Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

14kএস এম মুকুল :- খোলা বাজার২৪, শনিবার, ৫ নভেম্বর ২০১৬ : বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণের রাজনীতি। সত্যিকার অর্থে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির স্থায়ীত্ব আনয়নে তিনি সমবায়কেই একমাত্র উপায় নির্ধারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বাইরের দেশ থেকে সাহায্য এনে এদের অভাব সাময়িকভাবে দূর করার পথ পরিহার করে স্থায়ী পথ হিসেবে সমবায়কে বেছে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে গণমুখি সমবায়ের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।’’

দেশের সিংহভাগ গ্রামের জনগণ, যারা অশিক্ষিত এবং দরিদ্র। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে একমাত্র সমবায়কে অবলম্বন হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেছেন। তিনি দরিদ্র অশিক্ষিতদের উন্নয়নের স্বপ্ন বিনির্মাণে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তাই রাষ্ট্রের মালিকানার নীতি বিষয়ে সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র মালিকানা ব্যবস্থা হবে প্রথমত রাষ্ট্রীয় মালিকানা, দ্বিতীয়ত সমবায়ী মালিকানা, তৃতীয়ত ব্যক্তিগত মালিকানা। মালিকানায় সমবায়কে দ্বিতীয় অন্যতম খাত হিসেবে স্থান দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘‘সমবায়ের মাধ্যমে গরিব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন-যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে।

অন্যদিকে অধিকতর উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদের সুষম বন্টন ব্যবস্থায় প্রতিটি ক্ষুদ্্র চাষী গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও অধিকার পাবে। জোতদার ধনী চাষীর শোষণ থেকে তারা মুক্তি লাভ করবে সমবায়ের সংহত শক্তির দ্বারা। একইভাবে কৃষক, শ্রমিক,তাঁতি, ক্ষুুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি একজোট হয়ে পুঁজি এবং অন্যান্য উপাদানের মাধ্যমে একত্র করতে পারেন তবে আর মধ্যবর্তী ধনী ব্যবসায়ী শিল্পপতি গোষ্ঠী তাদের শ্রমের ফসলকে লুট করে খেতে পারবে না। সমবায়ের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতিত দুঃখী মানুষ।’’ বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন সুফল পেতে হলে সমবায়কে সত্যিকার গণতান্ত্রায়নে নিয়ে আসতে হবে। সমবায় সংস্থাগুলোকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি ঘোষণা করেন-‘‘সংস্থার পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর, কোন আমলা বা মনোনীত ব্যক্তির উপরে নয়। দেখতে হবে যে, সমবায় সংস্থাগুলো যেন সত্যিকারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে।” বঙ্গবন্ধুর ভাষায়…এই লক্ষ্যে যদি আমাদের পৌঁছাতে হয় তবে অতীতের ঘুণে ধরা সমবায় ব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করে একটি সত্যিকারের গণমুখী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সমবায় আন্দোলন হবে সাধারণ মানুষের যৌথ আন্দোলন, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান। … ভাইয়েরা আমার- আসুন সমবায়ের যাদুস্পর্শে সুপ্ত গ্রাম বাংলাকে জাগিয়ে তুলি। … আমাদের সঙ্গবদ্ধ জনশক্তির সমবেত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হবে ‘সোনার বাংলা’।

বাংলাদেশে সমবায়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- বাংলাদেশে গণমুখি সমবায়ের সূত্রপাত করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ ১৯৭৫ স্বাধীনতা দিবসের র‌্যালীতে সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন- ‘আগামী ৫ বছরে সরকার বাধ্যতামূলকভাবে ৬৫ হাজার গ্রামে বিভিন্নমুখী সমবায় চালু করবে।’ এরফলে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার সমবায় আন্দোলনকে জোরালো ও গণমুখী করার লক্ষ্যে কৃষিতে ভর্তুকী দিয়ে সার সরবরাহ, সহজ শর্তে ঋণদান, মৎস্য সরঞ্জাম আমদানী শুল্ক রহিত, মৎস্যজীবীদের জলমহল ইজারা প্রদান, তাঁতীদের উৎপাদিত সুতা হতে নির্দিষ্ট অংশ প্রদান, তাঁত শিল্প সরঞ্জাম আমদানীতে আইন প্রণয়ন, তাঁতীদের সহজ শর্তে ঋণদান প্রভৃতি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়। ৩০ জুন ১৯৭২ বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় সম্মেলনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেনÑ ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ, খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

কেননা, সমবায়ের পথ- সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ।’ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হিসেবে সমবায়কে দ্বিতীয় স্থানে নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দেন- সমবায় হবে সম্পূর্ণ গণমুখী ও গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এর নীতি হবে সমাজতান্ত্রিক ও আন্তর্জাতিক। ১৯৭৫ সালে পরবর্তী সরকার তা পুনরায় চালু করে তবে সরকারের নিয়োগদান ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার সমবায় আন্দোলনকে জোরালো ও গণমুখী করার লক্ষ্যে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন। কৃষিতে ভর্তুকী দিয়ে সার সরবরাহ, সহজ শর্তে ঋণদান, মৎস্য সরঞ্জাম আমদানী শুল্ক রহিত, মৎস্যজীবীদের জলমহল ইজারা প্রদান, তাঁতীদের উৎপাদিত সুতা হতে নির্দিষ্ট অংশ প্রদান, তাঁত শিল্প সরঞ্জাম আমদানীতে আইন প্রণয়ন, তাঁতীদের সহজ শর্তে ঋণদান ইত্যাদি সে সময় করা হয়েছিল। তৎকালীন সেই সরকার ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিল যে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দরিদ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন একমাত্র সমবায়ের মাধ্যমেই সম্ভব।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার বঙ্গবন্ধুর দেখিয়ে যাওয়া পথ অনুসরণ করেই তাঁরই সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের দিনবদলের রূপকার আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নের্তৃত্বে রূপকল্প : ২০২১ বাস্তবায়নে সমবায়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২০২১ সালে একটি উন্নত বাংলাদেশ উপহার দেয়ার সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে রূপকল্প-২০২১। এখন দেখার বিষয় ২০১৬ সালের শেষ প্রান্তে এসে ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে সমবায় কার্যক্রম দেশের কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে। সফলতা বা অর্জন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে ২০০৪ সালে সমবায়ের শতবর্ষ অতিক্রম হয়েছে। দেশে জাতীয়, কেন্দ্রীয়ও প্রাথমিক সমিতির সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। তারপরও তুলনামূলকভাবে সমবায়ের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। সমবায়ের মাধ্যমে বহু দেশ-জাতি তাদের ভাগ্যের চাকা, বহু মানুষ-গোষ্ঠী নিজের আর্থিক অবস্থার বিরাট উন্নত করতে পেরেছে। সমবায় সমিতির মাধ্যমে সুসংগঠিত উপায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও আমানতের সমন্বয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। দেশের দেড় লাখ সমবায় সংগঠনের সাথে প্রত্ক্ষ্য-পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ৪ কোটি মানুষ এর সুফল পাবে তাহলেই কেবল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা সত্যি হবে।
এস এম মুকুল : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক, [email protected]