আলী যাকের ।। খোলা বাজার২৪, শনিবার, ৯ জুলাই ২০১৬: হঠাৎ মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আর আমার আজকাল এমন হয়েছে এই বয়সে এসে যে মন যখন খারাপ হয়ে যায় তখন তার একটা প্রভাব দেহের ওপরেও পড়ে। মনে হয় যেন শরীরটাও চলছে না। মনটা খারাপ হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ হয়তো নেই। আজকের এই বিশ্বে মানুষের গতি-প্রকৃতি যা তাতে আমাদের মতো ভাবালুতাশ্রয়ী মানুষের, ইংরেজিতে যাদের ‘ঊসড়ঃরড়হধষ’ বলা হয়, তাদের মন এখন তখন মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে খারাপ হতেই পারে—এটা গ্রহণ করে নেওয়াই বোধ হয় সংগত হবে। যেহেতু মন বলে কথা, মন সেটা নিতে চায় না। গল্পটির একটু বিস্তারে যাই।
আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কোনোকালে একসঙ্গে নাটকও করতাম। পেশায় প্রকৌশলী। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে, কী তারও বেশি হবে, চলে গেছে বিদেশ। সেদিন হঠাৎ করেই কোনো একটি প্রসঙ্গে ওই বন্ধুর একটি মন্তব্য দেখলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়। কথায় কথায় তিনি বলেছেন, এমন একটি দেশ, যে দেশে গেলেই চাপাতির কোপে গলা কেটে মাথা লুটোপুটি খাবে মাটিতে। ভয় ধাপ্পাবাজির। ভয় ছিনতাইয়ের। সে দেশে উনি জীবনেও কখনো ফেরত আসতে চান না। সেই দেশ তাঁকে ভাবিতও করে না, সেই দেশ সম্পর্কে তাঁর মনে কোনো ধরনের কোনো আকর্ষণ নেই। ফেরত আসতে চান না ভালো কথা। তাঁর এমন মন্তব্যকে সায় দিয়ে তাঁরই একজন বন্ধু লিখেছেন, ‘তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলে, তুমি যদি এ রকম চিন্তা করো, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষেরা কিভাবে ভাবতে পারি যে কোনো দিন দেশে ফিরে যাব, এমনকি বেড়াতেও? প্রতিনিয়তই যেখানে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে রাস্তার মাঝে। ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের সব সহায়-সম্পত্তি। সেই দেশ এখন আর আমাদের নয়। কথায় কথায় এমনও মন্তব্য এসেছে যে এই দেশের আজকের এই হাল, এই বেহাল কেবল এই জন্য যে এখানে গণতন্ত্র নেই, এখানে মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এবং যদিও এই দেশ চলেছে বিদেশে কর্মরত বাঙালিদের প্রেরিত অর্থে, সেই দেশে তাদের রাজনৈতিক অভিমতের কোনো স্থান নেই। তারা কখনো ফেরার কথা চিন্তা করে না।’
এ ধরনের কথা শুনে মন তো খারাপ হওয়ারই কথা। তাহলে কী কারণে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা একসময় চিন্তা করেছিলাম যে যা-ই আসে আসুক, যা-ই থাকে থাকুক কপালে, রয়ে যাব আমার এই দেশে। আমি জানি যে হয়তো বিদেশে থাকলে আপাতদৃষ্টিতে এর চেয়ে অনেক ভালো থাকতাম; কিন্তু দেশে আছি এই নিয়ে আমার মনে কোনো ধরনের অনুশোচনা নেই। আমি মনে করি যে যাদের অর্থে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজকে চলে, যারা বিদেশে আমাদের জন্য অনবরত পরিশ্রম করে অর্থ আয় করছে এবং সেটা দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে তারা; কিন্তু এই কারণে পাঠাচ্ছে যে দেশে তাদের যারা আছে তারা যেন ভালো থাকে। দেশে যেন তাদের সহায়-সম্পত্তির বৃদ্ধি হয়। এ কথা সর্বজনবিদিত যে অর্থ পাঠানো হয় কেবল সেই দেশে, যে দেশ সম্পর্কে মানুষের মনে আশা আছে। আমার বন্ধুর মতো তারা আশাহত নয়। আমি এটাও দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই যে যারা আশাহীন, যারা এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না তারা জীবনে কোনো দিন এ দেশে ফিরবে না। কিন্তু এই যে সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলো যারা তাদের সর্বস্ব বিক্রি করে ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছে, দিনের পর দিন পরিশ্রম করছে, অনবরত অর্থ পাঠাচ্ছে স্বদেশে, তারা কিন্তু কোনো না কোনোকালে দেশে ফিরে আসার জন্যই এটা করছে। তাদের মনে কিন্তু গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাদের মনে রাজনৈতিক, কী মানবাধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তারা কখনো পশ্চিমা মানুষদের মতো চিন্তা করে না। এ অবস্থায় এমন অবলীলায় কি বলে দেওয়া যায় যে এই দেশে আর ফেরত যাব না আমরা? এই কথাগুলো মনে পড়ল এ কারণে যে আমার প্রবাসী বন্ধুরা, যাঁরা দেশ নিয়ে সদা সর্বদাই চিন্তাভাবনা করেন এবং সব সময় আমাদের উপদেশ-পরামর্শ দিয়ে যান বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে, তাঁরা একটি প্রশ্ন সর্বদাই তোলেন। সেটি হচ্ছে যারা বাইরে থেকে আয় করে দেশে অর্থ প্রেরণ করছে তারা ক্রমেই আশাহত হয়ে পড়ছে এই দেখে যে আমাদের দেশে কোনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নেই। আমাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং এখানে সব বিষয়েই সরকারের এক ধরনের অগণতান্ত্রিক আচরণ দেশটিকে বিপর্যস্ত করে ফেলছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে প্রথমত, এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকারের ধারণা সবই পশ্চিমা মতবাদের অভিজ্ঞতালব্ধ। তারা যে দেশগুলোতে বাস করে তার বেশির ভাগই বস্তুতপক্ষে সিংহভাগই পশ্চিমা দেশ। যেখানে এক ধরনের নিজস্ব ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে গণতন্ত্রের চর্চা করা হয়। যেমন—গ্রেট ব্রিটেনে কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলোতে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার গণতান্ত্রিক আচরণ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে এবং তারা ইঙ্গিত করে। আর দ্বিতীয়ত, এই যে তারা সেই জনগোষ্ঠীর নয়, যারা প্রতিনিয়ত দেশে অর্থ প্রেরণ করে। তাদের আপনজনদের কাছে এবং নিজস্ব সম্পত্তি গড়ে তোলে স্বদেশেই। আমি প্রতিনিয়ত গ্রামে যাই। আমার চোখের সামনে গত ২০ বছরে আমি দেখতে পেয়েছি কেমন করে গ্রামে-গঞ্জে আস্তে আস্তে এক ধরনের উন্নয়নের ছোঁয়া সুস্পষ্ট দৃশ্যমান। আজকে বাংলাদেশের গ্রামে অতিনগণ্য কতিপয় স্থান ছাড়া কোথাও ভাঙা কুঁড়েঘরের স্থান নেই। প্রায় সবই পাকা দালান হয়ে গেছে। বাজার-হাটগুলো তৈজসপত্রে ঝকঝক করছে। রাতের বেলা যেখানে বিদ্যুৎ থাকে না সেখানেও ব্যাটারির মাধ্যমে দোকানগুলোতে বাতি জ্বলে। রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত সেসব দোকানে ব্যবসা-বাণিজ্য চলে অবলীলায়। এবং মানুষের মুখে এক ধরনের হাসি, পরিতৃপ্তি এবং আশাবাদ স্পষ্টই দেখা যায়।
দেশে গণতন্ত্রের কী পরিস্থিতি এ নিয়ে যেমন মাথাব্যথা নেই দেশের এসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের, তেমনি যারা তাদের অর্থ প্রেরণ করে বিদেশ থেকে, তাদের অতি আপনজন, তারাও কখনো প্রশ্ন করে না দেশ রাজনৈতিকভাবে অধঃপাতে কতখানি গেল। যদি তারা শঙ্কিত হতো, এই বিদেশে যারা থাকে এবং ক্রমাগত অর্থ প্রেরণ করে স্বদেশে, তাহলে আমি নিশ্চিত যে এই ক্রমবর্ধমান হারে আমাদের এখানে বৈদেশিক মুদ্রা বা ‘রেমিট্যান্স’ আসত না। আস্তে আস্তে এটা কমতে থাকত এবং আমরা হতদরিদ্র একটি দেশে পরিণত হতাম। আজ থেকে ২০, ৩০ কি ৪০ বছর আগে গ্রামবাংলার যে চেহারা ছিল আজকে তার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী বলে প্রত্যেকেই মানবে। অথচ আমার বন্ধুরা বলে চলেন, কী বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি।
স্বীকার করি যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছাড়া একটি দেশ এগোতে পারে না। এই গণতন্ত্রের প্রকার নিয়ে এখন প্রশ্ন করার সময় এসে গেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এর বিস্তারে যাওয়ার আগে একটি মন্তব্য করা আবশ্যক বলে আমি মনে করি। যাঁরা এ ধরনের উপদেশ, পরামর্শ প্রবাসে থেকে দেন তাঁরা কেউই কোনোকালে দেশে ফিরবেন না। দেশ নিয়ে তাঁদের কথাবার্তা কেবল কথাবার্তাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। দেশের কী হয় না হয় তাতে তাঁদের কিছু আসে যায় বলে আমার মনে হয় না। বিষয়টি আমি অতীতে দেখেছি, এখনো দেখছি এবং তাঁদের মতগুলো যখন আমি পড়ি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তখন এটি আরো স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। অতএব তাঁদের কথা ছাড়ান দেওয়া চলে। এবার আরেকটু বিশ্লেষণে যাই। যেই দেশের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান নিয়ে তাঁরা এসব কথা বলেন বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে, সেই দেশে গণতন্ত্রের সত্যিকার অর্থে চর্চা কতখানি হচ্ছে বা হলে সেটি সে দেশের কল্যাণে আসছে কি না সে বিষয়ে একটু ভেবে দেখা দরকার আছে। এই অতি সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটে গেল যুক্তরাজ্যে, সেটি একটি নিদর্শন হিসেবে আমরা তুলে ধরতে পারি। সেখানে ৫২ শতাংশ মানুষ বলেছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আওতাভুক্ত ব্রিটেন আর থাকতে চায় না। অতএব তা ছেড়ে দেওয়া হলো। সবাই খুব সাধুবাদ জানাল, যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা অবাধভাবে করা হয় সেই কারণে। এখন বলা হচ্ছে, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ ছাড়তে হবে এই মত সম্পর্কে যাঁরা গণভোটে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁরা ভোটারদের চরম মিথ্যা কথা বলেছিলেন। এখন নাকি ওই মতবাদের পক্ষের ভোটাররা গুগলে সার্চ করে জানার চেষ্টা করছে ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’-এর অর্থ কী? বেনো জলের তোড়ে বিপন্ন আমরা সবাই আজ। সবচেয়ে বেশি বিপন্ন বোধ হয় পশ্চিমা বিশ্ব।
গণতন্ত্রচর্চা নিয়ে আরো কথা বলার ইচ্ছা রইল পরবর্তী সময়ে।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব