মুহম্মদ জাফর ইকবাল । খোলা বাজার২৪, শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬: ১৪ ঘণ্টা আকাশে উড়ে আমাদের প্লেনটা শেষ পর্যন্ত নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছে। টানা ১৪ ঘণ্টা প্লেনের ঘুপচি একটা সিটে বসে থাকা সহজ কথা নয়। সময় কাটানোর নানা রকম ব্যবস্থা, তার পরও সময় কাটতে চায় না। অনেকক্ষণ পর ঘড়ি দেখি, মনে হয় নিশ্চয়ই এর মধ্যে ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে; কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, ১৫ মিনিটও পার হয়নি!
এয়ারপোর্টে নামার পর ইমিগ্রেশনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রতিবারই নতুন নতুন নিয়মকানুন থাকে। এবারও নতুন নিয়ম, যাত্রীদের নিজেদের পাসপোর্ট নিজেদের স্ক্যান করে নিতে হবে। কিভাবে করতে হবে খুব পরিষ্কার করে লেখা আছে, সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করি; কিন্তু আমাদের পাসপোর্ট আর স্ক্যান হয় না। দেখতে দেখতে বিশাল হলঘর প্রায় খালি হয়ে গেছে, শুধু আমি আর আমার স্ত্রী পাসপোর্ট নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছি! কিছুতেই যখন পাসপোর্ট স্ক্যান করতে পারি না তখন শেষ পর্যন্ত লাজলজ্জা ভুলে, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ অফিসারের কাছে গিয়ে মিনমিন করে বললাম, আমার পাসপোর্ট কিছুতেই স্ক্যান হচ্ছে না।
আমার কথা শেষ করার আগেই পুলিশ অফিসার আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘আপনি জাফর ইকবাল না?’
পুলিশ অফিসার বাঙালি, শুধু যে বাঙালি তা নয়, আমাকে চেনে। দেশের এয়ারপোর্টে এটা অনেকবার ঘটেছে; কিন্তু নিউ ইয়র্কের এয়ারপোর্টেও এটা ঘটবে—কল্পনা করিনি।
বলাবাহুল্য এরপর আমার পাসপোর্ট মুহূর্তে স্ক্যান হয়ে গেল (কী কারণে জানা নেই আমার পাসপোর্টে পুরনো পাসপোর্ট লাগানো আছে, সে কারণে সাইজ মোটা ও স্ক্যান করার জন্য যন্ত্রের মধ্যে ঢোকানো যায় না! এ রকম অবস্থায় কী করতে হবে আমাদের বাংলাদেশের বাঙালি পুলিশ অফিসার সেটা শিখিয়ে দিল)। বিদেশের মাটিতে নামার পর নানা রকম আশঙ্কায় সব সময় আমার বুক ধুকপুক করতে থাকে; এবার মুহূর্তের মধ্যে সব দুশ্চিন্তা, সব আশঙ্কা দূর হয়ে গেল। মনে হলো শহরটি বুঝি অপরিচিত, নির্বান্ধব, স্বার্থপর, নিঃসঙ্গ একটি শহর নয়। এই শহরে আমার দেশের মানুষ আছে, দেশের বাইরে তারা দেশ তৈরি করে রাখে।
আমার ধারণা যে ভুল নয় সেটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমি আবার তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। যারা খোঁজখবর রাখে তারা সবাই জানে সারা পৃথিবীতেই এখন উবার কিংবা লিফট নামে নতুন সার্ভিস শুরু হয়েছে। স্মার্টফোনে তার ‘অ্যাপস’ বসিয়ে নিলেই সেটা ব্যবহার করে গাড়ি ডাকা যায়, ভাড়া নিয়ে দরদাম করতে হয় না, ক্রেডিট কার্ড থেকে সঠিক ভাড়া কেটে নেয়। তাই কোনো টাকা-পয়সার লেনদেন করতে হয় না। স্মার্টফোনের ম্যাপে গাড়িটা কোন দিকে আসছে সেটা দেখা যায়, গাড়িটির নম্বর কত, ড্রাইভার কে, তার নাম কী, টেলিফোন নম্বর কত—সেটাও টেলিফোনের স্ক্রিনে উঠে আসে। নিউ ইয়র্কে পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে বলে আমার মেয়ে এ রকম একটি গাড়ি ডেকে পাঠিয়েছে। সেটায় ওঠার আগেই টের পেলাম গাড়ির ড্রাইভার বাংলাদেশের তরুণ। আমাকে দেখে তার সে কী আনন্দ, গাড়ি চালাতে চালাতে তার কত রকম কথা, গাড়ি থেকে নামার পর সে আমার মেয়েকে বলল তার কম্পানিকে সে জানিয়ে দেবে যেন আমাদের কাছ থেকে কোনো ভাড়া কেটে নেওয়া না হয়। আমি অনেক কষ্ট করে তাকে থামালাম।
আমি দুই সপ্তাহের মতো নিউ ইয়র্ক শহরে ছিলাম। যখনই ঘর থেকে বের হয়েছি দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কখনো ফল বিক্রেতা, কখনো রেস্টুরেন্টের কর্মচারী, কখনো ট্রাফিক পুলিশ, কখনো মিউজিয়ামের গার্ড, কখনো সাবওয়ের সহযাত্রী। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এসে দেশের মানুষ ও তাদের মমতাটুকু হদয়টাকে অন্যভাবে পরিপূর্ণ করে তোলে।
২.
আমেরিকা হচ্ছে গাড়ির দেশ। এ দেশে গাড়ি চালিয়ে শুধু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি। আমেরিকায় গাড়ি হচ্ছে সেই দেশের কালচারের একটা অংশ। মাঝখানে পেট্রলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে তেলবান্ধব ছোট গাড়ির প্রচলন হতে শুরু করেছিল; কিন্তু এখন পেট্রলের দাম কমেছে বলে বিশাল বিশাল বিলাসী গাড়িও আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। খাঁটি আমেরিকানদের সম্ভবত নিউ ইয়র্ক শহরে গাড়ি চালাতে সমস্যা হয় না; কিন্তু আমার কাছে বিষয়টা রীতিমতো দুঃস্বপ্ন মনে হয়। তবে যারা নিউ ইয়র্ক শহরে থাকে তারা অবশ্য গাড়ি ব্যবহার না করেই দিন কাটাতে পারে। কারণ পুরো শহরের মাটির নিচে মেট্রো ট্রেন মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। আমি যে দুই সুপ্তাহ নিউ ইয়র্ক শহরে ছিলাম, এই মেট্রো ট্রেনেই চলাফেরা করেছি।
নিউ ইয়র্ক শহরের নতুন প্রজন্ম অবশ্য চলাফেরার জন্য নতুন আরেকটি সমাধান খুঁজে পেয়েছে। সেটি হচ্ছে বাইসাইকেল। আমি যখন প্রথম জানতে পারলাম আমার মেয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, আমি তখন জানতে চাইলাম সাইকেলটি সে কোথায় রেখেছে। রাস্তার পাশে কোনো একটা ল্যাম্পপোস্টে সাইকেলটি বেঁধে রেখে এলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইকেলের ফ্রেম ছাড়া বাকি সব কিছু হাওয়া হয়ে যায় (আমার ধারণা, এ ব্যাপারে নিউ ইয়র্কের মানুষের দক্ষতা আমাদের দেশের মানুষের চেয়ে বেশি!)। আমার মেয়ে বলল, সে নিউ ইয়র্ক শহরে এসে কোনো বাইসাইকেল কেনেনি; যখনই দরকার হয় একটা ভাড়া নিয়ে নেয়। বিষয়টা আমার কাছে যথেষ্ট বিদঘুটে মনে হলো, সাইকেল ভাড়া নিলেও ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত সেটাকে কোথাও না কোথাও নিজের হেফাজতে রাখতে হয়। পুরো সাইকেল ভাড়া নিয়ে শুধু তার কঙ্কালটা ফেরত দেওয়া হলে সাইকেল ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা দুই দিনে লাটে উঠে যাবে।
আমার মেয়ের কাছ থেকে বাইসাইকেল ভাড়া দেওয়া-নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটির বর্ণনা শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। সিটিবাইক নাম দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের অসংখ্য জায়গায় সাইকেলস্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। যার যখন দরকার হয় এক স্ট্যান্ড থেকে ভাড়া নেয়। গন্তব্যে পৌঁছানোর পর অন্য স্ট্যান্ডে জমা দিয়ে দেয়। কোথাও কোনো মানুষ নেই, পুরো ব্যাপারটা ইলেকট্রনিক। কে কোথা থেকে ভাড়া নিয়েছে, কোথায় ফেরত দিয়েছে—সব কিছু ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে হিসাব রাখা হচ্ছে এবং ক্রেডিট কার্ড থেকে ভাড়ার টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। পুরো শহরে অল্প কয়েকটা জায়গায় সিটিবাইকের স্ট্যান্ড থাকলে প্রক্রিয়াটি মোটেও কাজ করত না। কিন্তু যেহেতু শহরের প্রায় প্রতি কোনায় সিটিবাইক স্ট্যান্ড বসানো হয়েছে, কাজেই এখন কাউকেই বাইসাইকেলটা কোথা থেকে ভাড়া নিয়ে কোথায় ফেরত দেবে—সেটা নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। কাছাকাছি কোথায় সিটিবাইক স্ট্যান্ড আছে সেটা জানার জন্য দরকার শুধু একটা স্মার্টফোন!
নিউ ইয়র্ক শহরের একটা সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে এই সিটিবাইক। তাদের জন্য আলাদাভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, ডিজাইনটিও চমৎকার। একজন মানুষ চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য স্যুট পরেও এই সাইকেল চালিয়ে যেতে পারবে।
নিউ ইয়র্ক শহরের কত বড় বড় বিষয় থাকার পরও আমি ইচ্ছা করে সিটিবাইক নিয়ে আমার উচ্ছ্বাসটুকু প্রকাশ করেছি। আমার মনে হয়, আমাদের ঢাকা শহরেও কোনো একজন উদ্যোক্তা এ ধরনের উদ্যোগ নিলে সেটি শহরের মানুষের জন্য অনেক বড় একটা আশীর্বাদ হতে পারত (আমাদের দেশের জন্য হুবহু এই মডেল হয়তো কাজ করবে না, একটু অন্য রকমভাবে শুরু করতে হবে। যেমন আমাদের এটিএম মেশিন—সারা পৃথিবীতেই এটিএম মেশিনকে কারো পাহারা দিতে হয় না, আমাদের দেশে সেখানে সার্বক্ষণিকভাবে কাউকে না কাউকে পাহারা দিতে হয়)।
৩.
এটি আমেরিকার নির্বাচনী বছর। আমেরিকার ইতিহাসের যেকোনো নির্বাচন থেকে এটি অন্য রকম। কারণ এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প নামের একজন ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আমেরিকার প্রধান দুই দলের একটি রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচন করছেন। আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম তখন থেকে মানুষটিকে চিনি। তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, স্থূল রুচির বাকসর্বস্ব একজন ব্যবসায়ী। প্রথম যখন আমি শুনতে পেয়েছিলাম যে ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টি থেকে নমিনেশন পাওয়ার চেষ্টা করছেন তখন পুরো বিষয়টিকে একটা উৎকট রসিকতা হিসেবে ধরে নিয়ে আমি উড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন যখন নির্বাচন প্রায় চলে এসেছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যি সত্যি একজন প্রার্থী তখন পুরো ব্যাপারটি রসিকতার পর্যায়ে না থেকে বিভীষিকাময় পর্যায়ে চলে এসেছে। আমেরিকায় সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি বিদ্বেষ কিংবা সাম্প্রদায়িকতা, আতঙ্ক ও ঘৃণা—এগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকশনে জিতে গেলে অন্ধকার জগতের এসব গ্লানি হঠাৎ করে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার মধ্যে চলে আসবে।
আমি যত দিন ছিলাম, তার মধ্যে এক দিনও একটি মানুষকে পাইনি, যে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো কথা বলেছে। সত্যি কথা বলতে কি, একজন অধ্যাপককে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা জিজ্ঞেস করার পর তাঁকে আমি আক্ষরিক অর্থে শিউরে উঠতে দেখেছি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নানা রকম প্রচারণা চলছে। সবচেয়ে মজার প্রচারণাটা শুনেছি একজন গৃহহীন ভিক্ষুকের কাছ থেকে। সে পথের মোড়ে একটা কাগজ নিয়ে বসে থাকে। কাগজে লেখা, ‘আমাকে যদি এক ডলার না দাও, তাহলে আমি কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়ে দেব!’
আমি যত দূর জানি, এই হুমকি কাজে দিয়েছে! প্রচুর মানুষ এই ভিক্ষুককে এক ডলার করে দিয়ে যাচ্ছে।
৪.
একদিন বিকেলে আমার ছেলে আমাদের জানাল সে একটি বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে যাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন এই ব্যাপারগুলো বুঝি শুধু আমাদের দেশের জন্য একচেটিয়া, আমেরিকায়ও যে বিক্ষোভ মিছিল হতে পারে সেটা অনুমান করিনি। আমি জানতে চাইলাম, কিসের বিক্ষোভ মিছিল? উত্তরে সে আমাকে যে কাহিনীটি শোনাল, সেটি অবিশ্বাস্য।
তার একজন সহকর্মী (ঘটনাক্রমে এই সহকর্মীর সঙ্গে আমারও পরিচয় হয়েছে) লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অ্যাট ব্র“কলিন নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদ মোটামুটি সোনার হরিণ, সেখানে যোগ দিতে পারা কঠিন। কাজেই এ রকম একটি পদে যোগ দেওয়ার পরই একজন তাদের জীবন শুরু করার পরিকল্পনা করতে পারে। লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তারা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নতুন বেতন স্কেল তৈরি করেছেন, শিক্ষকদের সেটি পছন্দ হয়নি। তাই তাঁরা সেটা গ্রহণ করতে রাজি হননি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট কলমের এক খোঁচায় ৪০০ শিক্ষককে বরখাস্ত করে দিলেন! মুহূর্তের মধ্যে একজন-দুজন নন, ৪০০ শিক্ষক বেকার! সবাই একেবারে পথে বসে গেছেন। যেহেতু আমেরিকার একাডেমিক জগতে অসংখ্য মানুষ চাকরির খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভালো চাকরি না পেয়ে ছোটখাটো কাজ করে সময় কাটাচ্ছে। তাই এই ৪০০ শিক্ষকের বদলে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া খুব যে অসম্ভব ব্যাপার তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য সে রকম শিক্ষকদের নেওয়া শুরু হয়েছে, অনেকেই খণ্ডকালীন নিয়োগ পেয়ে কাজও করতে শুরু করেছেন।
বলাবাহুল্য চাকরি হারানো ৪০০ শিক্ষক, তাঁদের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এই অবিশ্বাস্য ঘটনার প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন। সে জন্য বিক্ষোভ মিছিল এবং আমার ছেলেও সেই বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিতে যাচ্ছে। আমার সময় থাকলে আমিও যোগ দিতাম।
শেষ খবর অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত বরখাস্ত করে দেওয়া ৪০০ শিক্ষককে আবার ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (আমাদের দেশে বলি ভাইস চ্যান্সেলর), যিনি এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁকে প্রচুর গালমন্দ শুনতে হয়েছে, সাধারণ শিক্ষক ও ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিলে তাঁকে একটি ‘ধাড়ি ইঁদুর’ বলে ডাকছে। আমি যত দূর জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এখনো তাঁর নিজের পদে বহাল আছেন। হার্ভার্ডের প্রেসিডেন্টকে শুধু ছেলে ও মেয়ের মেধার তুলনা করতে গিয়ে একটি বেফাঁস কথা বলার জন্য চাকরি হারাতে হয়েছিল। আমার ধারণা, লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটির এই ধাড়ি ইঁদুরও সেখানে খুব বেশি দিন থাকতে পারবেন না। আমরা আমাদের ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরদের নিয়ে মাথা চাপড়াই। মনে হচ্ছে, সমস্যাটি দেশি নয়, আন্তর্জাতিক!
শিক্ষক হওয়ার প্রধান আনন্দ হচ্ছে সারা পৃথিবীতে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কাজেই নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পর এই ছাত্রছাত্রীরা যে আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, সেটি এমন কিছু অবাক ব্যাপার নয়। সে কারণে একদিন বিকেলে তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাদের ‘জ্যাকসন হাইট’ নামে একটি জায়গায় যেতে হলো (যারা জ্যাকসন হাইটের নাম শোনেনি তাদের বলা যায়, এটি হচ্ছে নিউ ইয়র্কের মিনি বাংলাদেশ)। জ্যাকসন হাইট জায়গাটি আমি যেখানে আছি সেখান থেকে অনেক দূর; কিন্তু মেট্রো ট্রেনে খুব সহজেই যাওয়া যায়—আমি সেভাবেই যাব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রবল আপত্তি যে তারা গাড়ি না করে আমাদের নেবে না—এর মধ্যে নিশ্চয়ই যথাযথ সম্মান দেখানোর ব্যাপার আছে, যেটা আমি জানি না। কাজেই যে দূরত্বটা অল্প সময়ে অতিক্রম করতে পারতাম, গাড়ি করে ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে অনেক সময় নিয়ে অতিক্রম করতে হলো!
যা-ই হোক, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গল্পগুজব করে, খেয়েদেয়ে, ছবি তুলে চমৎকার একটি সন্ধ্যা কাটিয়ে আমরা ফিরে আসতে প্রস্তুত হয়েছি। আমরা আবার ছাত্রছাত্রীদের বলছি আমাদের মেট্রো ট্রেনে তুলে দিতে, তারা আবার রাজি হলো না, গাড়ি করে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরিয়ে দেবে। যখন মাঝামাঝি এসেছি তখন হঠাৎ করে আমার ছেলে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, কী হয়েছে? আমার ছেলে বলল, ‘ম্যানহাটানের মাঝখানে বোমা ফেটেছে, খবরদার ওই পথে ফিরে আসার চেষ্টা কোরো না।’
শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। দেশে জঙ্গি ও তাদের উৎপাতের খবর পড়তে পড়তে আমাদের সবার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম, নিউ ইয়র্ক এসে অন্তত দুটি সপ্তাহ জঙ্গিদের উৎপাতের খবর পড়তে হবে না। কিন্তু আমাদের কপাল, এখানেও সেই একই জঙ্গি, একই উৎপত্তি!
ছাত্রছাত্রীরা আমাদের কথা না শুনে মেট্রো ট্রেনে তুলে না দেওয়ার কারণে আমরা খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম। কারণ বোমা ফাটার সঙ্গে সঙ্গে মেট্রো ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, অসংখ্য মানুষ অন্য কোনোভাবে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছিল বলে ট্যাক্সি বা ক্যাবও পাওয়া যাচ্ছিল না। কাজেই আমাদের হয়তো পুরো পথটুকু হেঁটে ফিরে আসতে হতো! আমাদের ছাত্ররা তাদের গাড়িতে করে নিরাপদে একেবারে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় পৌঁছে দিয়ে গেল। আমার ছেলের অবশ্য এত সৌভাগ্য হয়নি, হেঁটে ও একজন দয়ালু ক্যাব ড্রাইভারের সহযোগিতায় অনেক কষ্টে গভীর রাতে বাসায় ফিরে আসতে পেরেছিল!
যখনই আমাদের দেশে একটি জঙ্গি হামলা হয় বাংলাদেশ সরকার তখন ঘোষণা দেয়, এটি স্থানীয় ঘটনা। আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এখানেও তা-ই হলো। নিউ ইয়র্কের মেয়র ঘোষণা দিলেন, এটি স্থানীয় ঘটনা। আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
বোঝাই যাচ্ছে, পৃথিবীটা খুবই ছোট! [সংকলিত]