কর্নেল এস এম শওকত আলী (অব.) ।। খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ০৩ জুন ২০১৬ : প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক সবারই কাম্য। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ যে শুধু তিন দিক থেকে বিশাল ভারতবর্ষ দ্বারা বেষ্টিত তা কিন্তু নয়, আমাদের আন্তর্জাতিক সীমারেখার অপর প্রান্তে আছে অর্থনৈতিকভাবে উদীয়মান ও সামরিক দিক থেকে সংখ্যা বিবেচনায় পৃথিবীর নবম বৃহৎ দেশ মিয়ানমার। যার সঙ্গে যেমন আছে আমাদের ২৭১ কিলোমিটার বিস্তৃত পাহাড়ি বন্ধুর স্থলসীমা, তেমনি আছে বিশাল সমুদ্র সীমারেখা। সেই আশির দশকে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের স্থল সীমারেখা চিহ্নিতকরণকাজ যেমন পাকাপাকিভাবে শেষ হয়েছে, তেমনি ২০১২ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক আদালতের (ওঞখঙঝ) মাধ্যমে সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের জটিল কাজটিও সম্পন্ন হয়েছে। এ কথা সত্য, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দর্শন, কর্মকাণ্ড ও অসহিষ্ণু পরিস্থিতি তার নিকট-প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে প্রভাবিত কিংবা কিছুটা হলেও সংক্রমিত করে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে মিয়ানমার এমন একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যেখানে রয়েছে দীর্ঘ ৫০ বছরের সামরিক শাসনের ইতিহাস। যদিও গত বছর সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে মিয়ানমার একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উত্তরণের পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে, তথাপি দীর্ঘ সামরিক শাসনের কুপ্রভাব থেকে যে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারছে সে ভরসা আপাতত ক্ষীণ। ২০০৮ সালে সে দেশের সামরিক জান্তা প্রচলিত সংবিধানে এমন কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছে, যার ফলে সামরিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে সহসা বেরিয়ে আসা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষেই এতটা সহজ হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পার্লামেন্টের একটা নির্দিষ্টসংখ্যক আসন (২৫%) সেনা কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। আর এই সংখ্যাটা এমন যে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে কোনো সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে হলে সেনা কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত বিষয়ক অতি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর হাতেই থাকবে। মোট কথা ঘুড়িটি মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিয়ে লাটাইটা ধরে রাখা। তাদের যেকোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আমাদের এতটা মাথাব্যথা না হলেও এমন কিছু বিষয় আছে, যা আমাদের ভাবনার বাতাবরণ থেকে মুক্ত রাখছে না।
২০১৫ সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সে দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের বিকাশে আমরা আনন্দিত ও উৎফুল্ল হয়েছিলাম এই ভেবে যে উভয় দেশের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ অনেকটাই সুগম হবে। বিশেষ করে যে সরকারের সর্বময় মেনটর শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি। কিন্তু বর্তমান আবহে আপাতত আমাদের প্রত্যাশা পূরণের পথ ততটা সুগম হবে বলে মনে হচ্ছে না।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চীন সীমান্তের কাছে নিরাপত্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ যেমন চলছে, তেমনি চলছে থাই সীমান্তের কাছেও। এ নিয়ে আমাদের খুব বেশি উদ্বেগ না থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমরা দারুণভাবে আচ্ছন্ন ও হতাশ। অতি সম্প্রতি মিয়ানমারের গণতন্ত্রে উত্তরণের অবিসংবাদিত নেতা অং সান সু চি সে দেশে নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে নির্যাতিত মুসলিমদের ক্ষেত্রে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দান আমাদের উদ্বেগ ও হতাশার মাত্রা বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিবেশী দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক বহু দিন ধরে অনেকটা শীতল হয়ে আছে। বিশেষ করে সে দেশের সামরিক শাসন আমলে। ধারণা করা হয়েছিল, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে কিন্তু প্রতিভাত হচ্ছে যে সহসা এর কোনো কূলকিনারা হচ্ছে না। যদিও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করছে, তবু আগের সামরিক সরকারের মতো বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারও তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। কারণ মিয়ানমারে যে ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠীর নাম স্বীকৃত তার মধ্যে রোহিঙ্গা নামটি নেই।
১৯৭৮ সালের অপারেশন ‘কিং-ড্রাগন’-এর ফলে এ অঞ্চলের প্রায় দুই লাখ মুসলমান বসতবাড়ি ফেলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ এর তীব্র প্রতিবাদ জানালে বার্মিজ কর্তৃপক্ষ জানায়, যাদের জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা বাংলাদেশি নাগরিক, অবৈধভাবে বার্মায় বসবাস করছিল। ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নে উইন সরকার এই দুই লাখ শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। কিন্তু ১৯৮২ সালে বার্মার সামরিক সরকার কর্তৃক প্রণীত আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ এবং বিদেশি বলে আখ্যা দেয়। এ ছাড়া ১৯৯১-৯২ সালে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা নির্যাতন ও নির্মম অত্যাচারে বাংলাদেশে চলে আসে। এভাবেই রোহিঙ্গা সমস্যার উৎপত্তি ও এর চিরস্থায়ী সমাধানকল্পে কূটনৈতিক তৎপরতা।
বাংলাদেশের বর্তমান কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করলে তার দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্বমুখী প্রবণতা লক্ষণীয়। পশ্চিমা দেশগুলোর যখন তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি প্রায় তলানিতে উপনীত (আমেরিকা ও জার্মানি ছাড়া) তখন বাংলাদেশের এই কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রবণতা প্রত্যাশিত। কারণ এ অঞ্চলে আছে চীনের মতো পৃথিবীর দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি (কারো মতে প্রথম) তেমনি আছে তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি জাপান। তা ছাড়া আছে উন্নত মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, উদীয়মান ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ। এ কথা সহজেই অনুমেয় যে বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি পশ্চিম থেকে (চীনকে ঘিরে) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ধাবমান। বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক যোগ-বিয়োগে মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য বিশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আমাদের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বমুখিতার স্থলপথের সেতুবন্ধ এই মিয়ানমার। কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং এই অঞ্চলকে ঘিরে বিশ্বশক্তিবলয়ের মধ্যে সম্পর্কের যে যোগ-বিয়োগ চলছে তাতে মিয়ানমার ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ কথা দিবালোকের মতো স্বচ্ছ যে মিয়ানমারের সঙ্গে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক দ্বারা স্থলপথে সংযোগ স্থাপিত হলে বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তি চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য সব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন বাংলাদেশ স্বল্প সময় ও খরচে করতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে বিশ্বশক্তি চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বহুমুখী। তাই স্থলপথে চীনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমার হয়েই সবচেয়ে সহজ পথ।
কিন্তু দুই নিকট-প্রতিবেশীর মধ্যে বিরাজমান সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান হলো, রোহিঙ্গা ইস্যু ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের ভেতর থেকে সৃষ্ট বিপ্লবী সশস্ত্র সংগঠনের (জঝঙ, অজঘঙ ও অখঋ) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযান। যার ফলে এত দিন মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বারবার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জোরপূর্বক ঠেলে দিয়ে সমস্যার সমাধান ব্যতিরেকে আরো অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। অধিকন্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে (বান্দরবান ও কক্সবাজার) নিরাপত্তার ঝুঁকি বহু মাত্রায় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালের পুশ-ইন বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে আশ্রয় না দিয়ে যদি ২০১২ সালের মতো পুশ-ইন প্রতিহত করত, তবে সমস্যার গভীরতা এতটা জটিল হতো না। এ ছাড়া ভবিষ্যতে সমুদ্র সীমরেখার মধ্যে যখন পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের সম্ভাবনা দেখা দেবে তখন সমাধানকৃত সমুদ্রসীমা লঙ্ঘনের প্রবণতা ও প্রচেষ্টা যে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দেখা যাবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হই কী করে? এরই মধ্যে যে দুই-একবার সমুদ্রসীমা লঙ্ঘিত হয়নি তা তো নয়। অতীতে বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের সামরিক শাসক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় বৌদ্ধদের সশস্ত্র করে এবং পেছন থেকে শক্তি জুগিয়ে অমানবিক হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসহ পৃথিবীর বহু দেশে এ ব্যাপারে তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কখনো তা বিবেচনায় নেয়নি।
বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বমুখী দৃষ্টিভঙ্গির থেকে অধিক লাভবান হতে হলে স্থলপথে যোগাযোগ সম্প্রসারণই প্রত্যাশিত। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলো সমাধান করে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিবিড় কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখে সমাধানের একটা পথ খুঁজে বের করতেই হবে। প্রয়োজনে রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে আবার দৃঢ়ভাবে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে হবে। তৃতীয় কোনো দেশেরও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে চীনই হতে পারে উপযুক্ত রাষ্ট্র। প্রয়োজনে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী ভারতকেও এ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান ও সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সত্যিকারের আগ্রহ কতটুকু—সেটাই এখন দেখার বিষয়।