Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

19kগাজীউল হাসান খান । খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০১৬: সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী দেশ তুরস্ক সাম্প্রতিক সময়ে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এক চরম জটিল অবস্থা পার করছে। ন্যাটো সামরিক জোটের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ তুরস্ক তার নিজস্ব সামরিক বাহিনীর কাছে বর্তমান নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ও গণতান্ত্রিক কাঠামো হারাতে বসেছিল প্রায় আকস্মিকভাবেই। ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বিভক্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিশেষ করে সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ দেশ ইতিহাসের বহু বিচিত্র ঘটনার অভিজ্ঞতায় লালিত। দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক তুরস্কের অন্যতম প্রধান স্থপতি কামাল আতার্তুক যেভাবে তাঁর দেশকে গড়ে তুলে আবার অতীতের প্রাধান্য ও শৌর্যবীর্য ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, তা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে মূলত সামরিক অভ্যুত্থান বা হস্তক্ষেপের কারণেই।

একদিকে দেশব্যাপী আপামর জনগণের ইসলামী মূল্যবোধ, অন্যদিকে বিশ্ব যুদ্ধোত্তর সামরিক বাহিনীর পশ্চিমা আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বহাল রাখার দ্বন্দ্বে গত প্রায় সাত দশকে পাঁচটি সামরিক অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়েছে তুরস্ক। কিন্তু একেপি নামে পরিচিত জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতা এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান তার অবসান ঘটিয়ে একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তুরস্ককে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই ইসলামী আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিংবা তার মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে নয়। সে কারণেই দেশের সামরিক বাহিনীর একাংশ, যারা এখনো নিজেদের তুরস্কের শাসনতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে অভিভাবক মনে করে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আবার পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করতে চায়, তারা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে চলে যায়। তারা মনে করে, এরদোয়ান প্রকৃতপক্ষে ইসলামপন্থী ও রাজনীতিতে সার্বিকভাবে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যতই বিরোধিতার সম্মুখীন হন না কেন, একজন দূরদৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিক হিসেবে এরই মধ্যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন লাভে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তুরস্কের ইউরোপীয় নগরী ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে প্রথম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এবং পর্যায়ক্রমে দেশে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের পদ অলংকৃত করেছেন।
কামাল আতাতুর্কের পর এরদোয়ানকেই আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণ মূল্যায়ন করে। তিনি দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থিত রাজনৈতিক দল একেপির প্রধান হিসেবে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের চাহিদা ও তাদের মূল্যবোধ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ বলেই বিগত বছরগুলোতে বারবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে সমর্থ হয়েছেন বলে তথ্যাভিজ্ঞ মানুষের ধারণা। কিন্তু তাঁর এবারের দ্বন্দ্ব অর্থাৎ ১৬ জুলাই সংঘটিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা ও সহযোগী শক্তির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী সেনা সদস্যদের বিশেষ সম্পর্ক নেই বলে অনেকে মনে করেন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে রয়েছেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যে বসবাসকারী তুর্কি ইসলামপন্থী নেতা ও ধর্মপ্রচারক ফেতুল্লাহ গুলেন। তুরস্কের সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, শিক্ষা বিভাগ ও ব্যবসায়ী মহলে রয়েছে গুলেনের বিরাট প্রভাব ও সমর্থন। প্রথাগতভাবে প্রকাশ্যে তুরস্কে তাঁর নেতৃত্বাধীন বিশাল কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তাঁর সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীরা কাজ করেন অনেকটা গোপনে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তাঁর রয়েছে অসংখ্য সমর্থক ও তাঁর মতবাদে বিশ্বাসী অগণিত মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকারসহ সিআইএ এবং অন্যান্য আমেরিকান প্রতিষ্ঠানে তাঁর রয়েছে অগণিত ভক্ত ও অনুসারী। সে কারণেই গুলেনকে বলা হয় ‘মুকুটহীন সম্রাট’।
১৯৯৯ সালে একটি ভিডিওতে গুলেনের মতাদর্শ জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। অটোমান শাসনামলে তাঁদের বিশাল সাম্রাজ্যে অগণিত মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায় অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে। অটোমান শাসকরা ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও মুসলিম হলেও ধর্মীয় দিক থেকে যথেষ্ট সহনশীল। তাঁরা সবাইকে ন্যায্য অধিকার দিয়েছেন। সে কারণেই অটোমান সাম্রাজ্য ৬০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ইস্তাম্বুল থেকে তাঁরা সমগ্র আরব উপদ্বীপ, গ্রেকো-রোমান, রুশ ও পারসিক সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চলে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গুলেনের মতে, সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে তুর্কিদের এখন বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু গুলেনের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তাঁর নির্দেশ হচ্ছে, নীরবে অর্থাৎ অপ্রকাশ্যে কাজ করে যেকোনো দেশের শাসন পদ্ধতিসহ সর্বত্র শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়তে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ পরিপক্বতা ও সঠিক সময় না আসে। তার পরই সার্বিক ক্ষমতা করায়ত্ত করতে হবে। তবে তাঁর রণনীতি কিংবা কৌশলের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থান রয়েছ কি না, তা তিনি প্রকাশ্যে না বলে চাতুরী করে এড়িয়ে গেছেন। তিনি অত্যন্ত কৌশল ও গোপনীয়তার সঙ্গে সাংগঠনিক কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। ‘নতুবা ক্ষমতার লড়াইয়ে, বিবদমান বিশ্ব আমাদের ধ্বংস করে দেবে। তাতে মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী দুর্ভোগ পোহাবে। ১৯৮২ সালে আলজেরিয়া এবং পরে মিসর ও সিরিয়ায় যা ঘটেছে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।’ তাই বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না পরিস্থিতি ও পরিবেশ তাঁদের অনুকূলে আসে। গুলেন বলেছেন, এ কাজে প্রথম তুরস্কের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ ব্যাপারে গোপনীয়তা সম্পূর্ণভাবে বজায় রাখতে হবে বলে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। তার পরও গুলেনকে আইনি লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা থেকে তিনি ২০০৮ সালে অব্যাহতি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। সে কারণেই অর্থাৎ তুরস্কের সামরিক অভ্যুত্থানে গোপনে ইন্ধন জোগানোর দায়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গুলেনকে বিচারের জন্য তুরস্কে ফেরত পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে গুলেন কোনোভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করলেও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ ব্যাপারে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে জরুরি ভিত্তিতে পাঠিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও গুলেন উভয়েই সুন্নি মুসলিমদের মতাদর্শে বিশ্বাস করলেও গুলেন ও তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, এরদোয়ান তুরস্কের জনগণকে তাদের কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজের হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করছেন। তাতে মানবাধিকার ও তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে। তারা এরদোয়ানের রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। তাই তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য চূড়ান্ত আঘাত হানার উদ্যোগ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তাদের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অতীতে এরদোয়ান প্রথমে তুর্কি সামরিক বাহিনীর প্রচুর উচ্চপদস্থ অফিসারকে বিচারের সম্মুখীন করেছেন, জেল দিয়েছেন এবং কর্মচ্যুত করেছেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাঁর একেপি দলের নেতা-কর্মীদের দিন দিন চরম ইসলামপন্থী হিসেবে পরিণত করছেন বলে গুলেনের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা অভিযোগ করেছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও তাঁর একেপি দলের নেতাকর্মীদের মতে, গুলেন ও তাঁর দলের সদস্যরা সামরিক ও অসামরিক শক্তির সমন্বয়ে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে চান। গুলেনপন্থীরা সামরিক বাহিনী, বিচার ও শিক্ষা বিভাগ এবং গণমাধ্যমকে জনগণের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে গোপন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে খেপিয়ে তুলেছেন। তাঁরা ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবাধিকারের নামে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। সে জন্য প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলসহ অন্যান্য নগরীতে বেশ কয়েকটি গুলেনপন্থী পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানানো হয়েছে। গুলেনপন্থী সেসব পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রে গুলেনের প্রতিষ্ঠিত প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য প্রভাবশালী স্থাপনা রয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে গুলেনপন্থী তুর্কি ব্যবসায়ীরা বিশাল পরিমাণ অর্থলগ্নি করেছেন বলে জানা গেছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুল, আংকারাসহ বিভিন্ন নগরীতে গুলেনপন্থীদের নিজস্ব পত্রপত্রিকা (দৈনিক মিল্লাত)সহ টিভি চ্যানেল এখনো কার্যকর রয়েছে বলে জানা গেছে। বিচার বিভাগে বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে প্রচুর শিক্ষক, অধ্যাপক ও ডিন, সামরিক ও পুলিশ বাহিনীতে অসংখ্য উচ্চপদস্থ গুলেনপন্থী প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন বলে জানা গেছে।
গোপনভাবে পরিচালিত গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ৬০০ সামরিক কর্মকর্তার একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার মধ্য থেকে অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে অসফল অভিযানে ধরা পড়েছেন বলে জানা গেছে। সে কারণেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষাবিদ, বিচারক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যম কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আটক অথবা আপাতত দায়দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার জায়েদ রাদ আল-হোসেন এ ব্যাপারে যথেষ্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ে সংঘটিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুরস্কে তিন মাসব্যাপী এক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্যারিস ও ব্রাসেলসে জরুরি অবস্থা ঘোষণার যৌক্তিকতার কথা উল্লেখ করে আংকারার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
তিনি বলেছেন, তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে ২০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং হাজার হাজার আহত হয়েছেন। দেশের প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে এবং এমনকি জঙ্গি বিমান থেকে আকাশে তাঁর (এরদোয়ানের) বিমানে আঘাত হানার চেষ্টা করেছে গুলেনপন্থী বিদ্রোহীরা। যদিও তুরস্কে চূড়ান্ত সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই, তবুও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সাম্প্রতিক সময়ে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের দায়ে সে ব্যবস্থাই নিতে যাচ্ছেন বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। তাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কী বলবে তার জন্য তুর্কি প্রেসিডেন্টের কোনো পরোয়া নেই। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের জন্য সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। সুতরাং ইইউ এ ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেবে, তাতে তুরস্কের কিছুই আসে-যায় না। কারণ তুরস্ক ইইউর সদস্যপদ কবে পাবে, তা এখনো কেউ বলতে পারে না। সুতরাং তুরস্কে আগে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হবে। তারপর সদস্যপদের প্রশ্ন। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সুন্নি মতাবলম্বী মুসলিম। তারা কোনো প্রশ্নেই তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে ত্যাগ করবে না। অন্যদিকে তারা চায়, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জনগণের নির্বাচিত একটি সরকার। এ অবস্থায় গুলেন ও তাঁর অনুসারীদের অসাংবিধানিক, গোপন ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কর্মকাণ্ডকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ করতে হবে বলে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান পরিষ্কারভাবে তাঁর মত প্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান সরকারের সামনে সে সুযোগ এনে দিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বর্তমান অবস্থায় ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে ফেতুল্লাহ গুলেনকে নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কে এই গুলেন? তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের আগে কয়জন তাঁর নাম শুনেছে? সে যাই হোক, তুরস্কের ঘরে ঘরে তাঁর নাম পরিচিত। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষা (স্কুল) ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট এক বিতর্কে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ ফেতুল্লাহ গুলেনের ওপর কয়েক বছর আগে এক চমকপ্রদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালেই আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। গুলেনের জীবন, তাঁর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শ এবং সর্বোপরি তুরস্কে তাঁর অনুসারীদের বিভিন্ন গোপন কর্মকাণ্ড আমাকে গুলেন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে অত্যন্ত আগ্রহী করে তোলে। গুলেন কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী নন অথচ গোপনে সংগঠন (আন্ডার গ্রাউন্ড) পরিচালনার পক্ষপাতী। তিনি সুন্নি মতাবলম্বী মুসলিম, তবে ধর্মীয় দিক থেকে অত্যন্ত সহনশীল মনোভাবের, যা অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষতার শামিল। তিনি মানবাধিকারে বিশ্বাস করেন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিক থেকে বেশ উদার বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর অনুসারীরা।
তবে গুলেন পারস্যের শিয়া মতাবলম্বীদের সম্পূর্ণ বিরোধী এবং তুরস্কে তুর্কিদের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন ‘পিকেকে’-এর ব্যাপারে অত্যন্ত মারমুখী। এ ক্ষেত্রে তিনি অনেকটা তুর্কি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তুরস্ককে ভাগ করা যাবে না। প্রয়োজন হলে পিকেকে-এর সঙ্গে জড়িত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। গত রমজানের প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগে টার্কিশ এয়ারলাইনসের বিমানে করে ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে আমি লন্ডনে যাচ্ছিলাম। ইস্তাম্বুলে দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি থাকায় টার্কিশ এয়ারলাইনসের বিশেষ সুবিধাভোগী যাত্রীদের ক্লাবে গিয়েছিলাম তুর্কি কফিসহ কিছু স্ন্যাকসের জন্য। কাকতালীয়ভাবে সেখানে এক তুর্কি ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাঁর নাম মেহমেত গুলেন। তিনিও লন্ডনগামী যাত্রী। পরিচিত হয়ে অত্যন্ত কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি বিখ্যাত ফেতুল্লাহ গুলেনের কোনো আত্মীয় কি না? এক গাল হেসে জানালেন, না, কোনো সম্পর্ক নেই তাঁদের মধ্যে। তবে তিনিও কৃষ্ণসাগরের পূর্ব প্রান্তের বাসিন্দা। কথাবার্তার একপর্যায়ে সাংবাদিকসুলভ অভ্যাসবশত তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসলাম, তুরস্কে এখন ফেতুল্লাহ গুলেনের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব কেমন? প্রশ্ন শুনে তিনি কিছুটা চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালেন। তারপর নিচু গলায় উত্তর দিলেন, ‘বলেন কী? গুলেনপন্থীরা এখন তুরস্কের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি। তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে বাইরের পৃথিবীর কোনো ধারণা নেই। এর বড় কারণ হচ্ছে, তাদের সংগঠনের সব কিছুই গোপনীয়তার সঙ্গে পরিচালিত হয়। তাই কে গুলেনপন্থী, আর কে নয়—তা বোঝার কোনো উপায় নেই।’
তুরস্কে গুলেন আন্দোলন মূলত তাঁর (গুলেনের) আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু সাঈদ নুরসির ভাবাদর্শ থেকে সূচিত হয়েছিল। নুরসি ছিলেন একজন সুফি ঘরানার সুন্নি মুসলমান। অটোমান খেলাফতের শেষ ও তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের শুরুতে (১৮৭৮-১৯৬০) এই আধ্যাত্মিক ধর্মীয় নেতা ‘রাইসেল-ই-নূর’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এর আরেক নাম ছিল ‘নূরকু আন্দোলন’। কখনো কখনো সরকার অতীতে এ আন্দোলন নিষিদ্ধ করলেও ‘স্টাডি সার্কেল’ হিসেবে অনুসারীরা সে আন্দোলন চালিয়ে যায়। পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ভাবিত বলে উল্লিখিত এই ‘রাইসেল-ই-নূর’ ভাবাদর্শ নিষিদ্ধ অবস্থায় তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘স্টাডি সার্কেলের’ মাধ্যমে চর্চা করা হতো। পরে তা সমগ্র আনাতোলিয়া বা তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তখন তা কামাল আতাতুর্কের আধুনিকায়ন বা পাশ্চাত্যমুখিতার বিরুদ্ধে ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে কাজ করে। এ আন্দোলন মৌলবাদী কিংবা চরমপন্থী নয়; কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে। এক সময়োচিত চিন্তাশীল পদক্ষেপ নুরসির ভাবধারায় ফুটে উঠেছিল বলে উল্লেখ করা হয়। গুলেন আন্দোলন মূলত নুরসির পাঠক সার্কেল থেকেই উদ্ভব ঘটেছে বলে জানা যায়। তুরস্কের পূর্ব প্রান্তে ১৯৪১ সালে গুলেনের জন্ম হয়েছিল। ধর্মান্ধতা কিংবা ধর্মহীনতা নয়, গুলেন প্রকৃত ইসলামের আলোকে তুরস্ক থেকে সমগ্র বিশ্বে তাঁর সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মতবাদ ছড়িয়ে দিতে গোপনীয়তার সঙ্গে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে তুরস্কে একটি নির্বাচিত সরকার উৎখাতের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানে ম“ দেওয়ার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করতে পারলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড প্রায় অবশ্যম্ভাবী।
লন্ডন, ২৩ জুলাই ২০১৬
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক