Wed. Aug 20th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

13kফরিদুল আলম।। খোলা বাজার২৪, সোমবার, ১৮ জুলাই ২০১৬: কার্যত রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বলিষ্ঠ ভূমিকা, নেতৃত্বের প্রতি জনসমর্থন ও দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ব্যর্থ হলো তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থান, দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে এর রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি হলেও রক্ষা পেল দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আটজন সেনাসদস্যের একটি দল হেলিকপ্টারযোগে তুরস্কের নিকটবর্তী গ্রিসে গিয়ে সে দেশে রাজনৈতিক সাহায্য প্রার্থনা করে। সংবাদটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তুরস্ক কর্তৃপক্ষ গ্রিস সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওসব সেনাসদস্যকে তুরস্কের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পালিয়ে যাওয়া সদস্যরা অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। শুক্রবার রাতে তুরস্কের সেনাবাহিনীর একটি অংশ অভ্যুত্থানের এই চেষ্টা চালায়। এ দিন স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজপথে অবস্থান নেয় সেনাবাহিনী। তারা ইস্তাম্বুলের সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থল বসফরাস ও সুলতান মেহমুদ সেতুর ওপর অবস্থান নিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। সেই সঙ্গে সিএনএন-তুর্ক টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নেয়। সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ছাড়াও আংকারার পার্লামেন্ট ভবনে শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এই অভ্যুত্থানচেষ্টা সফলভাবে দমনের মধ্য দিয়ে তুরস্কের বর্তমান সরকারের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইয়েলদিরিমের নেতৃত্বের সক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের প্রতি দেশের জনগণের আস্থার এক ধরনের প্রতিফলন দেখা গেল। অভ্যুত্থান যখন সংঘটিত হচ্ছিল প্রেসিডেন্ট তখন দেশটির সমুদ্র তীরবর্তী শহর মারমারিসে অবকাশ যাপনে ছিলেন। অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে খুব দ্রুততার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট তাঁর অবকাশস্থল থেকে মুঠোফোনের মাধ্যমে টেলিভিশন বার্তায় তাঁর নিজ দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) সমর্থকদের প্রতি রাস্তায় নেমে আসার অনুরোধ করেন। তাঁর এই অনুরোধে সাড়া দিয়ে নিজ দলের বাইরেও দেশের সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নেমে আসে। মূলত জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের সম্ভাবনা আঁচ করতে না পারাটাই অভ্যুত্থানকারীদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। এদিকে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা বিদ্রোহী এক সেনাসদস্যের শিরশ্ছেদ করেছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। টুইটারে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ছবিতে ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতুর ওপর একজন সেনার মস্তকবিহীন দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যকার বড় ধরনের এক অনৈক্যের চেহারাও ফুটে ওঠে, যা আপাত বিবেচনায় দেশের বেসামরিক সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তথা সামরিক বাহিনীর সামর্থ্য নিয়ে অভ্যন্তরীণ দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি ছাড়াও সামরিক সংস্থা ন্যাটোর অন্য সদস্যদেরও ভাবিয়ে তুলবে। এখন পর্যন্ত এই অভ্যুত্থানচেষ্টার সঙ্গে সেনাবাহিনীর মধ্যম পর্যায়ের সদস্যরা জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর রাজধানী আংকারা থেকে উত্তর-পশ্চিমে আতিনজি বিমান ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে সেনাপ্রধান হুলুসি আকারকে উদ্ধার করা হয়। অভ্যুত্থানের রাতেই অভ্যুত্থানকারীরা তাঁকে জিম্মি করেছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখতে জেনারেল উমিত দানদারকে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যিনি তাঁর অনুগত সেনাসদস্যদের নিয়ে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রদর্শন করে কার্যত বিপথগামী সেনাদের পরাজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী ইয়েলদিরিম জানিয়েছেন, এই অভ্যুত্থানচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে তিন সহস্রাধিক সেনাসদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগান কড়া ভাষায় জানিয়েছেন, জড়িতদের এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। তবে এরদোগানের এই হুঁশিয়ারি বাস্তবে পরিণত করতে হলে সবার আগে যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনীর ভেতর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজেও খুব ভালো করে জানেন কাজটি খুব সহজ নয় এবং তিনি এর আগেও একাধিকবার দেশে অভ্যুত্থানের হুমকির কথা জানিয়েছিলেন এবং সেনাবাহিনীর ভেতর কিছু শুদ্ধি অভিযানও চালিয়েছিলেন। এবার ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভ্যুত্থান চেষ্টার পর উমিত দানদারকে তুরস্কের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি পাঁচজন জেনারেল ও ২৯ জন কর্নেলকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া এই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এরদোগান সরকার দেশের বিচারব্যবস্থার বিশুদ্ধিকরণের দিকে তাত্ক্ষণিক মনোযোগ দিয়েছে ও দেশটির বিচারক ও প্রসিকিউটরদের সর্বোচ্চ কাউন্সিল অভ্যুত্থান অবসানের পরপরই দুই হাজার ৭৪৫ জন বিচারককে তাঁদের পদ থেকে অপসারণ করেছে। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ব্যাপকসংখ্যক বিচারকের চাকরি হারানোর কী সম্পর্ক রয়েছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এ মাসের ১ তারিখে তুরস্কের সংসদ বিচারব্যবস্থার সংস্কার সাধনে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা দিয়ে একটি বিল পাসের পর এই প্রথমবারের মতো বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারে হাত দিলেন এরদোগান। সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ কাউন্সিলের পাঁচজন সদস্যকেও ছাঁটাই করা হয় একই দিনে।

যদিও এখন পর্যন্ত এই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে কে বা কারা রয়েছে তা পরিষ্কার নয়, দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগান তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এর সঙ্গে দেশটির নির্বাসিত নেতা ফেতুল্লাহ গুলেন জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন। ৭৫ বছর বয়সী গুলেন একসময় বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, পরে তাতে চিড় ধরে। এরদোগান একসময় গুলেনের হিজমেত আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি দেশটির গণমাধ্যম, সমাজ, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থায় তাঁর প্রভাব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার পর রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে ১৯৯৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। তবে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের আগে সিরীয় শরণার্থীসংক্রান্ত বিষয়ে ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের যে সমঝোতা প্রক্রিয়া চলছিল বিশেষ করে জার্মানির সঙ্গে, সেই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার কোনো চেষ্টা হিসেবে এ ধরনের অভ্যুত্থানচেষ্টা করা হয়েছিল কি না সেটাও ভাবার বিষয়। গত বছর প্রায় ১০ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে জার্মানি আশ্রয় দিলেও এখন পর্যন্ত ৪০ লাখের বেশি শরণার্থী তুরস্কে বসবাস করছে, যা দেশটির সামর্থ্যের তুলনায় একটা বড় চাপ হিসেবে দেখা হয়। এর বাইরেও আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক অন্যতম কৌশলগত অংশীদার। সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য তত্পরতা বিভিন্ন সময়ে দৃশ্যমান হয়েছে। গত দুই বছরের মধ্যে দেশে একাধিকবার সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় আইএসের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দায় নিতেও দেখা গেছে। সুতরাং এখানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না সেটাও বিবেচনার বিষয়। আমরা বিভিন্ন সময় যত সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছি এর সব কটিতে দেখেছি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকে। কিন্তু এবারের ঘটনায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে এরদোগান সরকারের প্রতি তাদের অব্যাহত সমর্থন দানের কথা জানায়। তুরস্কের এই অভ্যুত্থানের ঘটনা বিশ্ববাসীর জন্য অবাক করার মতো বিষয় হলেও অতীতের ঘটনা পর্যালোচনা করলে খুব একটা অবাক হওয়ারও অবশ্য কিছু থাকবে না। তুরস্কের সেনাবাহিনীর ভেতর বিশৃঙ্খল অবস্থা নতুন নয়, নিকট অতীতেও তারা চারবার এ ধরনের চেষ্টা নিয়েছিল। ১৯৬০, ৭১, ৮০ ও ৯৭ সালেও দেশটিতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে এবারের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও ক্রমশ পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের চেষ্টা দমন করার জন্য অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন সেটা নেওয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতিই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যতে তারা এ ধরনের সম্ভাব্য হুমকি কতটুকু সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
সূত্র: কালেরকণ্ঠ