Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

gaffar-1আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী । খোলা বাজার২৪, শনিবার, ১৩ আগস্ট ২০১৬: মাত্র দুই দিন আগে ঢাকার আরেকটি দৈনিকে আমার কলামে বিএনপির বর্তমান হালহকিকত নিয়ে লিখেছি। জামায়াতের সঙ্গে কণ্ঠিবদলের রাজনীতি অব্যাহত রাখতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দলটির বর্তমান অবস্থার ওপর আলোকপাত করেছি ওই লেখায়। লিখেছিলাম, গত মার্চ মাসে দলটির জাতীয় সম্মেলন হয়েছে। তারপর চার মাসেও স্থায়ী জাতীয় কমিটি গঠন দলনেত্রীর পক্ষে সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত এ মাসে টেনেটুনে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির ১৭ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে পুরো ১৯ জনের নামই ঘোষিত হয়। নামের তালিকা দেখে মনে হলো, এটা পর্বতের মূষিক প্রসব।
আর এই মূষিকও ঘরের পালিত মূষিক, বাইরের কোনো মূষিক নয়। বয়সে অনেকেই তরুণ। খালেদা জিয়া দম্ভ দেখিয়ে বলতে পারেন, তিনি দলে নতুন রক্ত সঞ্চালন করেছেন। কিন্তু এই নতুন রক্তের মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। এই কমিটির সবাই বিএনপির পুরনো নেতাদের সন্তান-সন্ততি অথবা নিকটাত্মীয়। বাবা বা ভাই যে দল করতেন, সেই দলেই তাঁদের টেনে নেওয়া হয়েছে পারিবারিক পরিচয়ে। দলকে নতুন গতিবেগ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের কোনো মেধা বা নেতৃত্বশক্তি আছে বলেও আশা করার কিছু নেই। এটা একটা দলের খোলস বদল মাত্র। একটি রাজনৈতিক দল যে এই একুশ শতকে সম্পূর্ণ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে এককেন্দ্রিক পরিবারতন্ত্রে পরিণত হতে পারে, বিএনপি দলটি তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। মনে হয় দলটি অতীতের মুসলিম লীগের নীতি ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে অগস্ত্যযাত্রার পথ বেছে নিয়েছে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য কোনো সুখবর নয়।
বিএনপির এই কমিটির সদস্যদের সদ্য ঘোষিত নামের তালিকাটির দিকে একবার নজর দেওয়া যাক। সব সদস্যই একই দলীয় পরিবারের সন্তান-সন্ততি। তাঁদের সবার পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। বেশ কয়েকজনের নাম ও পরিচয় তুলে ধরলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। শামা ওবায়েদ, বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে। ফয়সল আমিন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ছোট ভাই। জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, মির্জা ফখরুলের ভগ্নিপতি। খোন্দকার মারুফ, বিএনপি নেতা খোন্দকার মোশাররফের ছেলে। গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দণ্ডিত সাকা চৌধুরীর ছোট ভাই। হুম্মাম কাদের চৌধুরী, সাকা চৌধুরীর ছেলে। নওশাদ জমির, সাবেক বিএনপি সরকারের স্পিকার জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে। বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। মির্জা খোকন মির্জা আব্বাসের ছোট ভাই। তাবিথ আউয়াল, বিএনপি সমর্থক শিল্পপতি আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে। অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের ছেলে। অপর্ণা রায়, বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মেয়ে। নিপুণ রায় চৌধুরী, গয়েশ্বর রায়ের পুত্রবধূ ও বিএনপি নেতা নিতাই রায় চৌধুরীর মেয়ে। নাসিমা আখতার কল্পনা, বিএনপি নেতা নাসির উদ্দীন পিন্টুর স্ত্রী। তাহসিনা রুশদীর লুনা, নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী।
স্থানাভাবে বাকি নামগুলো দিলাম না। তাঁরাও একই গোত্রভুক্ত। অর্থাৎ বিএনপি পরিবারের সন্তান-সন্ততি। এত বিশাল দেশে বিশাল তরুণ সমাজের মধ্য থেকে বিএনপি তরুণ প্রজন্মের একটি নতুন মুখকেও দলে টানতে পারেনি। দীর্ঘ পাঁচ মাস খালেদা জিয়া সারা দেশে তল্লাশি চালিয়ে হয়তো নতুন কাউকে দলে টানতে না পেরে দলীয় পরিবারের সদস্যদেরই দলে টেনে এনে দলরক্ষায় শেষ চেষ্টা করছেন, তাতে দলরক্ষা হবে কি? নিজেদের মতিভ্রমের জন্য বিএনপির আজ যে এই অগস্ত্যযাত্রা তা ঠেকাবে কে?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের এই তালিকা দেখে ইংল্যান্ডের প্রাচীন ইতিহাসের এক কাহিনী মনে পড়ছে। একবার ইংল্যান্ড বাইরের এক প্রবল শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কার মুখে পড়ে। সেনাবাহিনী এই শত্রুকে প্রতিহত করার মতো শক্তিশালী ছিল না। রাজা মন্ত্রীদের ডাকলেন পরামর্শের জন্য। মন্ত্রীরা বললেন, রাজার এক বখাটে ছেলে আছে। সে কোনো কাজকর্ম করে না। অকর্মণ্য, অলস, অপব্যয়ী জীবন যাপন করে। তাকে ডেকে আনা হোক। নতুন সেনা রিক্রুট ও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার ব্যবস্থা হোক।
রাজা মন্ত্রীদের পরামর্শে প্রিন্সকে ডেকে আনলেন। প্রিন্স এক কথায় রাজি। বলল, টাকা দাও, আমি তোমাকে নতুন আর্মি গঠন করে দেব। রাজা বললেন, রাজকোষ খুলে দিলাম, যত টাকা লাগে নাও। রাজার ছেলে এক মাস সময় নিল নতুন সেনাবাহিনী গড়তে। এই এক মাস সে দুই হাতে টাকা ওড়াল, “োর স্ফূর্তি করল। রাজা একসময় খবর পেলেন, পুত্র নতুন সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছে। তিনি তাঁর অকর্মণ্য পুত্রের সাফল্যে খুশি হলেন। তাকে সংবর্ধনার জন্য প্রাসাদের ফটকে গিয়ে নিজে দাঁড়ালেন।
রাজা দেখলেন, প্রিন্স এক বিশাল বাহিনী নিয়ে প্রাসাদের দিকে আসছে। তিনি আনন্দে অধীর। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তাঁর চোখ কপালে উঠল। দেখলেন, তাঁর রাজ্যে যত ভিক্ষুক, অন্ধ, খঞ্জ, বোবা, আতুড় আছে, তাদের এক বিশাল দল তাঁর প্রাসাদের সামনে। প্রিন্স ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসে পিতাকে অভিবাদন জানাল। রাজা বিস্মিত হয়ে বললেন, এটা তুমি কী করেছ? রাজ্যের যত ভিক্ষুক, অন্ধ, খঞ্জকে তুমি ধরে নিয়ে এসেছ? ওরা যুদ্ধ করবে? প্রিন্স হেসে বলল, এরা যুদ্ধ করবে কেন? যুদ্ধ করবে তোমার সেনারা। কিন্তু সব যুদ্ধেই কিছু লোক কামানের খোরাক হয়। নিজেরা মরে সেনাবাহিনীকে শত্রুর কামান থেকে বাঁচায়। এই যুদ্ধেও তারা হবে সেই কামানের খোরাক।
এটা প্রাচীন যুগের কাহিনী। এ যুগে বাংলাদেশে বিএনপি দলে নতুন রক্ত সঞ্চালনের নামে কামানের খোরাক জোগাড় করেছে তা বলব না। কিংবা কমিটিতে যাঁদের গ্রহণ করা হয়েছে তাঁরা কানা-খোঁড়া-অন্ধ তা বলার ধৃষ্টতাও আমার নেই। কিন্তু এই কমিটিতে যাঁদের নাম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন তাঁরা সবাই দলের প্রবীণ নেতাদের ছেলেমেয়ে, ভাই-বেরাদর বা পুত্রবধূ। তাঁদের কাউকে কাউকে জাতীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়ার আগেই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা করা হয়েছে। তাঁদের নিয়ে কি বিএনপি আন্দোলনে নামার আশা করে? না তাঁরা আন্দোলনে কামানের খোরাকও হতে চাইবে?
বিএনপির এই কমিটিতে পুরনো নেতাদের ছেলেমেয়ে, ভাই ও ভগ্নিপতিদের ঢল থেকে মনে হয়, ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে বিএনপি দলের বাইরে তরুণ প্রজন্মের একজনকেও রিক্রুট করতে পারেনি। দলের পরীক্ষিত ও পুরনো নেতাদেরও বাদ দেওয়া হয়েছে। যে দু-একজনকে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন বিএনপি নেত্রীর খুবই ঘনিষ্ঠ মোসাদ্দেক আলী ফালু কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি বিদেশে চিকিৎসাধীন। অন্যজন আবদুল্লাহ আল নোমানও কমিটি থেকে পদত্যাগ করবেন বলে গুজব শোনা যাচ্ছে। খালেদা জিয়া দলের সর্বেসর্বা। কিন্তু আজকাল দেখা যাচ্ছে, তিনি তাঁর দলের কোনো কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্যদের নাম ঘোষণা করলেই দলের সাধারণ কর্মী ও নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা পর্যন্ত হয়।
বাজারে গুজব, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যাঁরা সদস্য হয়েছেন তাঁরা তারেক বাহিনী। ছেলের অনুমোদনেই মা এই সদস্যদের বাছাই করেছেন। প্রাচীন ইংল্যান্ডের এক প্রিন্স যেমন বাবাকে সেনাবাহিনী উপহার দেওয়ার নামে কামানের খোরাক উপহার দিয়েছিল; এ যুগের বাংলাদেশে বিএনপির কথিত প্রিন্স দলকে তাই উপহার দিলেন কি না কে বলবে? কোনো দল যখন সুস্থ রাজনীতির পথ হারায়, ভাঙনের পথ ধরে, তখন এমনই হয়।
পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসক আইয়ুব খান যখন ক্ষমতা হারালেন, তখন তিনি তাঁর হাতে গড়া কনভেনশন মুসলিম লীগের সভাপতি করার জন্য সারা পাকিস্তানে একজন লোকও খুঁজে পাননি। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী (যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর বাবা, যাঁর আরেক ছেলে ও নাতিকে বিএনপির এই কমিটিতে গ্রহণ করা হয়েছে), যাঁকে আইয়ুব নিজে দুর্নীতির দায়ে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করেছিলেন, তাঁকেই ডেকে এনে সভাপতি পদে বসান। সেই কনভেনশন মুসলিম লীগের অস্তিত্ব আজ আর নেই।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদ্য ঘোষিত সদস্যদের নামের তালিকা থেকেই বোঝা যায়, দলটি সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। দলীয় পরিবারের বাইরে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। তারেক রহমান দলে এমন সব লোক রাখবেন, যাঁরা অবনত মস্তকে তাঁর ডিক্টেটরশিপ মেনে চলবেন। পরিবারতন্ত্রের প্রতি অনুগত থাকবেন। জামায়াতের সঙ্গে অশুভ আঁতাত রক্ষা করে চলার নীতির কোনো প্রতিবাদ জাগবে না। আন্দোলনে তাঁদের রাজপথে পাওয়া যাবে না। তবে চক্রান্তের রাজনীতিতে হয়তো পাওয়া যাবে।
তারেক চালিত বিএনপিতে যে দলের প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষী প্রবীণ ব্যক্তিদের আর কোনো স্থান নেই, সাম্প্রতিককালেও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সংক্রান্ত ঘটনায়। এই প্রবীণ শিক্ষাবিদ বিএনপির প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষী হওয়াতেই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিকে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ জন্য বিএনপির হাইকমান্ড তাঁর অবমাননা ঘটাতে কিছুমাত্র দ্বিধা দেখায়নি। বোঝাই যায়, বিএনপিতে দলটির প্রকৃত শুভাকাক্সক্ষী প্রবীণ মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ও অংশগ্রহণকারী নেতাকর্মীদের এখন আর কোনো স্থান নেই। মা-ছেলের এই দলটির একটা বড় জনসমর্থন ছিল। সেই সমর্থন তারা দ্রুত হারাচ্ছে। দলটির গণবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। প্রশ্ন জাগে, এই দলটিও অতীতের মুসলিম লীগের মতো তাহলে কি অগস্ত্যযাত্রার পথে? দলের নেতানেত্রীদের মতিভ্রম কি কখনো ঘুচবে না?
লন্ডন, মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০১৬
[সংকলিত]