মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.) । খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ১২ আগস্ট ২০১৬ : ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়াটা বিপজ্জনক। তাই কৌশল বের করতে হলে জঙ্গিদের মূল শিকড় সর্বাগ্রে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। একই সঙ্গে শাখা-প্রশাখা, ডালপালার বিস্তারসহ তাদের সার্বিক অবস্থানের ওপর একটা কম্প্রিহেনসিভ মূল্যায়নপত্র তৈরি ও তার ওপর নজর দেওয়া উচিত। এটা করতে পারলেই শত্রুর পূর্ণ রূপ, শক্তি-সামর্থ্য, দুর্বলতাসহ দেশ-বিদেশে তার মিত্রদের অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলও সহজে বোঝা যাবে। তার পরের ধাপে তাহলে শিকড় উৎপাটনের যথাযথ কৌশল তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। ১৬-১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের জঙ্গিরা সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। এখনো বেশির ভাগ এক্সপার্ট ও ভাষ্যকার শত্রু কেমন ও কোন জায়গা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে—সেটি না বলে শুধুই বড় বড় আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছেন। তাতে তর্জন-গর্জন থাকলেও এটা আসলে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি করার সমান। তবে এটাও ঠিক, পত্রিকার কলাম বা নিবন্ধে পেশাদারি মূল্যায়ন করা কঠিন। কারণ পত্রিকার লেখা সবার জন্য। তাই তথ্য-উপাত্ত ও যৌক্তিকতা ব্যতিরেকে ঢালাও বা হঠাৎ কনক্লুসিভ মন্তব্য করলে পাঠকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। উপরন্তু পত্রিকার একটি কলামের স্পেসের মধ্যে এত বড় একটা জটিল বিষয়ের মূল্যায়নে সব তথ্য-উপাত্তসহ বিস্তারিতভাবে সব কিছু আলোচনা করাও সম্ভব নয়। তবে শিরোনামের ওপর সুবিচারের স্বার্থে সংক্ষেপে হলেও কিছু প্রেক্ষাপট ও ব্যাকগ্রাউন্ড তুলে ধরতে হবে।
জঙ্গি ইস্যুটি মূলত রাজনৈতিক সংকট। দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শের লড়াইয়ের পরিণতিতে এক পক্ষ গণতন্ত্র, সংবিধান ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, রাজনীতি ও সংগ্রামের পথ পরিহার করে জঙ্গিবাদ অর্থাৎ সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছে, যা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। বাংলাদেশে ১৬-১৭ বছর ধরে চলে আসা জঙ্গি তৎপরতা এবং এসবের গডফাদার ও মেন্টরদের মূলমন্ত্রের শিকড় হচ্ছে কট্টর ধর্মতন্ত্রী মতবাদ ওয়াহাবিজম বা ওয়াহাবিতন্ত্র। আইএস, আল-কায়েদা, তালেবানসহ বিশ্বের সব প্রান্তের জঙ্গি সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক মতাদর্শের গোড়াও ওই একই জায়গায়। তারা সব মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও অঞ্চলকে খিলাফত ও শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র বানাতে চায়। পরিপূর্ণ না হলেও যার একটা রূপ সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানে প্রবর্তন করেছিলেন। ওয়াহাবিতন্ত্রের প্রবর্তক সৌদি নিবাসী মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২) এবং এর আধুনিক রূপকার মিসরের হাসান-আল বান্না (১৯০৬-১৯৪৯) ও সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬-১৯৬৬)। তাঁরা সবাই জানতেন, এ রকম কট্টরপন্থা অবলম্বন করে কোনো দিনও তাঁরা বিশ্বের কোথাও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারবেন না। তাই শুরু থেকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাঁরা গণতন্ত্রকে হারাম ও কুফরি মতবাদ আখ্যা দেন। ঢাকার কল্যাণপুরের জঙ্গিরা নিহত হওয়ার আগমুহূর্তে স্লোগান দেয়, গণতন্ত্র হারাম। পাকিস্তানের মওদুদি ও বাংলাদেশের জামায়াতের কেতাবে গণতন্ত্র হারাম থাকলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরে ক্রমান্বয়ে প্রভাব বিস্তারের কৌশলের অংশ হিসেবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির মূলস্রোতে অবস্থান করে, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বা অন্য গণতান্ত্রিক দলের কাঁধে চড়ে ছদ্মবেশে ক্ষমতায় আরোহণ করা, যেমনটি জামায়াত করেছে ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপির কাঁধে চড়ে। বিশ্ব অঙ্গনে একই পন্থা অবলম্বন করেছেন মিসরের ব্রাদারহুড নেতা মোহামেদ মুরসি ও তুরস্কের এরদোয়ান। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা পেয়ে মুরসি অস্থির হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে ছদ্মবেশ খুলে আসল ওয়াহাবিতন্ত্রের রূপে আবির্ভূত হন। সুতরাং ফল যা হওয়ার তা-ই হয়। সব কিছু দ্রুত উল্টে যায়, মুরসি এখন ফাঁসিকাষ্ঠের লাইনে আছেন। অন্যদিকে তুরস্কের এরদোয়ান ছদ্মবেশ বজায় রেখে ধূর্ততার সঙ্গে অনেক দূর এগিয়েছেন। তবে তিনিও এখন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
ফিরে আসি বাংলাদেশের কথায়। পুরো পাকিস্তান আমলে বাঙালির নায্য অধিকার ও দাবির বিপরীতে শাসকদের ভাবনা ছিল, এই দাবিদাওয়া যারা জানাচ্ছে তারা ইসলাম ধর্মের দুশমন, হিন্দু ভারতের দালাল এবং ইসলামের ঘর পাকিস্তানের শত্রু। ধর্মের নামে উল্লিখিত সব অপবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমরা দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করলাম। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের মূল দর্শন ও রাষ্ট্রের মৌলিক মন্ত্র হলো—গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। এর মূল বাণী হচ্ছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং রাষ্ট্রের সব পথচলার অবলম্বন হবে বাঙালি সংস্কৃতি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর আবার সব উল্টে গেল। তখন রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশ বলে ওপরে উল্লিখিত মূল দর্শনের সব কিছু বাতিল করে দিলেন। পরিবর্তে তিনি ফিরিয়ে আনলেন পাকিস্তান আমলের মতো চরম সাম্প্রদায়িকতার দর্শন। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি দর্শন থাকল না। নতুনভাবে ফিরিয়ে আনা পাকিস্তান আমলের দর্শন এগিয়ে নেওয়ার পথের শক্তি বৃদ্ধির জন্য একাত্তরের পরাজিত জামায়াত, মুসলিম লীগসহ সবাইকেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে ফিরিয়ে আনা হলো। সেই থেকে শুরু হয় দুই বিপরীতমুখী আদর্শের যুদ্ধ, যে যুদ্ধ এখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে সশস্ত্র রূপ নিয়েছে। সুতরাং বাহ্যিকভাবে যে জঙ্গিবাদ আমরা দেখছি, তার শিকড় রয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরে।
পঁচাত্তরের পরে ফিরে আসা একাত্তরের পরাজিত ধর্মতান্ত্রিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী তখন পুনরুত্থানের পরপরই বুঝতে পেরেছিল, একদিন না একদিন তাদের অস্তিত্ব বাংলাদেশে আবার হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোনো দিনও তারা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সুতরাং তারা বাহ্যিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে থাকলেও শেষ লড়াইটা করার জন্য পরিকল্পিতভাবে গোপনে সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন তৈরি করেছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র তাদের শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছে, দেশের বড় এক রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। অর্থ ও ছদ্মবেশী কূটকৌশলের জোরে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মধ্যপ্রাচ্যে বড় ঘাঁটি গেড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করার প্রতিশ্র“তির মাধ্যমে বিশ্বের পরাশক্তিসহ অনেক বিশ্ব সংস্থার আনুকূল্য পাচ্ছে। ২০১৪ সালের পর বিশ্বব্যাপী ত্রাস সৃষ্টিকারী আইএস নামের জঙ্গি সংগঠনের উত্থানের ফলে বাংলাদেশের জঙ্গিরাও উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন হলেও মূলমন্ত্র এক হওয়ায় তারা একে অপরকে সহযোগী ও সহোদরও মনে করতে পারে। মৌলিক দ্বন্দ্বটা কোথায় এবং বাংলাদেশের জঙ্গিদের মূল শিকড় ও দেশ-বিদেশে তাদের শাখা-প্রশাখার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এত সময় দিলাম।
উল্লিখিত যুক্তিগুলোর সমর্থনে আরো কিছু দৃশ্যমান বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া যায়। এক. এযাবৎকাল যাঁরা জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন, তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনে বিশ্বাসী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও বুদ্ধিজীবী। দুই. ২০০৪-০৫ সালে তারা আদালত প্রাঙ্গণে আক্রমণ ও বিচারকদের হত্যা করেছে এবং সঙ্গে স্লোগান দিয়েছে, তাগুতি অর্থাৎ মানুষের সৃষ্ট আইনে রাষ্ট্র চালানো যাবে না, তাদের দেওয়া মতাদর্শ অনুসারে আল্লাহর আইনে দেশ চালাতে হবে। এ কথা কাদের মূলমন্ত্র তার কিছু বর্ণনা লেখার মধ্যভাগে দিয়েছি। তিন. ২০১৩-১৪ সালে এবং তার পর থেকে এ পর্যন্ত জঙ্গিদের আক্রমণের প্যাটার্ন ও গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা এখন জঙ্গিদের অন্যতম লক্ষ্য। চার. কল্যাণপুরের অভিযানে নিহত জঙ্গি জোবায়েরের বাবা নোয়াখালীর আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, জোবায়েরকে জঙ্গি বানিয়েছে তাঁর ভাইয়ের ছেলে বাহাদুর, যে নোয়াখালীর স্থানীয় জামায়াতের রোকন। লেখার মধ্যভাগের বর্ণনা এবং ওপরের এক থেকে চার নম্বর ক্রমিকে উল্লিখিত তথ্য-উপাত্তের দিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গিদের শিকড় চিনতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মূল শিকড় বা মূল শত্রু সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ সম্পন্ন হলে তা উৎপাটনের কৌশল বের করার মতো মেধা ও মনন বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে দু-একটি সুপারিশ দিতে পারি। এক. অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে সমন্বিতভাবে নিজ নিজ সাংগঠনিক শক্তি কাজে লাগিয়ে গ্রামগঞ্জে, হাটবাজারে, অলিগলিতে, শিক্ষাঙ্গনে—সর্বত্র অনবরত গণজাগরণ ও গণপ্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে হবে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মতো জঙ্গিবিরোধী অভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে পারলে দেশের সব রাজনৈতিক পক্ষ বুঝতে পারবে, এ দেশে রাজনীতি করতে হলে সাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শনবিরোধী রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে, নইলে তাদের নিজেদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। এর সামান্য কিছু লক্ষণ এর মধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। ২০ দলীয় জোটের বড় পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা জামায়াতকে নিয়ে কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন। দুই. জঙ্গিবিরোধী চলমান জনমতকে অবলম্বন করে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে ছদ্মবেশে অবস্থানকারী ভাইরাস ও ভূত উৎখাতের কৌশল সরকারকে বের করতে হবে। তিন. আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অভূতপূর্ব ভারসাম্য সৃষ্টি করেছেন, সব বন্ধুরাষ্ট্রকে জঙ্গিবিরোধী অবস্থানে এনেছেন, তা ধরে রেখে সেটিকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। চার. মাঠপর্যায়ে সশস্ত্র জঙ্গিদের মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্রের আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা আরো সক্ষম ও শক্তিশালী করতে হবে। জঙ্গিদের গডফাদার ও মেন্টরদের রাজনৈতিক শিকড় উৎপাটিত হলেই আমরা সম্পূর্ণ জঙ্গিমুক্ত বাংলাদেশ পাব।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
[সংকলিত]