্যর্থ হওয়ার পর তারা এই টার্গেটেড কিলিংয়ের সন্ত্রাস শুরু করেছে। আগে রাজপথে যেমন তারা আগুনে সাধারণ মানুষ হত্যা করেছে, বর্তমানে কয়েকজন ব্লগার হত্যার পর তারা ইতালিয়ান নাগরিক, জাপানি ব্যবসায়ী, বৌদ্ধ পুরোহিত, হোমিও চিকিৎসক প্রমুখ নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যার টার্গেট করছে।
কুষ্টিয়ায় বাউলপ্রেমী হোমিও চিকিৎসককে হত্যার পর এটা যে জামায়াতিদের কাজ এই সন্দেহ আমার মনে দৃঢ় মূল হয়েছে। তার একটা কারণ আছে। ২০০৪ সালে আমি ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ ছবিটির শুটিংয়ের কাজে কলকাতায় গিয়ে মুর্শিদাবাদ ও বহরমপুরেও গিয়েছিলাম। আমাদের টিমে ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা হাসান ইমাম, তাঁর স্ত্রী লায়লা হাসান, মরহুম আমিনুল হক বাদশা ও ‘আমি বাংলায় কথা বলি’ গানের লেখক প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়। বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদে বিশাল বাউল সম্প্রদায়ের বাস। তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সারা বাংলার গৌরব। প্রতিবছর এই দুই জেলায় বাউল উৎসব হয়। তাতে ১৫ থেকে ২০ হাজার বাউল ও বাউলপ্রেমীর সমাবেশ ঘটে। নাচ-গানে ভরপুর এই উৎসবে লক্ষাধিক লোক জড়ো হয়। সপ্তাহব্যাপী চলে এই উৎসব। সেবার এই উৎসবে আমরা আমন্ত্রিত হয়েছিলাম।
বিশাল মাঠের মধ্যে তাঁবু বেঁধে অনুষ্ঠান। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু আমরা সেখানে পৌঁছে দেখি বাউলদের মধ্যে একটা ভীতির ভাব। কারণ জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, জামায়াতিরা এই উৎসব ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছে। নইলে তারা হামলা চালাবে। বাউলরা জানাল, কয়েক বছর ধরেই সীমান্তপথে দলে দলে জামায়াতি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের এসব জেলায় এসে ঘাঁটি গাড়ছে এবং বাউলদের ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। অসংখ্য মাদ্রাসা তারা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বাউলদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। বাউল সম্প্রদায় তাদের ভয়ে ভীত।
তখন পশ্চিমবঙ্গে ছিল বামফ্রন্ট সরকার। মুসলিম ভোট বাক্স রক্ষার জন্য তারা রাজ্যে জামায়াতিদের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে কঠোরতা দেখায়নি এবং বাউলদের ওপর অত্যাচারকেও প্রশ্রয় দিয়েছে। অভিযোগটি তখন আমার বিশ্বাস হয়নি। পরে বিশ্বাস হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে মৌলবাদী মুসলমান সংগঠন, রাজ্যে আশ্রয়গ্রহণকারী ও শক্তিশালী অবাঙালি মুসলমানদের (বিহারি) সমর্থন রক্ষার জন্য আপসের নীতি গ্রহণ করেছিল। তাদের দাবিতে তসলিমা নাসরিনের বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তসলিমাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করেছিল। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে কৃষক আন্দোলন দমনের জন্য দিল্লির জামে মসজিদের খতিবকে এনে সরকারের পক্ষে ফতোয়া আদায় করেছিল।
এই এপিজমেন্ট পলিসি বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করেনি। রাজ্যের এবারের নির্বাচনে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেও পরাজিত হয়েছে। তবে ভয়ের কথা, ক্ষমতায় থাকার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এখন মৌলবাদী ও অবাঙালি মুসলমানদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে চলতে চান। এই অবাঙালি মুসলমানদের খুশি রাখার জন্য তিনি প্রথমবার ক্ষমতায় এসে তিস্তার পানি, স্থল সীমান্ত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখাতেও দ্বিধা করেননি। কারণ পশ্চিমবঙ্গে এই অবাঙালি মুসলমানদের একটা বড় অংশই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বিহারি। তারা ঘোরতরভাবে বাংলাদেশ ও হাসিনা সরকারের বিরোধী।
মৌলবাদীদের তোষণ করতে গিয়ে বামফ্রন্টের কী অবস্থা হয়েছে তা থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষা নেননি। এবারের নির্বাচনেও তিনি এই তুরুপের তাস ব্যবহার করেছেন। তাতে বাম-কংগ্রেস জোটকে হারাতে পেরেছেন বটে; কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কি না সে সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন। বাংলাদেশেও জামায়াতি সন্ত্রাস দমন করার জন্য সরকার হেফাজতের সঙ্গে আপসের নীতি গ্রহণ করে সফল হয়েছে বটে; কিন্তু এই মৌলবাদী শক্তিকে অধিক প্রশ্রয়দানের নীতি পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের মতো বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের এবারের নির্বাচনী সাফল্য তার সরকারকে কতটা স্থায়িত্ব দেবে সে সম্পর্কে অনেকেই এর মধ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের টার্গেটেড কিলিংয়ের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংস্রব তো আছেই, হেফাজতিদের কোনো অংশের সম্পর্কে আছে কি না সরকারের তা তদন্ত করে দেখা উচিত। নারায়ণগঞ্জে সম্প্রতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষককে (যিনি স্কুলটির দীর্ঘকাল ধরে প্রধান শিক্ষক) অসভ্য পন্থায় নির্যাতন, তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধী কথা বলার সাজানো অভিযোগ তোলা, স্থানীয় মসজিদ থেকে তাঁকে নির্যাতন করার জন্য উসকানি প্রদান হেফাজতের রণ কৌশলেরই অংশ বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে হিন্দুত্ববাদ ঢুকে পড়েছে, সরকারের শিক্ষানীতি ইসলামবিরোধী ইত্যাদি ধুয়া তুলে হেফাজতিরা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে স্মারকলিপি প্রদান করেছে, তাতে বুঝতে কষ্ট হয় না জামায়াতের পথ থেকে হেফাজতের পথ আলাদা নয়। এখনকার আবেদন-নিবেদনের আড়ালে তারাও জঙ্গিনীতি গ্রহণে উৎসুক—এ কথা প্রমাণিত হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। হেফাজতিদের সেই রূপটি আবিষ্কৃত হলে সরকারকে তখন হয়তো ঠোঁটে আঙুল চেপে বলতে হবে, Thou too Brutas (ব্র“টাস, তুমিও!)।
কোনো সন্দেহ নেই, এই চাপাতি-হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এবং তার অজুহাত তুলে সরকার উচ্ছেদের যৌক্তিকতা সৃষ্টি করা। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষণীয়। যখনই বাংলাদেশে একটা চাপাতি-হত্যাকাণ্ড ঘটে তখনই আমেরিকা থেকে চিৎকার ওঠে, এটা আইএসের কাজ। আইএসের নামে একটা স্বীকারোক্তিও প্রচার করা হয়। এটা কি আমেরিকার প্রশাসনের পছন্দের দল জামায়াতকে আড়াল করার চেষ্টা অথবা মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো ‘বাঘ-বাঘ’ চিৎকার তুলে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ সামরিক অনুপ্রবেশের আগ্রহ? এই সন্দেহ অনেকেরই মনে রয়েছে।
সম্প্রতি একটি মার্কিন কাগজেই আইএসের জন্মবৃত্তান্ত পাঠ করেছি। সিরিয়ার সেক্যুলার গভর্নমেন্টকে উচ্ছেদের জন্য আইএসের জন্মদাতা আমেরিকা। অর্থ ও অস্ত্রদাতা সৌদি আরব। ট্রেনিংদাতা ইসরায়েলের মোসাদ।
বাংলাদেশেও একটি সেক্যুলার গভর্নমেন্টকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের জন্য একই শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা শুরু হয়ে থাকলে তা কি খুব বিস্ময়ের ব্যাপার? বাংলাদেশে এরই মধ্যে মোসাদের তৎপরতা আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানেও মোসাদের সংস্রব সন্ত্রাসী দল জামায়াত ও তাদের মিত্র বিএনপির সঙ্গে। এর আগে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের চক্রান্তে বিএনপির একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবি আইয়ের এজেন্টের সহায়তা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আমার মতো যাঁরা কনস্পিরেসি থিওরিতে বিশ্বাস করেন না তাঁরাও একটার পর একটা এই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হতে দেখে হয়তো শিহরিত হয়ে ভাবছেন, এর শেষ কোথায়?
চাপাতি-হত্যার পেছনে দেশি জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহলেরও কোনো যোগাযোগ আছে কি না সরকারের তা সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করে দেখা দরকার। চাপাতি-হত্যার এই আড়ালের লোকগুলো ধরা না গেলে এই হত্যাকাণ্ডের মূলোচ্ছেদ করা যাবে না। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকতেই বেছে বেছে নিরীহ ও নির্দোষ মানুষ হত্যার যে অভিযান চলছে, এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা গেলে সারা দেশে কী পাইকারি হত্যা শুরু হতে পারে, একাত্তর থেকে সেই শিক্ষা কি আমরা নেব না?
এই হত্যাকাণ্ডের শেষ লক্ষ্য শেখ হাসিনা। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজম চিরতরে উচ্ছেদ। দেশের সচেতন মানুষ এর বিরুদ্ধে সতর্ক ও সংঘবদ্ধ হোন। সরকার এপিজমেন্ট নীতি ত্যাগ করুক। নইলে সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না।