মামুনুর রশীদ । খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট ২০১৬: সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ করে জঙ্গি উত্থানে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। আলোচনাগুলোর কেন্দ্রস্থলে এতকাল ছিল মাদ্রাসা শিক্ষা আর এখন ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা। দুটিই পরজীবী, অনেকটা ক্যাকটাসের মতো, যার শিকড় হচ্ছে শূন্যে। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার কথা স্মরণ করতে পারি। ‘পরভাষার মধ্য দিয়ে পরিশ্র“ত শিক্ষায় বিদ্যার প্রাণীন পদার্থ নষ্ট হয়ে যায়। প্রাণী বিবরণে দেখা যায় একজাতীয় জীব আছে, যারা পরাসক্ত হয়ে জন্মায়, পরাসক্ত হয়েই মরে। পরের অঙ্গীভূত হয়ে কেবল প্রাণধারণ মাত্রে তাদের বাধা ঘটে না, কিন্তু নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিণতি ও ব্যবহারে তারা চিরদিনই থাকে পঙ্গু। আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষা সেই জাতীয়। আরম্ভ থেকেই এই শিক্ষা বিদেশি ভাষার আশ্রয়ে পরজীবী। একবারেই যে তার পোষণ হয় না তা নয়, কিন্তু তার পূর্ণতা হওয়া অসাধ্য। আত্মশক্তি ব্যবহারে সে যে পঙ্গু হয়ে আছে, সে কথা সে আপনি অনুভব করতেও অক্ষম হয়ে পড়েছে। কেননা ঋণ করে তার দিন চলে যায়। গৌরব বোধ করে এই ঋণ লাভের হিসাব করে। মহাজন-মহলে সে দাসখত লিখিয়ে দিয়েছে। যারা এই শিক্ষায় পার হলো তারা যা ভোগ করে তা উৎপন্ন করে না। পরের ভাষায় পরের বুদ্ধি দ্বারা চিন্তিত বিষয়ের প্রশ্রয় পেতে স্বাভাবিক প্রণালিতে নিজে চিন্তা করার, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করার আন্তরিক প্রেরণা ও সাহস তাদের দুর্বল হয়ে আসে। পরের কথিত বাণীর আবৃত্তি যতই যন্ত্রের মতো অবিকল হয় ততই তারা কৃতকার্য হওয়ার অধিকারী বলে গণ্য হতে থাকে। বলা বাহুল্য, পরাসক্ত মনকে এই চির দৈন্য থেকে মুক্ত করার একটা প্রধান উপায়, শিক্ষণীয় বিষয়কে শিশুকাল থেকে নিজের ভাষার ভেতর দিয়ে গ্রহণ করা ও প্রয়োগ করার চর্চা। কে না জানে, আহার্যকে আপন প্রাণের সামগ্রী করে নেওয়ার উপায় হচ্ছে ভোজ্যকে নিজের দাঁত দিয়ে চিবিয়ে নিজের রসনার রসে জারিয়ে নেওয়া?’ আজকের দিনে আমরা শুধু আধুনিক নয়, বলতে গেলে এক উত্তর-আধুনিক যুগে বসবাস করছি। সেখানে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ বারবার এ কথা বলেছেন—‘বিদেশি ভাষা আমাদের জানতেই হবে। কিন্তু নিজ মাতৃভাষাই হবে শিক্ষার মুখ্য মাধ্যম।’ কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যেভাবে আরবি ভাষায় কওমি মাদ্রাসাগুলো শিক্ষা দান করে আসছে বা শহর থেকে শুরু করে গ্রামে-গঞ্জেও কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্লে ক্লাস থেকেই যেভাবে ইংরেজি শিক্ষা দান করা হচ্ছে তাতে শিশুর মস্তিষ্কের যেমন পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়, তেমনি কোনো সুকুমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের তপোবন শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন, যেখানে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশুকাল থেকে মানুষ পরিপূর্ণ মানুষের দিকে এগিয়ে যাবে। আশ্রমের শিক্ষা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আশ্রমের শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার শিক্ষা। মরা মন নিয়েও পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণির ঊর্ধ্বশিখরে ওঠা যায়, আমাদের দেশে প্রত্যহ তার পরিচয় পাই। দেখা যায় অতি ভালো কলেজি ছেলেরা পদবি অধিকার করে, বিশ্ব অধিকার করে না। প্রথম থেকেই আমার সংকল্প ছিল আশ্রমের ছেলেরা চার দিকের অব্যবহিত সম্পর্ক লাভে উৎসুক হয়ে থাকবে; সন্ধান করবে, পরীক্ষা করবে, সংগ্রহ করবে। এখানে এমন সব শিক্ষক সমবেত হবেন যাঁদের দৃষ্টি বইয়ের সীমানা পেরিয়ে; যাঁরা চক্ষুষ্মান, যাঁরা সন্ধানী, যাঁরা বিশ্বকৌতূহলী, যাঁদের আনন্দ প্রত্যক্ষ জ্ঞানে।’ তার মানে কোনো চাপ সৃষ্টি করে নয় বরং অবসর, খেলাধুলা, নাচ, গান, ছবি আঁকা, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ানো এ সবই থাকবে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। কিন্তু যে মানুষ নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করে, সমাজকে অবজ্ঞা করে হয়তো কোনো বৈষয়িক লাভ অর্জন করতে পারে, কিন্তু তাতে তার মনুষ্যত্বের বিকাশ সম্ভব হবে না। রবীন্দ্রনাথ নিজে ইউরোপীয় শিক্ষা ও সাহিত্য সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে তিনি গভীর হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি এতই শেকসপিয়ার দ্বারা বাল্যকালেই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে ৯ বছর বয়সে গৃহশিক্ষকের দ্বারা ইংরেজি শিখে ম্যাকবেথ অনুবাদ করেছিলেন। তিনি চিরকালই বিদ্যালয়কে মনে করতেন কারাগার। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ এই বিদ্যালয়ে সম্ভব নয়। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনকেও তিনি রক্ষা করতে পারেননি। বিশ্বভারতীকেও নয়। তবুও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ছাত্ররা জানত, শিক্ষা হচ্ছে দেশ সেবার জন্য। বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে তিনি যেখানেই কাজ করুন না কেন সেখানেই দেশ সেবার সুযোগ আছে। এই সুযোগে অনেক মনীষী দেশের জন্য, সমাজের জন্য কাজ করে গেছেন। কিন্তু তাঁর ভাবনা পরবর্তীকালে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। শিক্ষা সংকুচিত হয়েছে, শিক্ষাক্ষেত্রে স্থূল ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদিও কঠোর সরকারি অনুশাসনে পাঠ্যপুস্তক দ্বারা পরিচালিত হয়েছে বলে এক ধরনের শিক্ষিত মানুষ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কিছু ছোট-বড় সাফল্যের বিষয়ও আছে। কিন্তু রাষ্ট্র শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। পুঁজিপতিরা অর্থ লগ্নি করে বিশাল বিশাল বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলেছেন। সেসব বিদ্যাপীঠে একচেটিয়াভাবে বিদেশি শিক্ষা বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়েছে, যেখানে মাতৃভাষা গৌণ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, বিজাতীয় শরিফ কমিশন সংকোচনের নীতি গ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধেও ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বস্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী শিক্ষাব্যবস্থার ভিত রোপণ করা হয়নি। তাই দেশের শাসকগোষ্ঠী তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদান করে উন্নতির সোপান রচনা করেছেন। এই তথাকথিত উন্নতি উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সঙ্গে সমাজের দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। এসব ছেলে কয়েক প্রজন্ম ধরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিপুল পরিমাণ লুটেরা অর্থ। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এবং শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার বদলে এক ধরনের পরজীবী ক্যাকটাস হয়ে সমাজে বিচরণ করছে। অন্যদিকে মাদ্রাসায় যারা শিক্ষা লাভ করেছে, তাদের জন্য এই উত্তরাধুনিককালে কোনো পেশায় কাজ করার সুযোগ থাকছে না। এক অনিশ্চিত যাত্রাপথে, এক অন্ধকারে তাদের বিচরণ। একদিকে বিজাতীয় পশ্চিমা আলোয় আলোকিত অন্ধকার, অন্যদিকে সত্যিই আলোহীন অন্ধকার। এই দুই আঁধারের যাত্রী উদ্দেশ্যবিহীন জীবন যাপন করতে করতে একসময় জীবনের অর্থ খুঁজে পায় না। আলো দেখলে যেমন পঙ্গপাল ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও, তেমনি এরাও সেই পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে সভ্যতার ভয়াবহ সংকট সম্পর্কে জানতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘এ কোন ভারতবর্ষ ইংরেজ রেখে গেল?’ আমরা এখনকার সামাজিক পরিবেশে বলতে পারি—কোন সর্বনাশের কূলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি? তবে আশার কথা, সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে যে অগণিত মানুষকে আমরা গণনার বাইরে রেখেছি, তাদের মধ্যে জেগেছে প্রবল ঘৃণা। তারা মনের ভেতরে চিৎকার করে বলছে—থামাও! থামাও এ বর্বরতা।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব
[সংকলিত]