মো. মইনুল ইসলাম ।। খোলা বাজার২৪, বুধবার, ৮ জুন ২০১৬: নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক সরকারের যাত্রা শুরু হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় জানা যায় ও সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায়। এ প্রক্রিয়ায় জনগণের সম্মতি নিয়ে যে শাসন তারই নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একটি বিশ্বনন্দিত শাসনব্যবস্থা। তাই দেশে দেশে মানুষ গণতন্ত্র চায়। বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের চর্চা চলছে, যদিও তা এখনো পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হতে পারেনি। তবে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। নির্বাচন যেহেতু গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ, তাই যখন দেখি এ ব্যাপারে মনোনয়ন বাণিজ্য হচ্ছে, কারচুপি হচ্ছে, সহিংসতা হচ্ছে, তখন মন খারাপ হয়। বিশেষ করে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের দুটি বড় দলের মনোনয়ন পেতে উপরোক্ত নির্বাচনে আগ্রহী প্রার্থীরা বেশ টাকা খরচ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগ যেহেতু বিগত সাত বছর ধরে ক্ষমতাসীন এবং সফলতার সঙ্গে দেশ চালাচ্ছে, তাই ওই দলটির মনোনয়ন পেতেই চেয়ারম্যান প্রার্থীরা যে সবিশেষ আগ্রহী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেখা গেছে, উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারা বিভিন্ন ইউনিয়নের সম্ভাব্য উপযুক্ত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের একটি তালিকা জেলা পর্যায়ের নেতাদের পাঠান। তাঁরা এর মধ্য থেকে তাঁদের পছন্দের একটি তালিকা ঢাকায় কেন্দ্রীয় অফিসে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য পাঠিয়ে থাকেন। জোর জনরব আছে, উভয় পর্যায়েই (জেলা ও ঢাকা) চলে টাকার খেলা। পত্রিকায় দেখা গেল মুন্সীগঞ্জের এক চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন পেতে ৪০ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এমনি অভিযোগ আছে আমার এলাকায়ও। শুনলাম একজন প্রার্থী মনোনয়ন পেতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকায় ১০ লাখের মতো টাকা খরচ করেছেন। আমার পাশের একটি উপজেলা হচ্ছে মাধবপুর, সেটি হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। কোনো কোনো এলাকায় নাকি সরকারি দলের সংসদ সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
মনোনয়ন বাণিজ্য নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে শুধু কলুষিতই করে না, একে দুর্নীতিগ্রস্তও করে। এর অনেকটা শুরু হয় স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে। কিন্তু বড় ধরনের মনোনয়ন ব্যাণিজ্য হয় জাতীয় নির্বাচনে। সেখানে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয় বলে জনরব আছে। শোনা যায়, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির নির্বাচন ও মনোনয়নের দায়িত্বে ছিলেন তারেক রহমান। নারায়ণগঞ্জ জেলার এক নির্বাচনপ্রার্থী তখন দুঃখের সঙ্গে বলেন, তাঁর চেয়ে এক কোটি টাকা বেশি দিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মনোনয়নটি বাগিয়ে নেন। এর আগে তিনি ওই এলাকার বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন।
দেশে গণতন্ত্র চর্চার জন্য বিশেষভাবে দরকার অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দলগুলোর, বিশেষ করে বৃহৎ দলগুলোর সুষ্ঠু তথা সত্যিকার নির্বাচনের প্রতি আনুগত্য এবং বিশ্বাস থাকতে হবে। বড় দলগুলোকে তাই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যা যা প্রয়োজনীয় ও করণীয় সেসবকে উৎসাহিত এবং শক্তিশালী করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে সত্যিকার এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে হেরে গেলে পরাজয় মেনে নেওয়ার মানসিকতা আমাদের দেশের বড় দলগুলোর থাকতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে এটিই নিয়ম, এমনকি ভারতেও তাই। নিয়ম এ কারণে যে নির্বাচনের সব পর্যায়ে নির্বাচনী নিয়ম, আইন ও পদ্ধতি অত্যন্ত সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন করা হয়। মনোনয়ন বাণিজ্যসহ নির্বাচনকে কলুষিত ও প্রভাবান্বিত করার জন্য ভোটার, ভোটকেন্দ্র, ভোট প্রদান এবং নির্বাচন—কোনো ক্ষেত্রেই অবৈধ হস্তক্ষেপ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে থাকে না। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতে বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচন চলছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অনিয়ম ও কারচুপির কথা শোনা গেলেও সে দেশের নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা সম্পর্কে কোনো বড় ধরনের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে না। অথচ আমাদের নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে অভিযোগের অন্ত থাকে না।
শুধু নির্বাচন কমিশনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নির্বাচন কমিশনকে সবল করা এবং নির্বাচনী পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার জন্য বড় দলগুলোর আন্তরিকতার অভাবও এর জন্য কম দায়ী নয়। এটা স্পষ্টত ধরা পড়ে যখন প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের নির্বাচনকে তুলনা করি। জাতীয় নির্বাচনের মতো পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং প্রতিষ্ঠানকে ব্যর্থ ও বিপথগামী করার জন্য দায়ী কুশীলবদের একটি গোষ্ঠী এখন গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য বেজায় সোচ্চার। সুষ্ঠু ও সত্যিকার নির্বাচন অবশ্যই গণতন্ত্রের প্রাণ। জনগণও মনেপ্রাণে তা চায়। কিন্তু বড় দলগুলো তা কতটা চায়, সে ব্যাপারে জনমনে বড় ধরনের প্রশ্ন আছে। জয়ী হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, হেরে গেলে কারচুপি হয়—এ মনোভাব বড় দলগুলোকে পরিত্যাগ করতে হবে। মনোনয়ন বাণিজ্য, টাকার খেলা, গুণ্ডা-মাস্তানদের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটাতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সর্বতোভাবে শক্তিশালী করে নির্বাচনী সময়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগ বহুলাংশে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনেকটা আশা করা যায়। না হলে জাতীয় হোক আর স্থানীয় হোক নির্বাচন তামাশায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।