মোফাজ্জল করিম ।। খোলা বাজার২৪, রবিবার, ২৬ জুন ২০১৬: আষাঢ়ে গল্প বারোমেসে ফল কলার মতো, সব সিজনেই পাওয়া যায়, তার রূপ-রস-গন্ধ সব সময়ই মোটামুটি একই রকম। খেতেও খারাপ লাগে না। আর আষাঢ়ে গল্প যদি আষাঢ় মাসেই শোনা যায় তা হলে তো নিশ্চয়ই আরো জমে ভালো। এখন আষাঢ় মাস। অতএব, এ মাসের গল্প তো আষাঢ়ে গল্পই হবে, নাকি?
একটা ১৯ বছরের তরুণ এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। সে ছাত্র ভালো। তার এইচএসসির রেজাল্টও ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে তখন হঠাৎ ঢাকার বাসা থেকে সে নিখোঁজ। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎই ছেলেটি হাওয়া হয়ে গেল। থানায় জিডি করলেন বাবা। তার দুই-তিন দিন পর পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তার ছবি দেখে মা-বাবা, ভাইবোন আকাশ থেকে পড়লেন : সাত চড়ে যে রা করে না, সেই নিরীহ গোবেচারা ছেলেটি মাদারীপুরে এক কলেজ শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ধরা পড়েছে। জনতা তাকে রামধোলাই-রহিমধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। তার সঙ্গে আরো যে দুজন আক্রমণকারী ছিল তারা মোটরসাইকেলে করে জান নিয়ে পালিয়েছে।
এ রকম একটা ‘সুশীল একটি সুবোধ বালক, যাহা পায় তাহাই খায়’ মার্কা ছেলে পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, ছাত্র-শিক্ষক সবার অগোচরে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল তা বিশ্বাসই করতে পারছিল না তার আপনজনেরা। কেসটা কী?
২.
কেসটা কী, অন্য কোনো কেসের বেলায় না হোক, অন্তত গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমের বেলায় জানার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে ও খোদ পুলিশের জবানিতে তাই মনে হয়েছে। কী কারণে, কাদের পাল্লায় পড়ে, কিসের মোহে, এ রকম সম্ভাবনাময় বাচ্চা একটা ছেলে খুনি হতে গেল তা আমরা, অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষ জানতে পারব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেশের জঙ্গি পরিস্থিতির গভীরে এই প্রথমবারের মতো যেতে সক্ষম হবে, এ রকম একটা প্রতীতি জন্মেছিল জনমনে। আদালতও এ ব্যাপারে পুলিশ বাহিনীর প্রার্থনামতো একনাগাড়ে ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন, যাতে করে ফাহিমকে যত রকম জেরা-ঝাঁটি করা যায় করে তথ্যাদি সংগ্রহ করবে তদন্তকারী সংস্থা। আর ফাহিম তো রিমান্ডের আগেই ভয়ে হোক আর নির্ভয়ে হোক কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পুলিশকে দিয়েই বসেছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে নাকি তার পাঁচ সহযোগীসহ খুনের নির্দেশদাতাদের পরিচয়ও প্রকাশ করেছিল। (সূত্র : ২০ জুনের দৈনিক কালের কণ্ঠ) আদালত নিশ্চয়ই ওই সব তথ্য ফাঁসের বিষয় জানার পরই সন্তুষ্ট হয়ে ১০ দিনের জন্য পুলিশি হেফাজত বা কাস্টডিতে পাঠিয়ে দেন ওই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেটিকে।
এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে যেকোনো মামলায়—তা চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি-খুন-ধর্ষণ-দাঙ্গা-হাঙ্গামা যাই হোক না কেন—ফৌজদারি দণ্ডবিধির আওতায় তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ আদালতের আদেশে যেকোনো আসামিকে রিমান্ডে নিতে পারে। তবে যে মুহূর্তে আসামি রিমান্ডে গেল সেই মুহূর্ত থেকে তার সার্বিক নিরাপত্তা ও আহার-নিদ্রা, বিশ্রাম-চিকিৎসা ইত্যাদির সম্পূর্ণ দায়িত্ব ওই তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের। ওই অবস্থায় যদি আসামির স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় তবে তার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে ওই কর্তৃপক্ষকে।
তা হলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যে অপরাধী তদন্তের শুরুতেই অকপটে তার সহযোগী ও নির্দেশদাতা ‘বস’দের নাম-ধাম পুলিশকে জানিয়ে দিল তার শারীরিক নিরাপত্তার জন্য পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিল কি না। কারণ সে যে পুলিশের কাছে তাদের নাম-ধাম ফাঁস করে দিয়েছে তা তার সহযোগীরা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তাব্যক্তিরা নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছিল। বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে এটা তো কোনো ব্যাপারই না। আর এ ধরনের জিজ্ঞাসাবাদে খুব যে একটা গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়, তাও না। অতএব, আরো তথ্যাদি ফাঁস হওয়ার আগে বা গোপন আস্তানা-আড্ডাখানা ইত্যাদি দেখিয়ে দেওয়ার আগে এই বিচ্ছুটিকে লিকুইডেট করাই হবে এখনো যারা মুক্ত বায়ু সেবন করছে সেসব ক্রিমিনালদের প্রথম দায়িত্ব। তা হলে পুলিশ হেফাজতে ফাহিমকে তো শুধু ভিআইপি নয়, ভিভিআইপি ট্রিটমেন্ট দিয়ে রাখা উচিত ছিল।
আমরা পত্রিকায় পড়লাম, ফাহিমকে যখন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধারের জন্য বা কোনো স্থান চিহ্নিত করার জন্য গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সঙ্গে ছিল দুই-তিন গাড়ি সশস্ত্র পুলিশ। সেটাই স্বাভাবিক। বলা তো যায় না, পথেঘাটে তদন্তকারী দল ‘অ্যামবুশ’ হতে পারে কিংবা গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর ‘সত্যিকারের’ বন্দুকযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। অতএব, আপটু দিস পয়েন্ট, পুলিশের ব্যবস্থাপনা ঠিকই ছিল দেখা যায়। কিন্তু এর পরই হিসাব ঠিক মিলছে না। বলা হচ্ছে, আচমকা আক্রমণের মুখে পড়ে যায় অভিযানে অংশগ্রহণকারী পুলিশ দল। তাদের বহনকারী দুটি গাড়ির একটিতে ছিল ফাহিম। শুরু হয় ‘বন্দুকযুদ্ধ’। দুই গাড়িভর্তি পুলিশের কেউ না, প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হয় হাতে হাতকড়া পরা ফাহিম। তার বুকে গুলি লাগে। তবে হ্যাঁ, পুলিশের একজন সদস্যও নাকি আহত হয়েছেন। তাঁর পায়ে গুলি লেগেছে। তবে সন্ত্রাসী হোক আর জঙ্গিফঙ্গি যাই হোক, শাববাশই দিতে হয় আক্রমণকারী প্রতিপক্ষের তীরন্দাজদের, তাদের হাতের নিশানার জন্য। তারা এতজন পুলিশ পরিবৃত অবস্থায় ফাহিমকেই ঠিক লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছে। যেন অলিম্পিকের সোনাজয়ী শুটার! আর গুলি খেয়ে ফাহিম যাতে ‘মোর কিস্সু হয় নাই, এই দ্যাহ মুই ঠিকই বাইচ্যা আছি’ বলে দাঁত কেলিয়ে না হাসতে পারে সে জন্যই বোধ হয় অপারেশনে যাওয়ার সময় এই ভিভিআইপিকে কোনো বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট বা লোহার হেলমেট পরানো হয়নি। ফলে অপারেশন হান্ড্রেড পারসেন্ট সাকসেসফুল! ১০ দিনের রিমান্ডের প্রথম ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই সন্ত্রাসী ফাহিম মরহুম ফাহিম হয়ে গেল। এ যেন পঞ্চাঙ্ক যাত্রাগানের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যেই নায়কের মৃত্যু ঘটিয়ে যবনিকাপাত করা হলো। দর্শকরা এখন চেয়ার ভাঙুক, ঢিল ছোড়ুক আর গালাগাল দিতে দিতে রাস্তা মাপুক, কর্তৃপক্ষের তাতে কিছু যায় আসে না। যাত্রাদলের অধিকারী মহাশয়কে কোনো নাছোড়বান্দা সাংবাদিক জেরা করতে শুরু করলে তিনি বলবেন : আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই ভাই। আমাকে আমার ‘বস’ যেভাবে পালা সাজাতে বলেছেন আমি সেভাবেই সাজিয়েছি। ‘কিন্তু অধিকারী মহাশয়, তাই বলে গত ১২-১৪ বছর ধরে রোজ রাতে একই চিত্রনাট্য চালাবেন নাকি? পাবলিক যে বহুদিন ধরে এটা খাচ্ছে না, এটা নিয়ে হাসাহাসি করছে, তাও কি আপনারা বোঝেন না? অধিকারী একটি উচ্চাঙ্গের হাসি দিয়ে বলবেন : বোঝেনই তো স্যার, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, যখন যেমন ধর্ম। হে হে হে।
৩.
ফাহিমের এই সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত ও আকস্মিক হত্যাকাণ্ড জনমনে এক হাজার একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পাবলিক যেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনের নায়ক-নায়িকা-ভিলেনদের সম্পর্কে তথ্য জানতে, সেখানে তাদের সেই আশায় ছাই দিয়ে পরদিনের খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম : রিমান্ডের আসামি ফাহিম খুন। তখনই সন্দেহের বিষবৃক্ষ ডালপালা মেলতে শুরু করে : বিষয়টা কী? যে ছেলেটি স্বেচ্ছায় কাঁড়ি কাঁড়ি তথ্যটথ্য দিতে শুরু করেছিল, হয়তো রিমান্ডের ১০ দিনে ১০ মিলিয়ন ডলারের সব প্রশ্নের উত্তর সড়সড় করে এসে যেত, তাকে হঠাৎই দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়ার মানে কী। সাম্প্রতিককালে রিমান্ডে থাকাবস্থায় খুন হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিনীতভাবে প্রস্তাব রাখতে চাই রিমান্ডের আদেশে যেন মাননীয় আদালত সুস্পষ্ট একটা লিখিত নির্দেশ দেন : রিমান্ডকালীন সময়ে পুলিশ আসামির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তাতে যদি বন্ধ হয় এই বস্তাপচা চিত্রনাট্য লেখার কাজ!
আরেকটি কথা স্পষ্টীকরণের দরকার আছে। পুলিশ বলছে তারা জনগণের বন্ধু, তারা জনগণের পাশে থেকে বন্ধুর মতো সেবা প্রদান করতে চায়। এটা তো খুবই ভালো কথা। সত্যিই তো, পুলিশ তো কোনো ‘এলিয়েন’ না আমাদের কাছে। পুলিশ তো আমাদেরই ভাই-ভাতিজা-ভাগ্নে। আমাদেরই সন্তান। তারা আমাদের বন্ধু হতে চায়, সে তো ভালো কথা। কিন্তু এই বরাভয় প্রদানের পাশাপাশি পুলিশের আচরণটিও তো নিষ্কলুষ হতে হবে। মুখে শেখ ফরিদ বগলে ইট হলে তো চলবে না। আমাদের ছেলেবেলায় দেখতাম সিলেট অঞ্চলে মায়েরা শিশুদের ভয় দেখিয়ে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করতে, দুষ্টু ছেলেকে ঘুম পাড়াতে, যখন-তখন বাড়ির বাইরে যাওয়া ঠেকাতে বলতেন, ‘মাইগগো (মাগো) খাকাই। জলদি ঘুমাও, নাইলে (না হলে) খাকাই আইব।’ সিলেট অঞ্চলে খাকাই হচ্ছে রাক্ষস-খোক্কসজাতীয় কল্পিত একটি ভয়ংকর প্রাণীর নাম, যার নাম শুনলেই বাচ্চারা ভয় পায়। এখন কি পুলিশও খাকাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে নাকি যে নাম শুনলেই লোকে বলবে মাইগগো পুলিশ! একাত্তরে মায়েরা যেমন বাচ্চাদের পাকিস্তানি আর্মির ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতেন। না, আমরা অবশ্যই এমনটি চাই না। পুলিশ ছাড়া সমাজব্যবস্থা একদণ্ডও চলতে পারে না। আমাদের সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে আমরা সব সময় চাই পুলিশ আমাদের পাশে থাকুক। আর পুলিশের সব সৎ প্রচেষ্টায় আমরাও সহযোগিতার হাত বাড়াতে চাই। কারণ যে হারে আয়-উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উল্লম্ফনের সঙ্গে বিচিত্রমুখী অপরাধ, জঘন্য অপরাধ (পুলিশের তালিকায় ইংরেজিতে যাকে বলে হেইনাস ক্রাইম)। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে বা তারও পরে আমরা যখন জেলায় বা মহকুমায় আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মাসিক সমন্বয় সভায় অপরাধের খতিয়ান পর্যালোচনা করতাম, তখন এই হেইনাস ক্রাইম বা জঘন্য অপরাধ—যেমন খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদির সংখ্যা থাকত নগণ্য, মাসে একটি কি দুটি, কোনো মাসে তাও না। মামলা-মোকদ্দমা মানে ছিল চুরি-চামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, প্রতারণা ইত্যাদি। এতেই ছিল পুলিশের ঘুম হারাম। তখন মফস্বলের একটি থানায় সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই), অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর (এএসআই), কনস্টেবল ইত্যাদি মিলিয়ে জনবল ছিল বেশি হলে ১২-১৪ জন। হাতিয়ার বলতে ছিল গোটা পাঁচ-সাতটি মাস্কেট রাইফেল (ওতে একটা একটা করে গুলি ভরতে হতো), আর পাকা বাঁশের ছোট-বড় কিছু লাঠি। ব্যস। এই দিয়েই বে আইনি সমাবেশ, মিটিং-মিছিল সবই ঠেকান দিতে হতো। প্রটোকল ডিউটি-ফিউটি ছিল না বললেই চলে। কালেভদ্রে হয়তো কোনো থানা সদরে কোনো বড় অফিসার বা মন্ত্রীটন্ত্রীর শুভাগমন হতো। তখন থানার বড়বাবু (মজার ব্যাপার, পাকিস্তান আমলেও এই ব্রিটিশ পিরিয়ডের সুপরিচিত নামটি দীর্ঘদিন চালু ছিল) অর্থাৎ ওসি সাহেব নিজে ইস্ত্রি করা ইউনিফর্ম পরে, তাঁর বাহিনীকে ফিটফাট করে গার্ড অব অনার দিতেন ভিআইপিকে। কথায় কথায় এমপি স্যার বা সরকারি দলের নেতা স্যারদের হম্বিতম্বি হাঁকডাক ছিল না। এই ছিল পুলিশ। পাবলিকের সঙ্গে ঝুট-ঝামেলা খুব একটা হতো না। আর এখন? এখন ওসি সাহেবের ‘বস’ এসপি সাহেব তো আছেনই, তবে সারাক্ষণ জ্বালিয়ে মারার মতো ‘বস’ হচ্ছেন স্থানীয় এমপি সাহেব, রাজনৈতিক আতিনেতা-পাতিনেতারা। আর আরেক জ্বালাতনের নাম টেলিফোন। মোবাইল ফোনের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে ডিসি-এসপি-ওসি-ইউএনওদের জীবন তেজপাতা করার জন্য ওই যন্ত্রটিই যথেষ্ট। আমাদের সময়ে আল্লাহ বাঁচিয়েছে অন্তত এই উপদ্রবটি ছিল না।
বলছিলাম পুলিশের জনবান্ধব হওয়ার অভিলাষের কথা। সে তো অতি উত্তম কথা। কিন্তু পুলিশ বা র্যাব যদি নিজেরাই নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে থাকে, যদি একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে তাদের কর্মকাণ্ড তা হলে বন্ধু না হয়ে তো তারা অচিরেই ‘মাইগগো খাকাই’ হয়ে যাবে।
৪.
জঙ্গি দমনে সরকার শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গী করে চললে হবে না, জঙ্গির ব্যাপারে তাদের ভঙ্গি অর্থাৎ কৌশলও একটু বদলাতে হবে। কারণ জঙ্গি তো আর রাস্তাঘাটে বুকে ব্যাজ লাগিয়ে, নিশান উড়িয়ে চলাফেরা করে না যে পুলিশ খপাখপ তাদের ধরবে, আর ব্যাগে পুরে থানায় নিয়ে যাবে। জঙ্গিরা মিশে আছে ‘জলেস্থলেঅন্তরীক্ষে’, লোকচক্ষুর আড়ালে। তাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল জনগণের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ওপর। অতএব, জঙ্গি ধরতে হলে শুধু র্যাব-পুলিশকে সঙ্গী করলে হবে না, সর্বাগ্রে চাই জনসম্পৃক্ততা, অকুণ্ঠ জনসমর্থন ও জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা। আগে মানতে হবে জঙ্গি তৎপরতা বা আইএসের উত্থান শুধু সরকারের বা সরকারি দলের সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সমস্যা। যে হারে ঝাঁকে ঝাঁকে ১৫ থেকে ৩০ বছরের নওলকিশোররা, নবীন যুবারা ওই বিভীষিকার রাজ্যে পা বাড়াচ্ছে—কিসের মোহে, কাদের প্ররোচনায় জানি না, তাতে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে মনে করি। ‘বাঘ আসিয়াছে, বাঘ আসিয়াছে’ বলে চিৎকার দিতে দিতে একদিন সত্যিকারের সুন্দরবনের মামা এসে হাজির হয়েও যেতে পারে। কাজেই এখনো সময় থাকতে সাধু সাবধান।
আর আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যেমন উপদ্রুত এলাকার মানুষ শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কখনো বলে না ‘এই তুই হাত লাগাবি না, তোর বাপ ছিল জেলখাটা কয়েদি, এই তুই ভাগ এখান থেকে, এই আশ্রয়কেন্দ্রে তোকে জায়গা দেব না, তোরা নমঃশূদ্র’, তেমনি বর্তমানের এই জাতীয় বিপর্যয় ঠেকাতে সবাইকে নিয়ে ‘ওয়্যার-ফুটিংয়ে’ কাজ করতে হবে। দেশের ৩০-৪০ ভাগ মানুষকে নানা অজুহাতে দূরে সরিয়ে রেখে, একজন আরেকজনকে দোষারোপের পুরনো ব্লেইম গেমে’ মেতে থেকে আইএস ঠেকানো যাবে না, ছেলেপুলেদের ফাহিম হয়ে ওঠা বন্ধ করা যাবে না। আর মনে রাখবেন, আজ আপনি আছেন টেবিলের এ পাশে কর্তৃত্বের আসনে, হুকুমদাতার ভূমিকায়, কাল ও পাশেও তো বসতে পারেন হুকুমবরদার হয়ে, গ্রহীতা হয়ে। গণতন্ত্র তো এরূপ শিক্ষাই দিয়ে আসছে দেশে দেশে যুগে যুগে।
আমাদের সম্মানিত আলেম সমাজ অতি জরুরি একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন সম্প্রতি। তাঁরা লক্ষাধিক স্বাক্ষরসংবলিত একটি বিবৃতি প্রদান করে দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ইসলামে জঙ্গি তৎপরতা, সামাজিক ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি ইত্যাদি হারাম। আমার ধারণা, এতে দারুণ কাজ হবে। তবে একটি বিবৃতি প্রদানের মধ্যে এর সমাপ্তি না টেনে দেশের লাখ লাখ মসজিদে প্রতি জুমায় খুত্বার সময় খতিব সাহেবরা এ বিষয়ে বক্তব্য রাখলে বোধ হয় সারা দেশের মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত বক্তব্যটি পৌঁছাতে থাকবে এবং আলোচনাটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যাবে।
৫.
আবারও বলি, আষাঢ়ে গল্পের ঝুলি বন্ধ করুন, ইতি টানুন প্রতিহিংসার রাজনীতির, আত্মঘাতী ব্লেইম-গেমের, জ্বালানো-পোড়ানো রাজনীতির; নইলে জাতির কপালে দুঃখ আছে। আর সেই দুঃখের অতল গহ্বরে কচি কোমল দূর্বাদলের মতো শিশু-কিশোরদের ঠেলে ফেলে দেওয়ার জন্য জাতির ইতিহাসে অমোচনীয় কালো কালিতে নাম লেখা থাকবে বর্তমান সময়ের আপনার-আমার মতো মুরব্বিদেরই, আর কারো নয়।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি