Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

25kড. হারুন রশীদ ।। খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন ২০১৬: বাজারে এরই মধ্যে মৌসুমি ফল উঠতে শুরু করেছে। লিচু এসে গেছে। আম-কাঁঠালও এরই মধ্যে বাজারে এসে গেছে। রাজধানীতে নানা অসুবিধার মধ্যে এই এক সুবিধা। দেশের কোথাও কোনো কিছু না পাওয়া গেলেও ঢাকায় বাঘের চোখও পাওয়া যায়। কারণ এখানে রয়েছে দেড় কোটি-দুই কোটি বা তারও বেশি মানুষের এক বিশাল বাজার। আলু-পটোল যাই হোক না কেন বাজারে এনে তোলামাত্রই তা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এমনকি ঘাস-লতাপাতাও বিক্রি হয় এই শহরে।
সুতরাং এ রকম চাহিদাসম্পন্ন বাজারে কোনো জিনিস এনে পসরা সাজিয়ে বসতে পারলেই হলো। বিক্রি হতে কতক্ষণ? এত এত মানুষ। কেউ না কেউ কিনবেই। আর মৌসুমের নতুন ফল হলে তো কথাই নেই। তাই ফল পাকুক আর না পাকুক তা বাজারে আনতে পারাটাই যেন বিরাট ব্যাপার। কারণ এতে পকেট ভারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গ্রামগঞ্জে শোনা যেত ‘ইলিশ কী আর বিলে থাকে, কিলাইলে কী কাঁঠাল পাকে’। এখন কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর দরকার হয় না। কেমিক্যাল মিশিয়েই কাঁচা আম-কাঁঠাল দিব্যি পাকিয়ে ফেলা যায়। বাইরে থেকে দেখে বুঝে ওঠার উপায় নেই। যেমন রং, তেমনি রস। কিন্তু মৌসুমের প্রথম ফল হিসেবে উচ্চ দামে কিনে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আপনার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে।
দোকানি যে কাঁঠাল ভেঙে খাইয়ে দেখিয়ে আপনাকে গছিয়ে দিল, বাসায় এনে তা আর খেতে পারবেন না। এবার জ্যৈষ্ঠের শুরুতেই এ রকম তিক্ত এক অভিজ্ঞতা হলো। পাকা কাঁঠাল বাজার থেকে কিনে আনার পর বাসায় এসে দেখা গেল তা আসলে পাকা নয়। কেমিক্যালের গুণে (নাকি দোষে) তাতে পচন ধরে নরম হয়েছে মাত্র। খাওয়ার উপায় নেই। তেতো এবং এক ধরনের বিশ্রী গন্ধ। দারুণভাবে দুঃখিত হলাম। মানুষ এতটা প্রতারক হতে পারে? রেগেমেগে দোকানে ফেরত নিয়ে যাওয়া হলো পচা কাঁঠাল। উপায়ান্তর না দেখে দোকানদার টাকা ফেরত দিল। কিন্তু এটাই তো সমাধান নয়। এ অবস্থা তো চলতেই থাকবে। কতজন আর ফেরত দিতে পারবে একবার কিনে নিয়ে?
ভেজালের সমারোহে এই রমজানে মানুষজন যে ফলফলাদি দিয়ে ইফতার করবে সেটা নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। কেননা ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ইথেফন দিয়ে পাকানো হয় ফলফলাদি। এভাবে পাকানো ফল শুধু খেতেই বিস্বাদ নয়, স্বাস্থ্যের জন্য তা মারাত্মক ঝুঁঁকিপূর্ণ। ক্যালসিয়াম কার্বাইট রাসায়নিকটি বিভিন্ন ধরনের ঝালাই ও ব্যাটারি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। অথচ এই পদার্থটিই ফল পাকানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ফলের ঝুড়ির মধ্যে কিংবা গুদামে পানিতে ভেজানো ক্যালসিয়াম কার্বাইডের টুকরো ধামাচাপা দেন। এর ফলে সৃষ্ট অ্যাসেটিলিন গ্যাসের তাপে দ্রুত ফল পাকে। চিকিৎসকদের মতে, রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পাকানো এই ফল খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে তা কিডনি ও লিভারের জন্যও ক্ষতিকর। এই রাসায়নিক ব্যবহার সম্পূর্ণ বে আইনি হলেও ফল ব্যবসায়ীরা তা করে যাচ্ছে “োর। আর এর মাসুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। লাভ ও লোভের বলি হচ্ছেন তাঁরা। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? নিয়মমাফিক এবারও হয়তো মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলবে। এতে কেমিক্যাল মেশানো কিছু আম ও অন্যান্য ফলা ধ্বংস করা হবে। হয়তো সামান্য শাস্তিও হবে। কিন্তু কিছুদিন পরই অবস্থা তথৈবচ।
দুই.
আম, কাঁঠালসহ অন্য ফলফলাদি দ্রুত পচনশীল। এ কারণে তা দ্রুত বাজারজাত না করলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা কেমিক্যাল মেশান বলে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। এ ছাড়া কিছু কেমিক্যাল আছে যেগুলো আসলে শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর সে বিষয়টিও বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। বাংলাদেশের বাস্তবতায় যানজট, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট ইত্যাদি কারণেও যথাসময়ে ফলফলাদি বাগান থেকে তুলে ট্রাকে করে ঢাকায় আনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় প্রিজারভেশনের ব্যবস্থা অপ্রতুল থাকায় মৌসুমি ফল অল্প দিনের মধ্যেই পেকে যায়। এ অবস্থা উত্তরণে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে রাসায়নিকে পাকানো ফল ধ্বংস করলেই হবে না। কারণ ভ্রাম্যমাণ আদালতের পরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আসলে ফল পাকানো ও রং সুন্দর করার জন্য কোন কোন পদার্থ মেশালে তা স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর এ ব্যাপারে ল্যাবরেটরিতে ভালোভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
ফল পাকানোর জন্য যে ইথেফন ব্যবহার করা হয় এর ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। জৈব রাসায়নিক ইথেফনকে বলা হয় প্লান্ট গ্রোথ রেগুলেটর—পিজিআর বা বৃদ্ধি সহায়ক। ১৯৯৭ সালে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা শাকসবজি ও ফলে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহারের নির্দেশনাসহ ইথেফন অনুমোদন করে।
বাংলাদেশে ২০০৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ২৬টি পিজিআর পণ্যের ব্যবহারকে অনুমোদন দেওয়া হয়। এবং বলা হয় ইথেফন ব্যবহারের ফলে কৃষকের লাভ-ক্ষতির মূল্যায়ন করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে। কিন্তু এ-সংক্রান্ত মূল্যায়ন ছাড়াই ২০০৬ সালে এই অনুমোদনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। ফলের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ইথিলিন গ্যাস তৈরি হলে ফল পাকে। ইথেফন ব্যবহারের ফলে এ গ্যাস তৈরি হয়। তবে এটা করতে হবে গাছ থেকে ফল পাড়ার আগে। অপরিপক্ব অবস্থায় ইথেফন দিলে ফলের গুণ ও স্বাদ নষ্ট হয়। তবে এর তেমন কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
ফলে মেশানো কিছু কিছু পদার্থ যে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ জন্য জেনেশুনে মানুষকে বিষপান করানোটা কোনো সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক হতে পারে না। এ জন্য ব্যবসায়ী, পাইকার ও আমদানিকারকদের বুঝতে হবে তাঁরা কী মারাত্মক অপরাধ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের মান ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সাতটি মন্ত্রণালয় কাজ করে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এখানে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজমান। কার কোন দায়িত্ব, কে কিভাবে পালন করবে সেটা নিরূপণ করতেই বেলা বয়ে যায়।
আমাদের ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর আছে। দেশে ভোক্তা অধিকার আইনও আছে। কিন্তু কোথাও এই আইনের তেমন প্রয়োগ হতে দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে তাদের তৎপরতা চোখে পড়লেও তা পর্যাপ্ত নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে দুরারোগ্য রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ভেজালমিশ্রিত খাবার খাওয়া। এ জন্য ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর লোকজনও এই ভেজালযুক্ত খাবারের বাইরে নন। কাজেই নিজেদের স্বার্থে হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাপেক্ষে ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। ভেজালবিরোধী একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সমাজের সচেতন এবং বিবেকবান মানুষদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক