Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

26kফারুক উদ্দিন আহমেদ ।। খোলা বাজার২৪, রোববার, ১২ জুন ২০১৬: গত ২ জুন ২০১৬-১৭ সালের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত। মূলত ইংরেজির ছাত্র হলেও অর্থনীতি বিষয়েও তাঁর বিস্তর পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা। তাই দেশের জনগণের প্রত্যাশা মেটাতে ও নিরাশা কমাতে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বিগত বছরগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ও সদ্য বিগত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে যা পেশ করেন তার খুব একটা পরিবর্তন প্রস্তাবিত বাজেটে হয় বলে মনে হয় না। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী যেসব দিকনির্দেশনা দেন তা বাজেটে প্রতিফলিত হয় সন্দেহ নেই। প্রসংগত মনে পড়ছে আওয়ামী লীগের আরেক অর্থমন্ত্রীর কথা। দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলাম বলে সাবেক অর্থমন্ত্রী শহীদ এস এ এম এস কিবরিয়ার অনেক কথাই মনে পড়ে। তাঁর সময় দেশে একবার মূল্যস্ফীতি ১ শতাংশেরও নিচে নেমেছিল—যদিও গড়ে তা ৩-৪ শতাংশের বেশি ছিল না। আর আমার জানা মতে তিনিই ছিলেন একমাত্র অর্থমন্ত্রী, যিনি বাজেটের প্রতিটি আয়, ব্যয় ও বরাদ্দ নিজে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হিসাব ও বিচার করে স্থির করতেন।

সমগ্র জাতির দুর্ভাগ্য, তাঁর মতো বিচক্ষণ, যোগ্য ও অসাধারণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রীকে দুষ্কৃতকারীরা বোমা মেরে হত্যা করেছিল! অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিতের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের বিপরীতে সরকারের আয় হিসাব করা হয়েছে দুই লাখ ৪৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা অর্থাৎ মোট ঘাটতির পরিমাণ ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা (বিদেশি অনুদান প্রাপ্তি সাপেক্ষে)। আশা করা হয়েছে এই ঘাটতির ৫৯.৭ শতাংশ বা ৬২ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আর বাকিটা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে। অভ্যন্তরীণ আয় বলতে মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর) কর্তৃক আহরিত সম্পদকেই বোঝায়।
একটি তুলনা করলেই বোঝা যাবে এনবি আরের সামর্থ্য কতটুকু। বিগত অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী এনবি আর কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিলেন এক লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। আদায় কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পরে ২৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে আনা হয় এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায়। কিন্তু তাও অর্জিত হয়নি। তারপর এবার এনবি আরের এর টার্গেট রাখা হয়েছে দুই লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। গতবারের প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ এনবি আর এবার আরো প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব কিভাবে আদায় করবে সেটাই প্রশ্ন। অবশ্য অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এনবি আরে জনবল ও অন্যান্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু তারা সে ক্ষমতা রাষ্ট্রের স্বার্থে কতটুকু আর নিজের স্বার্থে কতটুকু ব্যবহার করবে কে জানে। অর্থমন্ত্রীও নিজেই এনবি আরের টার্গেট উচ্চাভিলাষী বলে মনে করছেন। আসলে সব টার্গেটই বাস্তবায়ন সম্ভব যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হন এবং নিজের চেয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থকে বড় করে দেখেন।
এনবি আরের এই টার্গেট থাকা সত্ত্বেও বাজেট বাস্তবায়নে (বৈদেশিক অনুদান প্রাপ্তি সাপেক্ষে) ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকার ঘাটতি মোকাবিলা করতে হবে। উল্লেখ্য, বাজেটের মোট ব্যয়ের ৭১.৩ শতাংশই জনগণের কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে আশা করা হয়েছে। বিভিন্ন কর-খাজনা বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকে এই অর্থ আদায় হবে—অথচ জনগণ বাজেটের ফলে কী সুবিধা পাবে তা অনিশ্চিত। বাজেটে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমবে বলে বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা হবে না সেটা সুনিশ্চিত। তবে যেসব পণ্যের ও সেবার দাম বাড়বে বলে বলা হয়েছে, তা যে বাড়বেই তা নিশ্চিত। তাই সাধারণ মানুষ এই বিশাল বাজেটে বিপুলভাবে উপকৃত হবে, এটা যেমন বলা যাবে না—ঠিক তেমনি এটা বলা যাবে বাজেটের যন্ত্রণা বা ট্যাক্স বৃদ্ধির যাতনা মানুষ ঠিকই পাবে।
২০১৬-১৭ সালের বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছে মোট বাজেটের ৯ শতাংশ এবং তা বৈদেশিক অনুদানের অনুমিত ১.৬ শতাংশের বাইরে। বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় এত বিপুল বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ কত সহজ হবে কে জানে। এবারের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ করার কোনো স্পষ্ট প্রস্তাব নেই। তাই বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব হয়নি, তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করা যায়। তাতে বাজেটের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে যেসব ব্যয় ধরা হয়েছে তা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে বলা মুশকিল।
২০১৬-১৭ সালের বাজেটে সম্পদের ব্যবহার বা ব্যয়ের যে হিসাব করা হয়েছে তাতে দেখা যায় শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেটের সবচেয়ে বেশি (১৫.৬%) ব্যয় করা হবে। শিক্ষা খাতে বাড়তি ব্যয় বরাদ্দের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে অনেক দিন থেকেই দাবি করা হচ্ছিল। এবার সে দাবি কিছুটা হলেও পূরণ হলো বলে মনে হয়।
এবারের বাজেটে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে তেমন কিছুই বলা হয়নি। দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা কত কেউ সঠিক বলে না, হয়তো বলতেও চাইবে না। তবে শত শত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের শাখা-প্রশাখা (উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম ইত্যাদি নানা বিদেশি নামে) থেকে প্রতিদিন পাস করা হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যে কাজ পাচ্ছে না এমনকি অনেক এমবিএ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারও যে বেকার সে খবর কি কেউ রাখে? এ জন্য দেশে অনেক শিল্প-কলকারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তথা বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন। কিন্তু সেই বিনিয়োগও আসছে না মূলত প্রতিকূল পরিবেশের জন্য। এ ক্ষেত্রে ঘাটে-ঘাটে চাঁদা—তারপর বিদ্যুৎ, গ্যাস, জমির উচ্চমূল্য। আজকাল বিদ্যুৎ কোথাও কোথাও পাওয়া গেলেও জমি দুর্মূল্য। স্থানীয় নেতা-পাতিনেতাদের সন্তুষ্ট না করে কোনো কাজে এমনকি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করাও কঠিন। ঢাকার কেন্দ্রে অবস্থিত ভিকারুননিসা নূনের মতো স্কুলে সংসদ সদস্যের যন্ত্রণার খবর জেনে মহামান্য হাইকোর্ট স্কুল কমিটি ভেঙে দিয়েছেন। দূর-দূরান্তের দুর্নীতি ও বাড়াবাড়ির খবর তো উচ্চ আদালতে দেওয়ারই লোক নেই।
অথচ ভালো স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সারা দেশে গড়ে উঠলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হতো এবং পাশাপাশি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হতো। এ সবই কোনো এক বছরের বাজেটে অফফৎবংং করা সম্ভব নয়, তা আমরা জানি। তবুও আমরা আশা করি, এসব প্রেক্ষিত বিবেচনা করেই বাজেট ব্যয়ের কথা শ্রেয়। নিজের অর্থে কাজ না করলে অর্থাৎ দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে কাজ করলে যে খুব বেশি মধু খাওয়া যায় না—এবারের বাজেটে সুদ-খাতের বরাদ্দ ১১.৭ শতাংশই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এ বছরের বিপুল ঋণ আগামী বছরে এই বরাদ্দকে আরো বাড়াতে বাধ্য করবে—আগামী বছর এটা মনে রেখেই ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া চালাতে হবে। ঋণ নিয়ে আসলে বেশি ঘি খাওয়া যায় না, এর সুদ তথা সার্ভিস চার্জ অনেক আনন্দই মাটি করে দেয়। সবশেষে এটা বলতে হয়, সাধারণ মানুষের জন্য এ বাজেটে অনেক কিছুই বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটি স্পষ্ট নয়। যদিও অতিরিক্ত ট্যাক্স ও ভ্যাট দানে বাধ্য হওয়ার তাদের কষ্ট অতি স্পষ্ট।