Tue. Apr 29th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

15kএ এম এম শওকত আলী ।।  খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬: সারা বিশ্বে ১৭ অক্টোবর দারিদ্র্য নির্মূল দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। ঠিক এক দিন আগে অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হয়েছে। খাদ্যের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তবে স্বীকৃত হলেও এ অধিকারের বাস্তব চিত্র অনেক দেশেই আশাপ্রদ নয়। দারিদ্র্য নির্মূল ও খাদ্যের অধিকারের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। কারণ বাস্তবে খাদ্য ক্রয়ের জন্য কিছু আয়ের প্রয়োজন হয়। আর যাঁরা খাদ্য উত্পাদন করেন, অর্থাৎ কৃষক, তাঁরাও কিছু উদ্বৃত্ত খাদ্য বাজারে বিক্রি করে আয় করেন। এ আয়ের মাধ্যমে নিজ নিজ পরিবারের অন্যান্য খরচ মেটানো সম্ভব হয়।

তবে কৃষকের আয়ের সুযোগ অত সহজ নয়। কারণ অধিক ফসল বাজারে বিক্রি হলে দাম কম পাওয়া যায়। অন্যদিকে রয়েছে ফসল উত্পাদনের জন্য উপকরণ-ব্যয়। মূলত সার, উন্নত জাতের বীজ ও সেচ। উন্নয়নশীল দেশে এ ব্যয় কৃষকদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখাতে সরকার ভর্তুকি দেয়। উন্নত দেশেও একই প্রথা অনুসরণ করা হয়। এ সত্ত্বেও উন্নত দেশের রাষ্ট্রীয় বা উন্নয়ন সহায়তার অন্যতম নীতি হলো, উন্নয়নশীল দেশে কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদান সংগত নয়। উন্নয়নশীল দেশে সহায়তা প্রদানের পূর্বশর্ত হিসেবে ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য এসব দেশ সব সময়ই বিশেষ করে আশির দশকের শেষ ভাগ থেকেই অত্যন্ত কঠোর ছিল।

উন্নয়ন সহায়তা প্রদানে সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, যেমন বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক একই নীতি অনুসরণ করে। এ নীতি বাস্তবায়নে তত্কালীন বাংলাদেশ সরকারও ব্রতী হয়। কারণ এ ছাড়া বিদেশি সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে না। পরবর্তী নব্বইয়ের দশকের দুই সরকার এ নীতি বর্জন করে। ভর্তুকির বিষয়টি বিতর্কিত। তবে দারিদ্র্য নির্মূলে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। এ স্বীকৃতি এখন বিশ্বব্যাংকও দিয়েছে। ১৭ অক্টোবর প্রকাশিত এক খবরে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক যেসব দেশের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বিশ্বের সবার কাছে অনুকরণীয় হতে পারে, সেসব দেশই পরিদর্শনে যান বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এক সভায় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট উপস্থিত ছিলেন।
১৮ অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদে আরো দেখা যায় যে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, কিভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করতে হয় বাংলাদেশ আমাদের শিখিয়েছে। আরো জানা যায়, বিশ্বব্যাংক ৫০ শতাংশ ঋণ সহায়তা বাড়াবে। একই সঙ্গে সংবাদে বলা হয়েছে, সুদও বাড়বে। সুদ কত বাড়বে তা এখনো জানা যায়নি। তবে ঋণসূত্রে অর্থ সাহায্য বাড়বে। ৫০ শতাংশ বাড়লে আগামী তিন বছরে ৭৫০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা।

তবে দারিদ্র্যসহ অপুষ্টি দূর করার জন্য আগামী দুই বছরে আরো ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা তিনি দিয়েছেন। অপুষ্টি নির্মূল দারিদ্র্য বিমোচনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ অপুষ্টিও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দারিদ্র্য বলে চিহ্নিত। বিশ্বব্যাংক সূত্রে ঋণ সহায়তা বৃদ্ধির বিষয়টি নিঃসন্দেহে সুখবর। তবে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, ঋণ গ্রহণে সম্মতির আগে শর্তগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের সাবধানবাণী সংগত কারণেই দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য বিমোচনের পরিপন্থী এমন কোনো শর্ত মেনে নেওয়া ঠিক হবে না।

বিষয়টি নিশ্চয়ই সরকারি পর্যায়ে দেখা হবে। কারণ কঠিন শর্তযুক্ত ঋণ বা অনুদানের সহায়তা প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও সাহস এখন বাংলাদেশের রয়েছে। আশির দশকের মতো বাংলাদেশ এখন আর অতিমাত্রায় বিদেশি সাহায্যনির্ভর দেশ নয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করা এর এক উজ্জ্বল নিদর্শন। প্রকাশিত সংবাদে আরো দেখা যায়, গত দুই দশকে বাংলাদেশ দুই কোটি মানুষকে দরিদ্র অবস্থা থেকে মুক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো, দারিদ্র্য নির্মূল প্রক্রিয়া স্থিরীকৃত নয়।

এ বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাস্তবে দেখা গেছে, যে পরিবার আজ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে, সে পরিবার এক বা দুই বছর পর আবার দরিদ্র হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর কারণ একাধিক। বিদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যজনিত অত্যধিক ব্যয়ের কারণে অনেক পরিবার অতীতে দারিদ্র্যমুক্ত থাকলেও পুনরায় দরিদ্র হয়েছে। এ গবেষকের মতে, দারিদ্র্য মানে নিম্নমুখী দারিদ্র্য ও অত্যন্ত সীমিতভাবে উচ্চমুখী। অর্থাৎ এমন কোনো দরিদ্র মানুষ পাওয়া যাবে না, যে হতদরিদ্র থেকে আর্থিক সফলতা অর্জন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এ গবেষকের অন্য অভিমত হলো, তৃণমূল পর্যায়ে দারিদ্র্য নিরসনের প্রচেষ্টা ততটাই জরুরি, যতটা জরুরি সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা। একটি অপরটির পরিপূরক। কারণ সার্বিকভাবে জনমানুষ ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রচেষ্টায় লিপ্ত, যা সামষ্টিক দৃষ্টিতে দৃশ্যমান হয় না।

যাঁরা স্বীয় ক্ষেত্রে জীবিকা অর্জনে লিপ্ত, তাঁরা স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা নিম্ন অবস্থান থেকে মুক্ত হবে। কেউ ডাক্তার, আইনজীবী, গায়ক, টিভি ব্যক্তিত্ব, সরকারি কর্মকর্তা, খেলোয়াড় ইত্যাদি। এসব স্বপ্ন বা প্রত্যাশাই আমাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। একমাত্র এক দিনে এক ডলার উপার্জনের স্থিরীকৃত মানদণ্ডে দারিদ্র্যের অবস্থা নির্ণয় করা সঠিক নয়। অর্থাৎ তাত্ত্বিক বা পরিসংখ্যানভিত্তিক মানদণ্ডে দারিদ্র্য বিমোচনের ব্যর্থতা বা সাফল্য মূল্যায়ন করা যায় না। উল্লেখ্য, প্রায় দুই দশক ধরে বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্যের মাত্রা নির্ণয়ের মাপকাঠি এক ডলার আয়েই সীমিত ছিল। গবেষক ভারতের ক্ষেত্রে ২০০৭ সালে এক চিত্র অতি সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করেছেন।

এখানে গবেষক উল্লেখ করেছেন, ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসির অনলাইনে প্রকাশিত বিষয় ছিল, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশাতীত হয়েছে। ভবিষ্যতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাবে। কৃষি, শিল্প ও সেবা—সব খাতেই ভারতের উন্নতি হচ্ছে। ঠিক এর কিছু পরেই অন্য সংবাদটি ছিল, কলেরায় আক্রান্ত ভারতীয়রা ক্ষুধাগ্রস্ত। বিবিসি টিমের পরিদর্শনে বলা হয়, মানুষ খাদ্য পাচ্ছে না। তারা লতাপাতা খেয়ে আছে। এক বছর ধরে তারা ভাত খায়নি। জলপ্রপাত ও ড্রেন ছাড়া কোনো পানি নেই।

গবেষক এ বিষয়ে মন্তব্য করেন যে এ ধরনের বিপরীতধর্মী চিত্র উন্নয়নশীল দেশে ব্যতিক্রম নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এ ধরনের করুণ চিত্রও রয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খাদ্য উত্পাদনে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। একই সঙ্গে প্রতিবছর বিদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারি সূত্রে খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়। যার পরিমাণও কম নয়। গড়ে এক দশমিক পাঁচ মিলিয়ন টন থেকে আড়াই মিলিয়ন টন। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে বাংলাদেশ খাদ্যে, অর্থাৎ চাল উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তা হলে বলা যায়, ৩০-৩২ টাকা কেজি দরে চাল কেনার সামর্থ্য অনেক পরিবারের নেই। মাছ ও মাংসও যথেষ্ট পরিমাণে উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সত্ত্বেও বাংলাদেশে অপুষ্টির হার কম নয়। এ কারণেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের প্রাথমিক বক্তব্যে দারিদ্র্য নিরসন প্রক্রিয়ায় অপুষ্টির উল্লেখ ছিল।

১৮ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের প্রেস কনফারেন্সে আরো কিছু তাত্পর্যপূর্ণ বক্তব্য বা পরামর্শ পাওয়া যায়। নব্বইয়ের দশকের দাতাদের পরামর্শের ক্ষেত্রভেদে সহায়তার শর্ত ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এ কথা তাঁরা ভুলে যাননি। কারণ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তিনটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেন। এক. ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা। দুই. প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। তিন. শক্তিশালী সুশীল সমাজ গঠন, বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, কর আদায়, দুর্নীতি দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য প্রয়োজন হবে এসব ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক নীতি ও তার বাস্তবায়ন।

এ ছাড়া আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ কনফারেন্স থেকে জানা যায়। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলেও আপাতত সুদের হার বাড়বে না। আগের মতো নমনীয় শর্তে ঋণ দেওয়া হবে। প্রত্যক্ষভাবে নমনীয় শর্ত কী হবে তা বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে ধারণা করা সম্ভব যে সব ক্ষেত্রেই শর্তের অন্যতম প্রধান বিষয় হবে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ। অতীতেও সংস্কারভিত্তিক শর্ত ছিল। ভবিষ্যতে এর ধরন কী হবে তা বলার সময় এখনো হয়নি। ঋণচুক্তিবিষয়ক আলাপ-আলোচনার সময় এসব বিষয় আরো স্বচ্ছ হবে। ঋণ প্রদানের খাত হবে—ক. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খ. মানবসম্পদ উন্নয়ন, গ. ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন, ঘ. জ্বালানি, ঙ. আঞ্চলিক যোগাযোগ ও চ. নগরায়ণ।

এ ছাড়া সামাজিক উন্নয়নে ‘উদ্ভাবনী’ কর্মকাণ্ডের বিষয়েও জোর দেওয়া হয়েছে। সংস্কারমূলক ক্ষেত্রের মধ্যে শক্তিশালী সুশীল সমাজ গঠনের বিষয়েও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিদেশি সাহায্য দাতাগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বরাবরই কিছু আক্ষেপ রয়েছে। এ কথা কিছু দাতা সংস্থা অতীতেও প্রকাশ্যে বক্তব্যে বলে দিয়েছে। কিন্তু কোনো সুফল হয়নি। উল্লেখ্য, সুশাসনের সংজ্ঞায় সুশীল সমাজের ভূমিকার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এ নিয়ে ভবিষ্যতে কী শর্ত হবে, সেটাই হবে দেখার বিষয়।

দারিদ্র্য বিমোচনের সাফল্যে বিশ্বব্যাংকসহ সবাই যখন মুগ্ধ, ঠিক তখনই ভিন্নধর্মী অভিমতও শোনা গেছে। এ অভিমত বা সাবধানবাণী অধ্যাপক রেহমান সোবহানের বক্তব্যে দেখা গেছে। একটি বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে দেওয়া এ বক্তব্য ১৭ অক্টোবর কিছু দৈনিকে প্রকাশ করা হয়।

সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘একটি ভয়ংকর সময় পার করছি’। এর মূলকথা ছিল—দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অন্যায্যতা দূর করতে হবে। সার্বিকভাবে অন্যায্যতার কাঠামোগত ক্ষেত্র হলো, উত্পাদনমুখী সম্পদ বণ্টনে অন্যায্যতা, বাজারে অংশগ্রহণে অন্যায্যতা, বৈষম্যমূলক মান উন্নয়ন ও অন্যায্য শাসনব্যবস্থা বা সুশাসনের অভাব। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক সম্মেলনের মূল বিষয় অন্তত এক বিষয়ে অভিন্ন। তা হলো—রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক—সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা।
[সংকলিত]