Tue. Apr 29th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

31kড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ।। খোলা বাজার২৪, বুধবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৬: সবাইকে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন ও সব প্রয়াস-প্রচেষ্টায় সমন্বয়ের মাধ্যমে সার্বিক উদ্দেশ্য অর্জনের অভিপ্রায়কে অয়োময় প্রত্যয় দানই করপোরেট কালচারের মূল বাণী। একজন কর্মচারীর পারিতোষিক তার সম্পাদিত কাজের পরিমাণ বা পারদর্শিতা অনুযায়ী না হয়ে কিংবা কাজের সফলতা-ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব বিবেচনায় না এনে যদি দিতে হয়, অর্থাৎ কাজ না করেও সে যদি বেতন পেতে পারে, তাহলে দক্ষতা অর্জনের প্রত্যাশা আর দায়িত্ববোধের বিকাশভাবনা মাঠে মারা যাবেই। এ ধরনের ব্যর্থতার বজরা ভারী হতে থাকলেই যেকোনো উৎপাদনব্যবস্থা কিংবা উন্নয়ন প্রয়াস ভর্তুকির পরাশ্রয়ে যেতে বাধ্য। দারিদ্র্যপ্রপীড়িত জনবহুল কোনো দেশে পাবলিক সেক্টর বেকার ও অকর্মণ্যদের জন্য যদি অভয়ারণ্য কিংবা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করে তাহলে সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। যদি বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা না যায় উপযুক্ত কর্মক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাহলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বড় বড় বিনিয়োগও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। চাকরিকে সোনার হরিণ বানানোর কারণে সে চাকরি পাওয়া ও রাখার জন্য অস্বাভাবিক দেন-দরবার চলাই স্বাভাবিক। দায়দায়িত্বহীন চাকরি পাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকার ফলে নিজ উদ্যোগে স্বনির্ভর হওয়ার আগ্রহেও অনীহা চলে আসে। মানবসম্পদ অপচয়ের এর চেয়ে বড় নজির আর হতে পারে না। দরিদ্রতম পরিবেশে যেখানে শ্রেণি-নির্বিশেষে সবার কঠোর পরিশ্রম, কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মত্যাগ আবশ্যক, সেখানে সহজে ও বিনা ক্লেশে কিভাবে অর্থ উপার্জন সম্ভব—সেদিকেই ঝোঁক বেশি হওয়াটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রার্থীর পরিচয়ে যে অঢেল অর্থ ব্যয় চলে তা যেন এমন এক বিনিয়োগ, যা অবৈধভাবে অধিক উসুলের সুযোগ আছে বলেই। শোষক আর পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থায় বঞ্চিত-নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ উদ্ধারে নিবেদিতচিত্ত হওয়ার বদলে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব নিজেরাই যখন উৎপাদনবিমুখ আর শ্রমিক-স্বার্থ উদ্ধারের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে শোষণের প্রতিভূ বনে যায়, তখন দেখা যায় যাদের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরই তারা প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। প্রচণ্ড স্ববিরোধী এই পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উৎপাদন, উন্নয়ন তথা শ্রমিক উন্নয়ন—সবই বালখিল্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

তৃণমূল পর্যায়ে সঞ্চয়ের অভ্যাস বাড়িয়ে, বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে দেশের অর্থনীতিকে স্বয়ম্ভর করার মন্ত্র মানতে অপচয় রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। বিয়ের উৎসবে সামাজিকতার দোহাই দিয়ে নানা অনুষ্ঠানের নামে অর্থ অপচয়ে সংযমী হওয়ার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। অফিসে, ব্যবসায়, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যতটা সময় দেওয়ার দরকার তা দিয়ে নিজের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার তদারকিসহ তাদের মানসিক বিকাশবান্ধব কর্মকাণ্ড দেখভাল করা বিশেষ বিবেচনায় আনা জরুরি। প্রত্যেক নাগরিকেরই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হওয়ার মধ্যেই সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সমাজ ও অর্থনীতি পুনর্গঠনের সুযোগ নিহিত।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যেমনটি বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ মানুষই বড় কথা। এই মানুষের দায়িত্ববোধের দ্বারা কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পাদনের মাধ্যমে সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। আবার এই মানুষের দায়িত্বহীনতার কারণে সমাজের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়। মানবসম্পদ না হয়ে সমস্যায় পরিণত হলে সমাজের অগ্রগতি তো দূরের কথা, সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। মানুষের উদ্ভাবনীশক্তি সভ্যতার বিবর্তনে সহায়ক হয়। সবার সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগে সমাজ নিরাপদ বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সমাজবিজ্ঞানীরা তাই মানুষের সার্বিক উন্নয়নকে দেশ-জাতি-রাষ্ট্রের সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করে থাকেন। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণ সৃষ্টিতে মানুষের সার্বিক উন্নতি অপরিহার্য শর্ত। রাষ্ট্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার এবং দায়িত্ব নির্ধারিত আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা অধিকার আদায়ের সম্ভাবনা ও সুযোগ নাকচ করে দেয়। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি না হলে চাহিদা অনুযায়ী ভোগের জন্য সম্পদ সরবরাহে ঘাটতি পড়ে। মূল্যস্ফীতি ঘটে, সম্পদ প্রাপ্তিতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। পণ্য ও সেবা সৃষ্টি করে যে মানুষ সেই মানুষই ভোক্তার চাহিদা সৃষ্টি করে। উৎপাদনে আত্মনিয়োগের খবর নেই, চাহিদার ক্ষেত্রে ষোলো আনা—টানাপড়েন তো সৃষ্টি হবেই। অবস্থা ও সাধ্য অনুযায়ী উৎপাদনে একেকজনের দায়িত্ব ও চাহিদার সীমারেখা বেঁধে দেওয়া আছে। কিন্তু এ সীমা অতিক্রম করলে টানাপড়েন সৃষ্টি হবেই। ওভারটেক করার যে পরিণাম দ্রুতগামী বাহনের ক্ষেত্রে, সমাজে সম্পদ অর্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমণে একই পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমাজে অস্থিরতা ও নাশকতার যত কারণ এযাবৎ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে এই সম্পদ অবৈধ অর্জন, অধিকার বর্জন ও আত্মত্যাগ স্বীকারে অস্বীকৃতি মুখ্য।

রাষ্ট্রের একেকটি দপ্তর ও তার কর্মীবাহিনীর একেকজন সদস্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা আছে। সংশ্লিষ্ট সবাই স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনে আত্মস্বার্থ সিদ্ধি তথা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিলে দপ্তরের ওপর অর্পিত সেবামূলক কাজ কিংবা সম্পদ উৎপাদন হয়ে পড়তে পারে সুদূরপরাহত। দায়িত্ব পালনের নামে অর্জিতব্য রাজস্ব লোপাট হলে, পারিশ্রমিক পরিশোধ বা রাষ্ট্রের ব্যয় বা দায় বাড়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের রাজস্ব বা সেবা বা আয় না বাড়লে ডেফিশিট বাজেটিংয়ের অনিবার্য পরিস্থিতি তো সৃষ্টি হবেই। ব্যক্তির সংসারে ঘাটতি অর্থনীতির যে যন্ত্রণা—রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তা ব্যাপক বিড়ম্বনার কারণ।

বুদ্ধি ও বিবেচনা প্রয়োগ করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা বাস্তবায়নে চাই আন্তরিক প্রয়াস। সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা ঠুনকো কার্যকারণকে উপলক্ষ করে নেওয়া পদক্ষেপ দীর্ঘস্থায়ী ফল বয়ে আনে না। শুধু নিজের মেয়াদকালে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণ করলে, পরবর্তী জন পূর্ববর্তী জনের কার্যক্রমকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার রেওয়াজ শুরু হলে টেকসই উন্নতির সম্ভাবনা তো সীমিত হয়ে পড়ে। জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য দূরদৃষ্টি রূপকল্প প্রণয়নকারীর, প্রগাঢ় প্রতিশ্রুতি ও দৃঢ়প্রত্যয় প্রয়োজন হয়। সমস্যা গোচরে এলে ব্যবস্থা নিতে নিতে সব সামর্থ্য ও সীমিত সম্পদ নিঃশেষ হতে দিলে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য পুঁজি ও প্রত্যয়ে ঘাটতি তো হবেই। তেল আনতে নুন ফুরায় যে সংসারে, সেখানে সমৃদ্ধির স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সমস্যারা পরস্পরের মিত্র, একটার সঙ্গে একটার যেন নাড়ির যোগাযোগ। আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে ব্যক্তি নিরাপত্তার, ব্যক্তি নিরাপত্তার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার, সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে আয়-উপার্জনের সব কার্যক্রমের কার্যকারণগত সম্পর্ক রয়েছে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে চাই আয়-উপার্জনের সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ। শিক্ষা কর্মদক্ষতাকে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতাকে এবং কর্মদক্ষতা ও কর্মক্ষমতা উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাবে—এটাই প্রত্যাশা। সর্বত্র সেই পরিবেশের সহায়তা একান্ত অপরিহার্য, যেখানে সীমিত সম্পদের ও সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। একটাকে উপেক্ষা মানে যুগপত্ভাবে অন্য অনেক সমস্যাকে ছাড় দেওয়া। সমস্যার উেস গিয়ে সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। এ কাজ কারো একার নয়, এ কাজ সবার। সমস্যার মোকাবিলায় প্রয়োজন সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা পরিপোষণের জন্য নয়। যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য জনমত সৃষ্টিতে, আস্থা আনয়নে ও একাগ্রতা পোষণে গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য। সংস্কার বাস্তবায়ন কোনোমতেই সহজসাধ্য নয় বলেই সর্বত্র দৃঢ়চিত্ততা আবশ্যক। এখানে দ্বিধান্বিত হওয়া দ্বিমত পোষণ কিংবা প্রথাসিদ্ধবাদী বশংবদ বেনিয়া মুত্সুদ্দি মানসিকতার সঙ্গে আপস করার সুযোগ থাকতে নেই। ভারত বিভাগের পর বিগত সাত দশকে এই ভূখণ্ডে যত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্কার কর্মসূচি কিংবা ধ্যান-ধারণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাদের কমবেশি ব্যর্থতার পেছনে বিরুদ্ধবাদীদের বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্ত অবস্থান গ্রহণে অপারগতাই মুখ্য কারণ ছিল। করপোরেট কালচারকে সুবিদিত ও সুবিবেচিত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সর্ববাদী ও সমন্বয়ধর্মী মনোভাবের অভিষেক হতে হবে সবখানে, সব মুহূর্তে ও সব পর্যায়ে।

লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মুখ্য সমন্বয়কারী
[সংকলিত]