আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।। খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ২২ জুলাই ২০১৬: পশ্চিমবঙ্গের কথাশিল্পী সমরেশ মজুমদার যেমন আমার বন্ধু, তেমনি সাংবাদিক-কাম-ব্যবসায়ী সমরেশ দত্তও আমার বহুকালের বন্ধু। এককালে ভারতের পিটিআইসহ বহু সংবাদ সংস্থা ও সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। এরপর কিছুকাল লন্ডনে বসবাসের পর এখন ব্রাসেলসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। নানা ধরনের ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। তাঁর স্ত্রী রঞ্জনা দত্ত চমৎকার নজরুলসংগীত গান। আমি তাঁর কণ্ঠে বহুবার ‘শাওন রাতে যদি’ গানটি শুনেছি।
সমরেশ দত্ত লন্ডনে এলে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা হয়। এবার সপ্তাহখানেকের জন্য লন্ডনে এসেছেন। টেলিফোনে বললেন, ‘আমার হোটেলে চলে আসুন। জম্পেশ আড্ডা হবে।’ বলেছি, আমার শ্রীচরণ বাতের ব্যথায় বড়ই কাবু। হাঁটতে পারি না। আপনি আমার বাসায় চলে আসুন। আমি এখন বিপত্মীক। আপনি এলে আমার একাকিত্ব কিছুটা ঘুচবে।
সমরেশ দত্ত এলেন। তাঁর চোখেমুখে একটা উত্তেজনার ভাব। বললেন, ‘জানেন, একটা ব্যবসায়ের কাজে কলকাতা গিয়েছিলাম। ঢাকাও ঘুরে এসেছি।’ বললাম, আমার পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলো? সমরেশ বললেন, ‘নাহ্, আপনার পরিচিতজনদের কারো সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। আর আমি গিয়েছিলাম ব্যবসায়ের কাজে। আমার ব্যবসায়ী বন্ধুদের সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারিনি। এবার ঢাকায় যাওয়া মানে বাঘের গুহায় পা দেওয়া।’ আমি বলেছি, সেটা কী রকম? সমরেশ বললেন, ‘গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার দিন আমি ঢাকায়। চারদিকে আতঙ্ক, আমি তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরে এসেছি।’
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এ ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? সমরেশ দত্ত মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘পারবেন, শেখ হাসিনাই পারবেন। বাংলাদেশে যদি কেউ এই ভয়াবহ সন্ত্রাস দমন করতে পারেন, তাহলে শেখ হাসিনাই পারবেন। আর কেউ না।’ আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এ বিশ্বাসটি হলো কী করে? দত্ত বললেন, ‘এককালে সাংবাদিকতা করেছি না, আমার একটা সপ্তম ইন্দ্রিয় আছে। পরিস্থিতি বিচার করে এই ইন্দ্রিয়ই আমাকে বলেছে, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা উপমহাদেশেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শেখ হাসিনার চেয়ে যোগ্য ও সাহসী নেত্রী এখন আর কেউ নেই।’
সমরেশ দত্ত কখনো শেখ হাসিনার রাজনীতির অনুরাগী ছিলেন না। সুতরাং তাঁর মুখে হঠাৎ হাসিনাস্তুতি শুনে একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। বলেছি, আপনার মনে সহসা এ ধরনের ধারণা কেন জন্মাল তা একটু খুলে বলুন। সমরেশ দত্ত বললেন, ‘এখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশেষ করে উপমহাদেশের অবস্থার দিকে একটু তাকান। তাহলেই আমার মতো সিদ্ধান্তে আপনি পৌঁছবেন। ইতিহাস বলে চিরকাল বাংলাদেশই ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। ভবিষ্যতেও করবে।’
দত্ত তাঁর কথার একটু ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, ‘আগের ইতিহাসে যাব না, সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকেই বলছি। ভারতবর্ষের মাটিতে ইংরেজরা দাঁত বসাতে পারেনি পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাবকে পরাজিত না করা পর্যন্ত। আবার ইংরেজের রাজত্ব উচ্ছেদের জন্য সংঘবদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলন তথা অনুশীলন ও যুগান্তর গ্রুপের তৎপরতা শুরু হয়েছিল বাংলার মাটি থেকেই। উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের জন্য গান্ধী-নেহরু আন্দোলন করেছেন; কিন্তু অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছেন বাংলার সুভাষচন্দ্র। তিনি যুদ্ধে সফল হননি; কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি ধ্বংস করেছেন।’
দত্ত বললেন, “আপনাকে আরো সাম্প্রতিক কিছু উদাহরণ দেব। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ যদি বাংলাদেশে ‘ম্যাসিভ ভিক্টোরি’ অর্জন না করত, তাহলে পাকিস্তানের সৃষ্টি কিংবা ভারত ভাগ হতো না। সেই নির্বাচনে অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ, যেমন পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশেও মুসলিম লীগ সাফল্য দেখাতে পারেনি। সুভাষের পর অস্ত্র ধারণ করে স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন বাংলার শেখ মুজিব। এবং তিনি সফল হয়েছেন। অতীতে বাংলার নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর যেমন ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছিল, বর্তমানেও তেমনি ১৯৭৫ সালে বাংলায় মুজিব সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরই মার্কিন আধিপত্যবাদ গোটা উপমহাদেশে তার থাবা বিস্তার করতে পেরেছে। মুজিব হত্যার পর একে একে ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়।”
দত্ত এখানেই থামলেন না; বললেন, আরো একটা ব্যাপার লক্ষ করুন, বর্তমানের যে ইসলামী জঙ্গি সন্ত্রাস, তার লালনপালন সব ইউরোপ ও আমেরিকার মাটিতে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনিকে আশ্রয় দিয়েছিল ফ্রান্স। তিনি ১৪ বছর প্যারিসে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন এবং সেখানে বসেই ইরানের শাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালালে ইমাম খোমেনি বিরাট জয়োল্লাসের মধ্যে দেশে ফিরে যান।
অনুরূপভাবে ইসলামী জঙ্গি সন্ত্রাসের আদি সংগঠক ওসামা বিন লাদেন দীর্ঘকাল আমেরিকায় আশ্রিত ছিলেন এবং পরিবারের সঙ্গে তেলের ব্যবসায়ে অংশীদার ছিলেন। নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জন্য তাঁকে দায়ী করা হলে তিনি আমেরিকা ছেড়ে পালান। আমেরিকাই পরে তাঁকে হত্যা করে। বর্তমানেও দেখা গেছে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সন্ত্রাসী হামলার জন্য প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যে কট্টর ইসলামপন্থী মোল্লা ফতেহুল্লাহ গোলেন ও তাঁর জঙ্গি অনুসারীদের দায়ী করেছেন, সেই গোলেন এখন বাস করছেন আমেরিকায় এবং আমেরিকায় নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন। আইএসের জন্ম, তাকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করার পেছনে আমেরিকা, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলেও চলে। এখন লাদেনের মতো এই আইএস বধের জন্য পশ্চিমা শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ব্যস্ত।
সমরেশ দত্ত এই বলে তাঁর বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটালেন যে এই সন্ত্রাসকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে আমেরিকা চেয়েছে তার নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা বিশ্বে তার একক আধিপত্য কায়েম রাখতে, তা হয়নি। বরং আমেরিকায় পালিত বাঘ এখন প্রভুর রক্ত পান করতে চায়। এই বিশ্ব-সন্ত্রাসের ছায়ায় উপমহাদেশেও হোমগ্রোন সন্ত্রাস গজিয়ে উঠেছে। আমেরিকা উপমহাদেশের এই হোমগ্রোন সন্ত্রাসকে আইএসের সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করে দেখিয়ে উপমহাদেশেও তার হস্তক্ষেপ ঘটাতে চায়। আর এখানেই শেখ হাসিনা সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমাদের সর্বশেষ আশা। এটা কোনো স্তুতিবাক্য নয়। বাস্তবতার স্বীকৃতি।
তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এমনটা কেন ভাবছেন? সমরেশ বললেন, ‘আপনি উপমহাদেশের বাস্তব অবস্থার দিকে একবার তাকান। উপমহাদেশে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের সবচেয়ে বড় দুর্গ ভারত। সেই ভারতে আজ গান্ধী-নেহরু উপেক্ষিত। কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত। হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ব্যক্তিগত দূরদর্শিতা ও বাস্তবতাবোধ থেকে গণতান্ত্রিক ভারতের লিগ্যাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের দাপটের মুখে কত দিন তা পারবেন তা সন্দেহের বিষয়। পাকিস্তানের তালেবানরা ক্ষমতায় আসতে পারেনি। কিন্তু সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল এখনো মুসলিম লীগ নামধারী সাম্প্রদায়িক দল। তার তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার মার্কিন সৈন্যদের পাহারা ও সমর্থনে টিকে আছে। সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের রক্তচক্ষু এড়িয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় এগোতে পারছেন না। অন্যদিকে ভারত ও চীনের স্নায়ুযুদ্ধের (Cold war) হাওয়াও ছড়িয়ে পড়েছে সারা উপমহাদেশে। এই মুহূর্তে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নিভু নিভু বাতি একমাত্র বাংলাদেশেই জ্বলছে। চারদিকের প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাসের মধ্যে শেখ হাসিনাই অসীম সাহসে সেই বাতি আগলে বসে আছেন। তাঁর সরকারের ভালোমন্দের বিচারে আমি যাচ্ছি না। আমার কথা, উপমহাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের কথা বলে এমন একটি দল এখনো ক্ষমতায়। এবং তার নেত্রী নিজের জীবন বাজি রেখে তা রক্ষা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে অতীতের মতো সারা উপমহাদেশে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। আর তিনি সফল হলে বাংলাদেশ সারা উপমহাদেশকে সন্ত্রাসমুক্ত হওয়ার পথ প্রদর্শন করবে। অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বাংলাই ভারতবর্ষকে পথ দেখাবে।
সমরেশ দত্তের বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি সহমত প্রকাশ করেছি। আমার সাম্প্রতিক অনেক লেখায় এই একই কথা আমি বহুবার লিখেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের সন্ত্রাস হোমগ্রোন টেররিজম। মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী জঙ্গিদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ ঘটাতে পারে; কিন্তু তাদের এজেন্ডা আলাদা। একাত্তরের দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের দল, সমর্থক ও তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা এই সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত। তাই উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবককেও এই বর্বর সন্ত্রাসে যুক্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে।
দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে (যার মৃত্যুদণ্ডাদেশ এখন রিভিউ হচ্ছে) মীর কাসেম আলী সবচেয়ে বেশি অর্থশালী। তার দণ্ড বানচাল করার জন্য দুই হাতে অর্থ ঢেলে এই সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। কভার আইএস, কভার মার্কিন প্রোপাগান্ডা। এই সন্ত্রাস মোকাবিলায় হাসিনা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং বাইরের সাহায্য ছাড়াই তাতে সফল হবেন—এ বিশ্বাস অনেকের মতো আমারও আছে। আমাদের সুধীসমাজের পছন্দের ড. কামাল হোসেন বা ড. ইউনূস যদি আজ বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকতেন তাহলে কী হতো? ইরানের মোল্লাদের ভয়ে প্রেসিডেন্ট বনি সদর যেমন বোরকা পরে নারীবেশে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরাও সম্ভবত তা-ই করতেন। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ডদানের কাজটি যেমন শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারো পক্ষে করা সম্ভব ছিল না, আজকের সন্ত্রাস দমনও শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পারলে শেখ হাসিনাই তা পারবেন। আর কারো পক্ষে তা যে সম্ভব নয়, এটা কোনো স্তুতিবাক্য নয়। বর্তমানের বাস্তবতা।