Tue. Apr 29th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

dr-sadat-hossain-1-: ড. সা’দত হুসাইন :-
জনগণ শাসনক্ষমতার সর্বময় অধিকারী—রাষ্ট্রীয় দর্শনের এই ভিত্তিকে যারা অলঙ্ঘনীয় নীতি হিসেবে বিশ্বাস করে, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসক ছাড়া অন্য কারোর দেশ শাসনের নৈতিক অধিকার আছে বলে তারা মনে করে না। দেশের ভূখণ্ডের মালিকানা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে দেশের শাসনব্যবস্থায় সব নাগরিকের যে অধিকার রয়েছে, যেকোনো সভ্য জনগোষ্ঠী সে ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে। দেশের জনসাধারণ কর্তৃক সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের নেতা ও শাসক বেছে নেওয়ার ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা হয়। একইভাবে বিভিন্ন সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা যখন নিজেদের মুক্ত পছন্দানুসারে তাদের নেতা (নেতৃবৃন্দ) বেছে নেয় তখন আমরা বলি, ওই সংগঠনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
নেতা-নেত্রী ও শাসক বেছে নেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন রয়েছে, তেমনি এ প্রসঙ্গে বহু ধরনের বিবেচ্য বিষয়ও এ পর্যন্ত উত্থাপিত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন বিষয় আলোচনার কেন্দ্রে আসতে পারে। নেতা-নেত্রী, শাসক নির্বাচন কিংবা বিকল্প প্রস্তাবগুলো গণতান্ত্রিক উপায়ে বাছাইয়ের জন্য প্রচলিত পদ্ধতিগুলো হচ্ছে—কণ্ঠভোট, হাত তুলে সমর্থন জ্ঞাপন, ছোট কাগজে নাম লিখে সমর্থন জানানো এবং গোপন ব্যবস্থায় ভোটগ্রহণ। চূড়ান্তভাবে বিজয়ী নির্ধারণের জন্য শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটপ্রাপ্তি যথেষ্ট হতে পারে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় First past the post। আবার কোনো কোনো দেশ বা সংগঠনে একাধিক রাউন্ড ভোটগ্রহণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে চূড়ান্ত বিজয়ী মোট প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন, যার অর্থ দাঁড়ায় তাঁকে অধিকাংশ ভোটার সমর্থন জানিয়েছে। পদ্ধতিবৈচিত্র্যের দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে সরাসরি (Direct) নির্বাচন এবং প্রতিনিধি গণনার ভিত্তিতে পরোক্ষ (Indirect) নির্বাচন। সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে প্রদত্ত সব ভোট সরাসরি গণনা করে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রপতিশাসিত বাংলাদেশে এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হতো। আমাদের দেশের বহু সংগঠনে ও অন্যান্য দেশে এ প্রথা প্রচলিত রয়েছে। অন্য পদ্ধতি হচ্ছে, পুরো ভোটার এলাকাকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে নিয়ে প্রতি অংশের জন্য স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করা। প্রতিটি এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যা গণনা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিদের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় কোন দল বা ব্যক্তি চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। ওয়েস্ট মিনস্টার পার্লামেন্টারি পদ্ধতি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এক অর্থে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য ইলেকটোরাল কলেজ বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজ প্রকৃতপক্ষে হিসাব-নিকাশভিত্তিক একটি কৃত্রিম নির্মাণ (Construct)। এখানে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে যে অঙ্গরাজ্যে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি ওই অঙ্গরাজ্যের জন্য নির্ধারিত সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। এখানে ইলেকটোরাল কলেজ একটি কল্পিত নির্মাণ। ইলেকটোরাল কলেজ সত্যিকার অর্থে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত ব্যক্তি নিয়ে গঠিত নয়, অতএব এ ক্ষেত্রে ইলেকটোরাল কলেজভিত্তিক আলাদা কোনো অর্থবহ ভোট নেওয়া হয় না। নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মূল নির্বাচনের মাসখানেক পর নামমাত্র ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গ্রহণ করে বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়। পার্লামেন্টারি নির্বাচন ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন—এই উভয় পদ্ধতিতে পরাজিত দল বা প্রার্থীর মোট জনভোটের (popular vote) সংখ্যা বিজয়ী প্রার্থী বা দলের ভোটের চেয়ে বেশি হতে পারে। বুশ-আল গোরের নির্বাচনে এবং বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী বা দলের পপুলার ভোট বিজয়ী প্রার্থী বা দলের চেয়ে বেশি ছিল। গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরোক্ষ নির্বাচনের এটি একটি বিরাট দুর্বলতা সন্দেহ নেই।

পছন্দের ওজন পরিমাপের ক্ষেত্রে পদ্ধতিবিষয়ক যে ইস্যুটি এরপর সামনে এসে যায় সেটি হচ্ছে, নির্বাচন কি এলাকাভিত্তিক (Constituency Based) হবে অথবা সামগ্রিকভাবে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হিসাবে (Proportional Representation) হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় স্বতন্ত্রভাবে ভোট হলে যে দল বা জোট সর্বাধিকসংখ্যক স্বতন্ত্র এলাকায় জয়ী হবে সে দল বা জোট সরকার গঠন করার সুযোগ পাবে। জনভোটের এখানে কোনো গুরুত্ব নেই। পক্ষান্তরে আনুপাতিক ভোটের (Proportional Representation) ক্ষেত্রে সারা দেশের ভোট গণনা করে একটি দল বা জোট মোট ভোটের যে আনুপাতিক ভোট পাবে, পার্লামেন্টের মোট সদস্য সংখ্যার সমানুপাতিকসংখ্যক সদস্য সে দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বলে ঘোষণা করা হবে। ঘোষিতসংখ্যক পদে কারা তালিকাভুক্ত হয়ে সংসদ সদস্য হবেন দল বা জোট তা নির্ধারণ করবে। নির্বাচন-উত্তরকালে তালিকাভুক্তির জটিলতা পরিহারকল্পে নির্বাচনের আগেই সব দল থেকে ক্রমমান অনুযায়ী সম্ভাব্য সংসদ সদস্যদের তালিকা সিলগালা অবস্থায় সংগ্রহ করে কঠোর নিরাপত্তায় সংরক্ষণ করা হয়। ভোটের ফলাফল পাওয়ার পর তালিকার ক্রমমান অনুযায়ী নির্দিষ্টসংখ্যক ব্যক্তিকে সংসদ সদস্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

নির্বাচিত শাসক, ব্যবস্থাপক বা নেতার মেয়াদকাল কত সময়ের জন্য হবে, তাও একটি বিবেচ্য বিষয়। আমরা দেখতে পাই যে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদকাল তিন থেকে সাত বছর দীর্ঘ হতে পারে। মেয়াদকাল দীর্ঘ হলে সরকার বা নির্বাহী পর্ষদ দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়, তবে এর ফলে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব গড়ে ওঠে, যা নাগরিক সাধারণ বা সংগঠনের সদস্যদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে। তাদের প্রতিপক্ষ দল দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় ধৈর্য হারিয়ে বেপরোয়াভাব দেখাতে শুরু করে; যার পরিণাম সাধারণভাবে অশুভ হয়। বলা হয়, ‘Given a long tenure, the ruling party becomes despot and the opposition becomes desperate. People are sandwiched in between.’ মেয়াদকাল দীর্ঘ হলে অনেক সময় শাসকদলকে ক্ষমতার নেশায় পেয়ে বসে। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তারা নানা ফন্দিফিকির কষতে থাকে। এমনকি গণতন্ত্রের মৌলিক চরিত্র পরিবর্তন করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। ক্ষমতাই একমাত্র উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। অনেক উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে সিআইএস (Commonwealth of Independent States) ও আফ্রিকার দেশগুলোয় এ ধরনের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। নানা ধরনের ব্যতিক্রম, বিকৃতি ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করার প্রয়াস পেয়েছে। এমনকি জনগণ যাদের পক্ষে রায় দিয়েছে, শাসকগোষ্ঠী তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে।

পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গণতন্ত্রের স্বঘোষিত অভিভাবক হিসেবে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চ দখল করে রেখেছে। তারাই ঠিক করে দেয় কোন দেশের সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা হবে আর কোন দেশের সরকারকে সে নামে ডাকা হবে না। তাদের অপছন্দের সরকারকে তারা হয়তো বা আখ্যায়িত করবে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকার হিসেবে। এ ব্যাপারে ব্যবহূত মানদণ্ড অভিভাবকদের মর্জিমাফিক বিভিন্ন দেশ ও সময়ের জন্য বিভিন্ন রূপ হয়ে থাকে। তবে সাধারণত নিজেদের বড় রকমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় জড়িত না থাকলে মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকেও তারা শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পক্ষান্তরে স্বার্থে আঘাত ঘটলে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের প্রশাসনিক পদ্ধতি ও পদক্ষেপগুলোর তীব্র সমালোচনা করে সে সরকারকে গণবিরোধী-অগণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে ঘোষণা করে এবং সুযোগ পেলে এ অজুহাতে চরম অগণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকে উৎখাত করে পুতুল সরকার কায়েম করে। গণতান্ত্রিক সরকারের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হচ্ছে সে সরকার প্রতিষ্ঠায় দেশের জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কি না এবং প্রতিষ্ঠার পর সরকার জনগণের স্বার্থ ও তাদের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি না; তাদের অধিকার সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকছে কি না এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও কর্মসূচিতে যত দূর সম্ভব তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কি না।
যেহেতু একচ্ছত্র অভিভাবক পশ্চিমা দেশগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক শাসনের মূল মাপকাঠি, ক্ষেত্র বিশেষে একমাত্র মাপকাঠি মনে করে, সেহেতু উন্নয়নশীল দেশগুলোর কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কোনো রকমে একটি দায়সারা যেনতেন নির্বাচন সম্পন্ন করে তাদের শাসনকাল দীর্ঘায়িত করতে চেষ্টা চালায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সফল হয়। গণতন্ত্রের অভিভাবক দেশগুলো প্রথম দিকে কিছু ওজর-আপত্তি করলেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার টিকে থাকতে পারলে শেষ অবধি তারা এ সরকারকে মেনে নেয় এবং এ সরকারের মাধ্যমে তাদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার সামর্থ্যই পশ্চিমা অভিভাবকদের গণতন্ত্রের সনদ পাওয়ার মূল নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে তারা গুরুত্ব দেয় কি না সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী, যারা সাধারণত শাসকগোষ্ঠী হয়ে থাকে, নির্বাচন পদ্ধতিকে দুমড়েমুচড়ে তাদের সুবিধামতো সাজিয়ে নেয়। সমগ্র নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি সংঘটিত হয় তাকে দুই শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে—ক. কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে বা কাজে যাদের নিয়োগ, নিয়োজন বা সাময়িক দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের বাছাই কার্যক্রম এবং খ. নির্বাচনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, কর্মকাণ্ড ও অনুষ্ঠান-আয়োজনগুলো। প্রথম ক্যাটাগরিতে যেসব বিষয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি ঘটে থাকে তা হলো—নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন গঠন, কেন্দ্রে ও নির্বাচনী এলাকায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মকর্তা নিয়োগ, সরকারি-বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষক বাছাই, বিভিন্ন প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট বাছাই। দ্বিতীয় ক্যাটাগরির যেসব অঙ্গনে অনিয়ম-দুর্নীতি ঘটে থাকে সেগুলো হলো—নির্বাচনী এলাকার পরিসীমা নির্ধারণ (Delimitation), ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, প্রার্থীদের যোগ্য-অযোগ্য ঘোষণার মানদণ্ড নির্ধারণ, নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও প্রশাসনিক কাঠামো প্রণয়ন, নির্বাচনের বিভিন্ন স্তরে নিরাপত্তাব্যবস্থার আঙ্গিক নির্ধারণ, গণমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারের নীতিমালা প্রণয়ন, নির্বাচনী প্রতীক নির্ধারণ, বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর মধ্যে তা বিতরণ, নির্বাচনসংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ এবং তা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, নির্বাচনী আইন ও নিয়ম ভঙ্গের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, নির্বাচনের ফল গণনা ও ঘোষণা।
উপরোক্ত কাজগুলো সাধারণত সরকার ও নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের আওতাধীন। নির্বাচনের অব্যবহিত আগে-পরে ও নির্বাচনের দিন প্রার্থী ও তাঁর দল যেসব অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকে তা হচ্ছে—প্রচার, প্রচারণা ও সাংগঠনিক কাজে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করা, পেশিশক্তি প্রয়োগ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো, আহত করা, সমর্থককে গুম করা, সম্ভাব্য প্রার্থীদের নানা অপকৌশলে বিতাড়ন করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা চালানো, টাকা-পয়সা দিয়ে ভোট কেনা ও নির্বাচনী কর্মকর্তাকে প্রভাবিত করা, নিজের সুবিধামতো জায়গায় ভোটকেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করা, ভৌত বা মানব ব্যারিকেড তৈরি করে বিরোধী প্রার্থীর সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান, বিরোধী প্রার্থীর প্রচার কার্যক্রম, শোভাযাত্রা ও জনসংযোগ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, জাল ভোট দেওয়া, মিথ্যা ব্যালটে ভোটের বাক্স ভর্তি করা (Stuffing of ballots), বিরোধী প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ডামি প্রার্থীর এজেন্ট দিয়ে কেন্দ্র ভরে দেওয়া, ভোটের লাইনে দাঁড়ানো বিরোধী প্রার্থীর ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাইন থেকে বের করে দেওয়া, অপকৌশলের মাধ্যমে ভোটের গতি শ্লথ করে দেওয়া, অস্ত্র ও পেশিশক্তি বলে সরাসরি কেন্দ্র দখল করা অথবা গোলমাল সৃষ্টি করে ভোট বন্ধ করে দেওয়া, ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করা, ভোট গণনার সময় ঝামেলা সৃষ্টি করা, ব্যালটভর্তি বাক্স লুট করা বা ছুড়ে ফেলা, পোলিং বুথ ভাঙচুর করা অথবা পুড়িয়ে দেওয়া, ফলাফলের কাগজ ছিনিয়ে নেওয়া, বিনষ্ট করা ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে ভোটের ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনপ্রক্রিয়া দুর্নীতি ও অনিয়মের আশঙ্কায় আক্রান্ত। এসব দুর্নীতি, বিকৃতি ও অনিয়ম প্রতিহত করে একটি নির্বাচন কলুষমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। স্মর্তব্য যে সুষ্ঠু নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি আবশ্যকীয় (Necessary) উপাদান, সম্পূর্ণ (Sufficient) উপাদান নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারও মানসিকতার বিভ্রান্তিজনিত কারণে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হতে পারে। নাগরিকের অধিকার হরণ করতে পারে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থাকে বলা হয় অনুদার গণতন্ত্র (Illiberal Democracy)। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শক্তিশালী গোষ্ঠী এ ব্যবস্থাকে আছড়ে-পিছড়ে এর আকার-প্রকার নিজেদের সুবিধামতো তৈরি করে নিতে পারে। এই কিম্ভূতকিমাকার গণতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের চিন্তাচেতনার গণতন্ত্রের কোনো মিল নেই। তবু এটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
ফরিদ জাকারিয়ার মতে, শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর উন্নয়নশীল দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নামে প্রকৃতপক্ষে কলুষযুক্ত নির্বাচন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত ধরে অনুদার গণতন্ত্র জেঁকে বসে। উদার গণতন্ত্রের (Liberal Democracy) আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো এসব দেশে তিরোহিত। অনুদার (বিকৃত) গণতন্ত্রে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয় না। শাসকগোষ্ঠী জনগণের কল্যাণ বা তাদের সুবিধা-অসুবিধার তোয়াক্কা করে না। জনগণ তাই বঞ্চনা ও হতাশায় নিমজ্জিত থাকে। দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে সাধারণ জনগণ উদার গণতন্ত্র সম্পর্কে বিস্মৃত। অনুদার গণতন্ত্র তাদের জীবনে যে দুর্গতি আনে সে সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়। মুষ্টিমেয় নাগরিক যারা ওয়াকিবহাল তারাও নিশ্চুপ, নির্বিকার। ঝুঁকিমুক্ত জীবনে আসক্ত। যেহেতু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বদৌলতে এসব দেশ বিশ্ব অভিভাবকদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছে, তাই উদার গণতান্ত্রিক চর্চার প্রয়োজন আছে বলে শাসকগোষ্ঠী মনে করে না। এসব দেশে উদার গণতন্ত্রের আবির্ভাব বিলম্বিত হবে। আপাতত অসম্পূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ ও বিকৃত চেহারার গণতন্ত্রের ছায়া-প্রচ্ছায়ায় তাদের জীবন কাটাতে হবে।

লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান
[সংকলিত]