Tue. Mar 18th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

18kহায়দার আকবর খান রনো ।। খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৬ মে, ২০১৬: যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের আস্ফাালন খুবই হাস্যকর মনে হয়েছে। তাদের পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে নিন্দা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং কোনো কোনো সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতা নিজামীর বিচারের প্রসঙ্গটি জাতিসংঘে উত্থাপনের মতো হাস্যকর প্রস্তাবও দিয়েছেন। বাংলাদেশের কোর্ট বাংলাদেশের আইনের ভিত্তিতে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। সেখানে জাতিসংঘের বলার বা করার কিছুই নেই। পাকিস্তানেরও নাক গলানোর অধিকার নেই। কারণ এটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
নিজামীর ফাঁসিতে আরেকটি রাষ্ট্র তুরস্ক খুব গোস্সা হয়েছে। তুরস্কের বিচলিত হওয়ার কী আছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। একটা কারণ এই হতে পারে যে তুরস্কের বর্তমানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর মতাদর্শগত মিল আছে। তবে তুরস্কের ভালো করে জানা উচিত যে সেই দেশের সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের কাছে বাংলাদেশের জনগণ আত্মসমর্পণ করবে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া ভণ্ডুল করার অনেক চেষ্টা হয়েছিল। তুরস্কের সরকার একবার সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিচার বন্ধ করার জন্য অনুরোধও জানিয়েছিল। হয়তো জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এমন মধ্যপ্রাচ্যের আরো কোনো দেশ গোপনে চাপ সৃষ্টি করে থাকতে পারে। ১৫ মে তারিখের কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, এই বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য বিদেশি চাপও ছিল। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রতিবেদক এক বিদেশি মন্ত্রীর (দেশ বা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেননি) বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। ‘এ বিচার ঠেকাতে কত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিদেশিদের কাছে তদবির করা হচ্ছে সে বিষয়ে হয়তো বাংলাদেশের ধারণাই নেই।’
পাশ্চাত্যের কোনো কোনো মিডিয়া ও তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাও বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে সমালোচনা তুলে ধরেছে। তারা বলতে চেয়েছে যে বাংলাদেশে এই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে তা আন্তর্জাতিক মানসম্মত নয়, যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। বড় হাসি পায় ওদের এসব কথা শুনলে। যখন কোনো রকম আন্তর্জাতিক আইনকানুন না মেনে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তখন তো তাদের মুখে কোনো প্রতিবাদ শুনিনি। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে পশ্চিমা মিডিয়া ও করপোরেট পুঁজির অর্থে লালিত তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভণ্ডামি ও মিথ্যাচার আজকাল ধরা পড়ে গেছে। তবু আমরা এই যে মানসম্মত নয়, স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, এ ধরনের অভিযোগের কতটুকু ভিত্তি আছে, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব। প্রসঙ্গক্রমে এটা উল্লেখযোগ্য যে আমাদের দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপিও; কিন্তু প্রকারান্তরে একই ধরনের অভিযোগ তুলেছে। সরাসরি বলার সাহস নেই, কিন্তু একটু ঘুরিয়ে তারাও একই কথা বলেছে। তারা বলেছে, বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্মত ও স্বচ্ছ। তার মানে এখন যে বিচারপ্রক্রিয়া চলছে তা যথেষ্ট মানসম্মত নয় অথবা স্বচ্ছ নয়। বস্তুত বিএনপি তার জোটসঙ্গী জামায়াতকে তুষ্ট করার জন্য এ ধরনের কথা বলেছে। এ ছাড়া বিএনপির এখনকার রাজনীতি প্রায় পাকিস্তানের মুসলিম লীগের মতোই দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু তাদের দলের সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীও এই বিচারে আসামি ছিলেন। যাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। বিএনপি সাকা চৌধুরীর বিচারের রায়ের সমালোচনা করেছিল। অবশ্য নিজামী প্রমুখের রায়ের ও ফাঁসি কার্যকর হওয়ার ব্যাপারে অর্থবহ নীরবতা পালন করে আসছে। একবারও মুখ ফুটে বলতে পারল না, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দালাল, ঘৃণ্য অপরাধীদের শাস্তিতে আমরা সন্তুষ্ট।’ ছি, তারা নাকি জাতীয়তাবাদী! পাকিস্তানের ভূত কি নতুন করে চেপে বসেছে?
অন্যদিকে হাসিনা সরকারের অন্যান্য বিষয়ে যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয় এ কারণে যে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ অগ্রাহ্য করে দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় কাজ।
ফিরে আসা যাক বিচারের মান ও স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে। আমি শুধু এটুকুই বলব যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের যে বিচার এখন চলছে, তা যেকোনো আন্তর্জাতিক বিচারপ্রক্রিয়ার তুলনায় অনেক বেশি স্বচ্ছ ও মানসম্মত। ঐতিহাসিক টোকিও ট্রায়াল বা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের তুলনায় তো বটেই। টোকিও ট্রায়ালে জাপানের প্রধানমন্ত্রীসহ ৯০০ মানুষকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ওই বিচারের অন্যতম জুরি বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল অন্যদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ভিন্ন রায় দিয়েছিলেন। যে প্রক্রিয়ায় ঢালাও ফাঁসি দেওয়া হচ্ছিল তাকেও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, রাধাবিনোদ পাল ছিলেন বাঙালি এবং ওই টোকিও ট্রায়ালে একমাত্র ভারতীয় জুরি। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রাচ্য দেশের এই বিজ্ঞ বিচারপতির বক্তব্যকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি।
আমাদের দেশে এখন যে বিচার চলছে, সে সম্পর্কে একটি বড় আপত্তি হলো মৃত্যুদণ্ডটাই আধুনিক যুগে যথার্থ নয়। বলছে কারা? পাশ্চাত্য দেশের কিছু মানবাধিকার সংস্থা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এখনো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে বৈজ্ঞানিক রোজেনবার্গ দম্পতিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, তা যে মিথ্যা অজুহাত ছিল, সেটা এখন জানা হয়ে গেছে। যারা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে ইরাক দখল করে এবং সাদ্দামকে ফাঁসি দেয়, তাদের কথায় কি গুরুত্ব দেওয়া দরকার? যে ইংল্যান্ড ফাঁসির বিরুদ্ধে এখন কথা বলছে, তারা যে আমাদের দেশে কত দেশপ্রেমিক যুবককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে, তার জন্য কি কখনো অনুশোচনা করেছে? অতএব, পাশ্চাত্যের কথায় প্রভাবিত হওয়ার দরকার নেই।
এমনকি এখনো হেগে যেসব যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার চলে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ, মানসম্মত ও আসামিদের প্রতি উদার আমাদের দেশে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া। তবে এ কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে এটা কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচার নয়। আমরা আমাদের দেশের আইনে আমাদের আদালত দ্বারা আমাদের দেশের নাগরিকদের অপরাধের বিচার করছি। সে ক্ষেত্রে অন্য দেশের নাক গলানোর কোনো সুযোগই নেই।
পাকিস্তানের এক মন্ত্রী বলেছেন, নিজামীর ফাঁসি হওয়ায় পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কেন? নিজামী কি পাকিস্তানি নাগরিক? হবে, তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। সেটা তো আমাদের বিবেচনায় অপরাধ। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, ‘নিজামীর একমাত্র অপরাধ যে তিনি পাকিস্তানের সংবিধান ও আইনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।’ হ্যাঁ, এটা তো আসলেই অপরাধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠিত হওয়ার পর (যদিও তা প্রবাসী সরকার), পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া তো অপরাধ বটেই। বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে যে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা সেই বোধটুকুও কি পাকিস্তানি নেতাদের হয়নি?
কিন্তু সেই অপরাধের বিচার এখন হচ্ছে না। পাকিস্তানের পক্ষে দালালি করার জন্য যে অপরাধ তা বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এ রকম সাধারণ ক্ষমা ভিয়েতনামও করেছিল বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ার পর। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে থেকে হত্যা, ধর্ষণের কাজে অংশ নেওয়া অথবা সহযোগিতা করা আরেক ধরনের অপরাধ। প্রথমটি হলো রাজনৈতিক অপরাধ। পরেরটি হলো ক্রিমিনাল অপরাধ—যাকে বলা হচ্ছে মানবাধিকারবিরোধী অপরাধ। সেটারই বিচার হচ্ছে। সেটা হওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক অপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমা করলেও খুন-ধর্ষণের মতো ক্রিমিনাল অপরাধের জন্য কাউকে ক্ষমা করেননি। কোনো সরকারই তা পারে না। তাই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও কয়েক হাজার বন্দি ছিল, যাদের জিয়াউর রহমান মুক্তি দিয়েছিলেন। এতকাল পর এখন তাদের বিচার শুরু হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় যারা দোষী প্রমাণিত হয়েছে, তারা শাস্তি ভোগ করছে। এ নিয়ে পাকিস্তানের আস্ফাালন কেন? তারা জাতিসংঘে অভিযোগ তোলার মতো কথা বলছে, যা মূর্খের মতোই শোনাবে।
জামায়াত নেতারা, আলবদর ইত্যাদি ঘাতক দলের পাণ্ডারা ১৯৭১ সালে যে ধরনের নৃশংস কাজ করেছিল, তার বিচার হওয়াটা জনগণের দাবি। সেই বিচারকার্য যে সম্পন্ন হতে চলেছে, এ জন্য আমরা আশ্বস্ত বোধ করছি। পাকিস্তানের লাফালাফিতে কিছু আসে-যায় না।
পরিশেষে দিল্লি সম্মেলন সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা দরকার। ১৯৭৪ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাক্রমে ড. কামাল হোসেন, শরণ সিং ও আজিজ আহমদের বৈঠক হয় এবং ৯ এপ্রিল যৌথ ঘোষণা প্রকাশিত হয়। যৌথ ঘোষণায় ১৯৭১ সালের ঘটনাবলি প্রসঙ্গে ‘ফরগেট অ্যান্ড ফরগিভ’ কথাটি উল্লিখিত ছিল। ড. কামাল হোসেন স্বাক্ষরিত এই ঘোষণায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বরাত দিয়ে বলা হয় যে বাঙালি ক্ষমা করতে জানে। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে মুক্তি দেওয়া হয়। পাকিস্তান কথা দিয়েছিল যে তারা তাদের দেশে ১৯৫ জন সেনাসদস্যের অপরাধের বিচার করবে। কিন্তু তা তারা করেনি। অতএব, দিল্লি ঘোষণার বরখেলাপ পাকিস্তানই করেছে। সেই ঘোষণায় এ কথা কখনই বলা হয়নি যে বাংলাদেশের রাষ্ট্র তার নাগরিকের বিচার করতে পারবে না। এটা তো আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার। পাকিস্তানিরা যদি সেটাকে অস্বীকার করে জাতিসংঘে নালিশ জানাতে যায়, তাহলে সেটা যেমন একদিকে হাস্যকর ও খেলো হয়ে মূর্খতার পরিচয় দেবে, অন্যদিকে এটাকে মেহেদী হাসানের ভাষায় ‘বিচলিত পাকিস্তানের নজিরবিহীন ধৃষ্টতা’ বলা যেতে পারে।