Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

akm-shahnawazএ কে এম শাহনাওয়াজ ।। খোলা বাজার২৪, রোববার, ১০ জুলাই ২০১৬: বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এর সূচনা করেছেন আট শতকের বৌদ্ধ পাল রাজারা। বৌদ্ধ সহজিয়া ধারা, বিশেষ করে নাথ ধর্মচিন্তা মানবতার ধারাকেই এগিয়ে নিয়েছিল। এগারো-বারো শতকে বিদেশি সেন রাজাদের বৈরী আচরণ ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর চেষ্টা খুব একটা কাজে আসেনি। এগারো শতক থেকে মুসলমান সুফি সাধকদের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদ পরবর্তী প্রায় ৫০০ বছরব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বাংলায়। হিন্দু সমাজ থেকেও মরমি সাধক শ্রীচৈতন্যদেব বেরিয়ে আসেন নব্যবৈষ্ণব আন্দোলন নিয়ে। এভাবে সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী মানবতাবাদী ধর্ম সম্প্রদায় অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। এসব কারণেই এ দেশের সমাজে হিন্দু-মুসলমান সবার ধর্মীয় উৎসবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্পষ্ট হয়।

উনিশ শতকের ঢাকার ঈদ উৎসব এখনো টিকে থাকলে পুজোর উৎসবের পাশাপাশি তুলনামূলক আলোচনা করতে পারতে। সে যুগে অনেক আনন্দঘন ঈদ উৎসব পালন করত ঢাকাবাসী। ঈদের দিন জমকালো আনন্দ মিছিল বের হতো। অবশ্য কয়েক বছর ধরে ঢাকায় ঈদ আনন্দ মিছিল হচ্ছে। উনিশ শতকে আরমানিটোলা, ধূপখোলা বা রমনার মাঠে ঈদ উৎসবের অংশ হিসেবে কত্থক নাচের আয়োজন হতো। কোথাও হতো হিজড়া নাচ। ঘুড়ি ওড়ানো আর নৌকাবাইচের আয়োজন হতো। আর এসব অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও আনন্দ ভাগ করে নিত।
মহররমের মিছিলেও ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ ছিল। ইরাক-ইরানসহ অনেক আরব দেশে শিয়া-সুন্নি মধ্যকার দ্বন্দ্ব হানাহানির পর্যায়ে চলে যায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। আঠারো শতক থেকে ঢাকায় মহররম পালিত হচ্ছে। শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে সুন্নি মুসলমানের অংশগ্রহণ এ দেশে স্বাভাবিকই ছিল। অনেক হিন্দুও ইচ্ছা পূরণের আশায় দুলদুলের পায়ে দুধ ঢালত। আজ এক অন্ধকার শক্তি ধর্মের নামে অধর্ম করে হিংসা ঢোকাতে চাইছে। তাই দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য নষ্ট করে গত বছর হোসেনি দালানে বোমা হামলা করে রক্তাক্ত করেছিল মানবতাকে।
মুসলমান পীরের সমাধিতে হিন্দুর যাওয়া, প্রার্থনা করা এ দেশে একটি সাধারণ চিত্র। গ্রামগঞ্জের নানা জায়গায় এখনো ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার নদীতে কলার ভেলায় রঙিন কাগজের ঘর বানিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসানো হয়। এই ‘ভেলা ভাসানো’ উৎসবে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। সুন্দরবনের সঙ্গে জীবিকা জড়িয়ে আছে এমন মুসলমান বাওয়ালি, কাঠুরে বা জেলেরা বনের রক্ষাকর্ত্রী দেবী কল্পনায় বনবিবি আর ব্যাঘ্র দেবতা গাজির নাম জপ করে। অন্যদিকে হিন্দু বাওয়ালি, কাঠুরে ও জেলে একই অধিকর্ত্রী দেবী হিসেবে বনদুর্গা আর ব্যাঘ্র দেবতা হিসেবে দক্ষিণ রায়ের নাম জপ করে।
তার পরও এ সত্য মানতে হবে যে অন্ধকারের জীব যারা ধর্মকে আধ্যাত্মিকতার গাম্ভীর্য আর সৌন্দর্যে না দেখে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করে। অন্য দল অতটা বুঝে নয়, বরং সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতা ও কূপমণ্ডূকতার কারণে ধার্মিক না হয়ে এক ধরনের ধর্মান্ধ হয়ে যায়। প্রথম শ্রেণির ধর্ম বণিকদের চেনা যায়, ফলে এদের প্রতিহত করাও সম্ভব। অতি ধীরে হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষদের পক্ষে সমাজ কলুষিত করার ক্ষমতা বেশি বলে আমি মনে করি। প্রথমে তারা নিজ পরিবারকে প্রভাবিত করে, পরে প্রতিবেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।
আমার পরিচিত একজন চল্লিশোর্ধ্ব বন্ধু আক্ষেপ করছিলেন সরকারি দপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের অনেক বড় পদে ‘কেবল হিন্দু কর্মকর্তা’ নিয়োগ পাচ্ছেন। যোগ্য হলে নিয়োগ পাবেন এতে সমস্যা কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, এ দেশে বেশির ভাগ মানুষ মুসলমান, তাই মুসলমানের অধিকারটি বেশি থাকতে হবে। আমার কাছে কথাগুলো একটু বিসদৃশ লাগল। আমার চারপাশের পরিবেশে অমন করে ভাবতে দেখি না কাউকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে অমন সংকীর্ণ চিন্তা কাজ করে বলে আমার বোধ হয় না। অথচ নাগরিক পরিবেশে বাস করা, সার্টিফিকেটে শিক্ষিত এক সরকারি চাকুরে অমন করে ভাবছেন কেন! পরে মনে হলো, এই মানসিকতার মানুষগুলো পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হয়তো তেমন আলোকিত নন।
ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ ধরে রাখতে পারলে এ দেশের ধর্ম-বণিক রাজনীতিকদের অপতৎপরতা আর জঙ্গিবাদ কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য অনালোকিত জনগোষ্ঠীকে আলোতে আনতে হবে আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে। বিজ্ঞানমনস্কভাবে ধর্মচর্চা এবং বাঙালির হাজার বছরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাঠক্রমে যুক্ত করতে হবে। আর এই ঐতিহ্যের সৌন্দর্য সাধারণ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে মিডিয়াকে। আলোর প্রক্ষেপণ ছাড়া কি অন্ধকার দূরীভূত হয়!
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলাম লেখক