Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

19kএমাজউদ্দীন আহমদ । খোলা বাজার২৪, শনিবার, ৩০ জুলাই ২০১৬: অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত হলো সমাজে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের পূর্বশর্ত হলো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সহিষ্ণুতা ও আপসকামী এক পরিবেশ। যে ১০টি দেশের কথা বিশ্বব্যাংক উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করছে তাদের দিকে তাকালেই এর উত্তর মিলবে। তাইওয়ানের মতো একটি ক্ষুদ্র জনপদ এদিকে চোখ রেখে সৃষ্টি করেছে এই অবিশ্বাস্য ইতিহাস। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বিশ্বজয়ের প্রত্যয় লাভ করেছে। ওসব রাষ্ট্রে রয়েছে নানা দল। রয়েছে হাজারো মতপার্থক্য। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বিদ্যমান রয়েছে জাতীয় অগ্রগতি অর্জনের সাধারণ লক্ষ্য। ইন্দোনেশিয়ার মতো এককালের অনগ্রসর রাষ্ট্র প্রথমে জয় করেছে নিজের দুর্বলতা। তারপর অগ্রসর হচ্ছে দ্রুতগতিতে এক বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার অভিযানে। অতীত নিয়ে টানাহেঁচড়ার প্রতিযোগিতা নেই এসব সমাজে। অতীতকে তারা গ্রহণ করেছে সবার অর্জন অথবা সবার ব্যর্থতার সমষ্টিরূপে। এটি কারো পৈতৃক সম্পত্তি নয়। বর্তমানকে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদ বা বিতর্কে অবতীর্ণ হলেও ভবিষ্যেক গ্রহণ করেছে জাতির অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে। এই লক্ষ্যে সবাই একমত। দলমত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তাই সাহসী যোদ্ধার পদতলে বিজয় যেমন আছড়ে পড়ে ধন্য হয়, মাত্র পাঁচ দশকে ইন্দোনেশিয়া বা চীনের মতো আলাদা জনপদ অথবা তাইওয়ান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ছোটখাটো সনাতন সমাজ আধুনিকতার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। থাইল্যান্ডের বিভক্ত সমাজেও গড়ে উঠেছে ইস্পাতকঠিন ঐক্য।

এসব রাষ্ট্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা হলো অগ্রগতির অভিযাত্রায় নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে, কারো কাছে মাথা নিচু না করে, জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখার উদগ্র আকাক্সক্ষায় প্রথমে অতি ধীরে, পরে দ্রুততালে পথচলার দৃঢ়সংকল্প। তাইওয়ান চীনের মতো বৃহৎ শক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে ধীরস্থিরভাবে। দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া মোকাবিলা করছে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রচণ্ড চাপ অত্যন্ত শান্তভাবে। ফ্রান্স, জাপান, জার্মানির ইতিহাস সবার জানা। কেউ কারো জঠরে বন্দি হয়ে নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তি লাভে আগ্রহী নয়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বময় রাজত্ব করেছে। এখনো করতে চায়। চীন কারো চেয়ে কম নয়। ভারতের মাথায় রয়েছে গান্ধী-নেহরুর লালিত স্বপ্নের ডালি। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতবর্ষের অশোকচক্র। আর বাংলাদেশ? ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্নবিহীন বাংলাদেশ অতীতকে নিয়ে বিতর্কের ধূলিঝড়ে বিভ্রান্ত।
আগামী দিনে বাংলাদেশের আর কিছু না থাকলেও তার রয়েছে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান, চীন-ভারতের মাঝামাঝি অবস্থানে, থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়ার অনতিদূরে, পূর্ব ও পশ্চিমের সন্ধিস্থলে ভূ-রাজনৈতিক ‘লোকেশনে’ যা কোনো বৃহৎ শক্তি, যদি বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় নিজের ঘরের চাবি অন্য কারো হাতে তুলে না দেয়, না পারবে গিলতে, না পারবে ফেলতে। এই অবস্থানের সঠিক সুযোগ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন শুধু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনার দৃঢ়সংকল্প এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বর্তমানকে ক্রমবর্ধমান জাতীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্র হিসেবে সুসজ্জিত করা। ১৯৯২-৯৫ সালে সবার অলক্ষে বাংলাদেশ ‘উদীয়মান ব্যাঘ্রের’ প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। সচেতন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ আর কিছু করতে না পারলেও রোগব্যাধি, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার ওপর বিজয় অর্জনে সক্ষম হবে, যদি, আবারও বলছি, বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে টিকে থাকার সংকল্পে দৃঢ় থাকে এবং আগামী দিনের জন্য নিজেকে তৈরি করতে সংকল্পবদ্ধ হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো তৈরি হয়েছে মাত্র। বহুদলীয় ব্যবস্থা, সাময়িক নির্বাচন, নির্বাচনে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ভোটাধিকারসহ সরকারি পর্যায়ে জাতীয় সংসদ, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, স্বাধীন সংবাদপত্র, নির্বাচিত নির্বাহী কর্মকর্তা—এসবই এই কাঠামোর অংশ। এই কাঠামোয় কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাণের স্পন্দন স্ফুরিত হয়নি। এই কাঠামোয় রক্তমাংস সংযোজিত হয়ে তাকে প্রাণবন্ত করেনি। করেনি বিন্দুমাত্র গতিশীল। তাই যারাই ক্ষমতাসীন হয়, তারা নিজেদের স্বতন্ত্র প্রবণতা, এমনকি সংকীর্ণতাসহ নিজেদের মন মতোই একে ব্যবহার করেছে। ফলে এ ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। হতে পারেনি গতিশীল-প্রাণোচ্ছল এক ব্যবস্থা। এই কাঠামোয় প্রাণের সঞ্চার না ঘটলে একুশ শতকের কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তা পুরোপুরি ব্যর্থ হবে। এখনো তা ব্যর্থ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ‘জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির’ সংরক্ষণ, জীবনযাপনের সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রয়োজন মেটানোর মতো সরকারের সর্বনিম্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের জন্যও তা যথেষ্ট নয়। এ অবস্থায় থাকলে ভবিষ্যতেও তা ব্যর্থ হবে।
বাংলাদেশের কিন্তু এক মহামূল্যবান সম্পদ রয়েছে এবং তা হলো দেশের সচেতন ও সংগ্রামী এক বিরাট জনসমষ্টি। এ জাতি আজও যা কিছু নিয়ে গর্ব করে তার সবটুকুই জনগণের সৃষ্টি। এই জনসমষ্টির বিরাট অংশ দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে বসবাস করছে; যদিও মানব উপাদান হিসেবে তারা কারো থেকে কম নয়। এক-তৃতীয়াংশ জনসমষ্টি এখনো নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত; যদিও নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে সর্বদা তারা সচেতন ও আগ্রহী। দেশের তারুণ্যের বিরাট এক অংশ বেকারত্ব ও আধা-বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত, যদিও দক্ষ কর্মশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার সব উপাদানে তা সমৃদ্ধ। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো দিন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে ১৬ কোটি জনসমষ্টির জনপদ বাংলাদেশ শুধু অনগ্রসরই থাকেনি, জাতীয় পর্যায়ে স্থবির, আঞ্চলিক পর্যায়ে ‘মার্জিনাল’ ও বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে অনুকম্পা প্রার্থী হয়ে টিকে রয়েছে। জনগণ কিন্তু অত্যন্ত সজাগ। ইতিহাস যদি কোনো সূচক হয়ে থাকে, তাহলে দৃঢ়তার সঙ্গে এটা বলা যায়, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে না হলেও শুধু আত্মরক্ষার জন্যই বাংলাদেশের সচেতন জনসমষ্টি একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিনাশ সাধন ও উপযোগী নেতৃত্বের পুনর্গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার অভিযানের দিকে দৃষ্টি দিলে গণশক্তির প্রভাব কিছুটা আঁচ করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমানে দেখা যায়, অতীতেও দেখা গেছে, যখন কোনো আন্দোলনের সূচনা হয়, তখন এ দেশের জনগণই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এবং নেতা-নেত্রীদের পুরোভাগেই তারা অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও তা সুস্পষ্ট হয়েছে। সুস্পষ্ট হয়েছে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে, ১৯৯০ সালের গণতন্ত্র পুনর্বাসন আন্দোলনে। আমাদের ধারণা, অনুপযোগী রাজনীতি ও অক্ষম রাজনৈতিক নেতৃত্ব এভাবে বেশি দিন টিকে থাকবে না। আগামী দু-তিন দশকে এ ক্ষেত্রে দেখা যাবে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হিসেবে পুরোভাগে নিশ্চয়ই থাকবে জনগণ। তবে আঞ্চলিক ও বিশ্ব পর্যায় থেকেও তারা লাভ করতে পারে প্রেরণা এই কারণে যে বিশ্বায়নের এই আমলে যখন প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই সম্ভব আত্মরক্ষা বা আত্মপ্রতিষ্ঠা, তখন চারদিক থেকে শুধু চাপই অনুভূত হবে না, উষ্ণ হাওয়ার গতিবেগও অনুভব করা সম্ভব। তাই বলছি, একুশ শতকের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দশকে বাংলাদেশে রাজনীতির বন্ধ্যাত্ব ঘুচে যাবে। অনুপযোগী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিন ফুরাবে। অর্থহীন রাজনীতি শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়বে। অতীতের মতোই এই মহান উৎসবের নামভূমিকায় থাকবে বাংলাদেশের জনগণই। তারাই নতুনভাবে সামাজিক চুক্তি সম্পাদন করবে নিজেদের মধ্যে, যেন উন্নত জীবনের সুযোগ তাদের হাতছাড়া না হয়।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়