ড. হারুন রশীদ । খোলা বাজার২৪, রোববার, ১৭ জুলাই ২০১৬: গুলশান ট্র্যাজেডির পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে—এমন কথা সব মহল থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে। এত দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেছে বেছে একের পর এক হত্যার পর একসঙ্গে এত বড় অপারেশন চালানোর মতো সক্ষমতা অর্জন করেছে জঙ্গিরা—এটা বোধ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণার বাইরে ছিল। কিন্তু হলো তাই। গত ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ সময় তারা ১৭ জন বিদেশি, দুই বাংলাদেশি ও একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিককে হত্যা করে। এই হামলাটি গোটা বিশ্বেরই মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে তিনি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের কঠোর অবস্থানের কথাও জানিয়েছেন। জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়েছে। এবারের ঈদও ছিল বেদনায় মোড়ানো। দেশের মানুষও এই হামলার পর শোকগ্রস্ত হয়েছে। তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে এ ধরনের উগ্রবাদী তত্পরতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। হামলার প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক মহলেও। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বাংলাদেশ সফর করছেন। জঙ্গিবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা হলেও বাংলাদেশ অনেকটাই মুক্ত ছিল এ সমস্যা থেকে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী কঠোর অবস্থান এ ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের অপতত্পরতা রোধ করা যাচ্ছে না—এটা এক কঠিন বাস্তবতা। গুলশান হামলার পরও তারা বসে নেই। হামলা হয়েছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে। সেখানে পুলিশ শক্ত প্রতিরোধ গড়ায় জঙ্গিরা সুবিধা করতে পারেনি। যদিও পুলিশের প্রাণ গেছে। তবে বড় ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষা পেয়েছে দেশ। এই পরিস্থিতিতে ১৪ দল গত সোমবার শহীদ মিনারে জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশ করেছে। সেখান থেকেও উচ্চারিত হয়েছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা। কিন্তু ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ বলে একটি কথা চালু আছে। সেটিই এখন দেখা যাচ্ছে জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে। গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গি নিবরাস ইসলামসহ সাত জঙ্গি তুরস্কে প্রশিক্ষণ নিয়ে চার মাস আগে দেশে ফেরে। বিমানবন্দরে তাদের মধ্যে তিনজনকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা জামিনে বেরিয়ে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক আসামি জামিনে বেরিয়ে গেছে। অনেকেই আবার জঙ্গি তত্পরতায় লিপ্ত হয়েছে। এ বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। আইনের ফাঁক গলে কিভাবে জঙ্গিরা বের হচ্ছে সেটি দেখতে হবে। জঙ্গি তত্পরতা স্পষ্টতই রাষ্ট্রবিরোধী কাজ। ধৃত রাষ্ট্রদ্রোহীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেলে সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। আইনমন্ত্রী এ বিষয়ে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আইন-আদালত সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে আরো সতর্ক হবেন—এটাই কাম্য। কালের কণ্ঠ’রই এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ভয়ংকর ২১ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন আদালত। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও তাদের ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হচ্ছে না। ফলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাচ্ছে না। আবার আটক অনেক শীর্ষ জঙ্গি কারাগারে বসেই জঙ্গি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। এ অবস্থা আর যাই হোক জঙ্গিবাদ দমনে সহায়ক নয়। এ ছাড়া রয়েছে গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ। পুলিশের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। জঙ্গি হামলায় পুলিশের জীবন যাচ্ছে। কিন্তু তারা সেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। এ অবস্থায় নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে। জঙ্গি দমনে নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। গোড়ায় গলদ রেখে যতই ব্যবস্থা নেওয়া হোক, আখেরে তা কাজ দেবে না। অথচ এই ভয়াল সমস্যা থেকে আমাদের মুক্ত হতেই হবে। দুই. গুলশানে জঙ্গিদের নারকীয়তার পর বাংলাদেশ তো বটেই; বহির্বিশ্বও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। নানা রকম সহযোগিতার আশ্বাস আসছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তাঁর পূর্ব নির্ধারিত সফর এগিয়ে এনে অনেকটা তড়িঘড়ি বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে কারিগরি ও প্রশিক্ষণবিষয়ক সহযোগিতার কথা জানান। তাঁর দেশের এই আগ্রহ নতুন কিছু নয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অনেক দেশই বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ দমনে সহযোগিতার কথা বলে আসছে। এখন আমাদের বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। সুনির্দিষ্ট করতে হবে সহযোগিতার ক্ষেত্র। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি তত্পরতায় বহির্বিশ্বের উদ্বেগ থাকাটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে গুলশান ট্র্যাজেডিতে এতসংখ্যক বিদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনীতিসহ নানামাত্রিক আন্তসম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে। কাজেই জঙ্গিবাদ দমনে একসঙ্গে কাজ করার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে দোষের কিছু নেই। তা ছাড়া জঙ্গিবাদ এখন একক কোনো সমস্যা নয়। গোটা বিশ্বই জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবার নিচে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। তবে কথা এই যে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। কোনো বিষয়ে বৈদেশিক সহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি সবার আগে মাথায় রাখতে হবে। বিদেশি সহযোগিতার প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের জন্য যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে, সেটাই চাওয়া হবে। এখন কোন কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের সহযোগিতা আমরা পেতে পারি সেটি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনে কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে সে সহযোগিতা কার কাছ থেকে কতটুকু নেওয়া হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে নেওয়া হবে—এসব নির্ধারণ করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। অতীতে সহায়তার নামে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ায় যা হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর রয়েছে। তাই সহযোগিতা হস্তক্ষেপে রূপ নিক—এটা কিছুতেই কাম্য নয়। অন্যদিকে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহযোগিতার আগ্রহকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে কোনো কোনো দেশের অতিউৎসাহের কারণও বোধগম্য নয়। জঙ্গিবাদ বৈশ্বিক সমস্যা হলেও এমনকি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক উপর্যুপরি হামলার পরও পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায়নি, যা বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে না। এ জন্য নানামাত্রিক উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার সেটা নিচ্ছেও। একটি কথা সবাই স্বীকার করেন যে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ জঙ্গিবাদের আগাছাকে বৃক্ষে পরিণত হতে দেবে না। অতীতে অনেক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছে। জঙ্গিবাদের সংকট থেকেও বাংলাদেশ মুক্ত হবে—এই বিশ্বাস এ দেশের মানুষের মনে গভীরভাবে প্রোথিত। মানুষকে সঙ্গে নিয়েই জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ কিছু উগ্রবাদীর কাছে মাথা নোয়াতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক, [email protected]
সূত্র : দৈনিক কালেরকণ্ঠ