Tue. Apr 29th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

18kফরিদুল আলম ।। খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৭ নভেম্বর ২০১৬: হিলারিকে ধরাশায়ী করার কোনো কায়দাই কাজে লাগছে না। ট্রাম্প এবার সমালোচনায় নেমেছেন হিলারির সিরিয়া নীতি নিয়ে। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নীতি নিতে না পারার ব্যর্থতার কারণেই সিরিয়ার যুদ্ধ প্রলম্বিত হচ্ছে। একই সঙ্গে আসাদ ও আইএস উচ্ছেদের নীতিতে না গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল মনোযোগ এখন কেন্দ্রীভূত হওয়া প্রয়োজন আইএস উচ্ছেদে মনোযোগী হওয়া। তিনি মনে করেন, পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অপর শক্তিধর রাষ্ট্র ইরানের সহযোগিতা সিরিয়ার প্রতি থাকার কারণে অদূর ভবিষ্যতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। সর্বসাম্প্রতিক এমন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি হিলারিকে ঘায়েল করার আরেকটি চেষ্টা করছেন। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া নীতি প্রণয়নের অন্যতম হোতা হিলারি। গত কয়েক দিনে হিলারির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান কমে এখন মাত্র ৬ পয়েন্ট। তার পরও নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপদ ততই ঘনীভূত হচ্ছে। সর্বশেষ মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার পল রায়ান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি আর ট্রাম্পের পক্ষে কোনো ধরনের প্রচারণায় নিজেকে না জড়িয়ে বরং কংগ্রেসে নিজ দলীয় নেতাদের প্রতি বেশি মনোযোগী হবেন।
আসন্ন ৮ নভেম্বরের নির্বাচন সামনে রেখে এবার যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি অঙ্গরাজ্যকে দুই প্রার্থীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাদবাকি ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান অধ্যুষিত রাজ্যগুলোয় প্রার্থীরা তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে আছে—এমনটা ধরে নিয়ে বলা হচ্ছে মূলত এই ১৩টি অঙ্গরাজ্যের ভোটের ফলাফলই নির্ধারণ করে দেবে কে হচ্ছেন আগামী প্রেসিডেন্ট। রাজ্যগুলো হচ্ছে আরিজোনা, কলরাডো, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, আইওয়া, মিশিগান, নেভাদা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, প্যানসিলভানিয়া, ভার্জিনিয়া ও উইসকনসিন। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোকে অবলম্বন করে বিবিসি যে বিশ্লেষণ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত হিলারি ৫০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পেয়েছেন এবং বিপরীতে ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোটারের সমর্থন। এই ১৩টির মধ্যে শুধু জর্জিয়া ও ওহাইওতে ট্রাম্প হিলারির বিরুদ্ধে এগিয়ে রয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি সমর্থনের চিত্র যথাক্রমে ৪৬:৪২ এবং ৪৫:৪৪। অপর রাজ্যগুলোর মধ্যে আরিজোনা ছাড়া প্রতিটি রাজ্যেই হিলারি ট্রাম্পের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। আরিজোনায় হিলারি ও ট্রাম্পের লড়াইয়ের চিত্র হচ্ছে ৪২:৪১। অন্যগুলোর মধ্যে জরিপে হিলারি ট্রাম্পের চেয়ে ৩ থেকে ১০ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় ধারণা করা হচ্ছে, বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে হিলারিই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট। তবে এখানে আরো কিছু বিষয় নির্বাচনের ফল নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে, যেমন অন্য দলগুলোর প্রার্থীরা। হিলারি ও ট্রাম্পের বাইরে গ্রিন পার্টি ও লিবারেটারিয়ান পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইন ও গ্যারি জনসন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাঁদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বড় দুই প্রার্থীর জয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ক্ষোভ কাজে লাগানো। জিল স্টেইন পেশায় একজন চিকিৎসক, অধিকারকর্মী ও আদর্শিক কারণে ডেমোক্র্যাট পার্টির অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্সের কট্টর সমর্থক ছিলেন, যিনি হিলারিকে মেনে নিতে না পেরে নিজে প্রার্থিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং ধারণা করা হচ্ছে যে হিলারির অন্তত ২ শতাংশ ভোটারকে তিনি নিজের দিকে টেনে নিতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যদিকে গ্যারি জনসন রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের মনে এরই মধ্যে ট্রাম্পকে নিয়ে যে অসন্তোষের দানা বেঁধেছে সেটাকে আরো উসকে দিতে ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তিনিও ট্রাম্পের ৭ শতাংশ ভোটারকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এখানেও দেখা যাচ্ছে, এমন ধারার ঘটনা অব্যাহত থাকলে হিলারির বিজয় সুনিশ্চিত।
এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অতীতের কোনো নির্বাচনেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে জরিপের এতটা ব্যবধান থাকেনি এবং থাকলেও প্রার্থীরা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জরিপে একে অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতেন। এবারই শুধু দেখা গেল যেখানে শুধু দুবার ট্রাম্প খুব সামান্য ব্যবধানে জনমত জরিপে হিলারির চেয়ে অধিক সমর্থন পেয়েছেন। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে গত জুলাই মাসে রিপাবলিকান দলের সম্মেলনে ট্রাম্পকে প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পর, আর পরেরটি গত ৯/১১-র অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে হিলারি ক্লিনটন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে এবং পরবর্তী সময়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রাম নেওয়ার পর। রিপাবলিকান সম্মেলনের কয়েক দিন পর ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনে হিলারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের পক্ষ থেকে মনোনীত করার পর আবারও জনমত জরিপে ওপরে উঠে আসেন হিলারি। আর সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে দ্বিতীয়বার হিলারির চেয়ে ট্রাম্প এগিয়ে গিয়েছিলেন মূলত এটা প্রচার করে যে প্রেসিডেন্ট হতে হলে যে ধরনের শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন, হিলারির তা নেই এবং তিনি রোগ গোপন করছেন ইত্যাদি। অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যে হিলারি সুস্থ হয়ে আবারও প্রচারণায় ফিরে এলে জরিপে ট্রাম্পের সমর্থনে আবার ভাটা পড়ে যায়। এর পর থেকে শুধুই হিলারির এগিয়ে চলা। সর্বশেষ তিনটি সরাসরি টেলিভিশন বিতর্কে ট্রাম্প সাংঘাতিকভাবে নাকানিচুবানি খেয়েছেন হিলারির কাছে।
নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে প্রচারণা ততই জোরদার হচ্ছে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর কারো কাছ থেকেই নাগরিকরা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না। সব কিছু ছাপিয়ে এবারের নির্বাচনের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে পরস্পরকে ধরাশায়ী করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মূল সূচনাটা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে, যিনি মূলত হিলারির ব্যক্তিগত ই-মেইল অ্যাকাউন্ট রাষ্ট্রীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহারে হিলারিকে অভিযুক্ত করেছেন, তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁকে উদ্দেশ করে নারীদের নিয়ে একের পর এক কটু মন্তব্য করেছেন এবং সর্বশেষ তাঁর স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে নির্বাচনে ফায়দা নিতে চেয়েছেন, যা হিলারিকে এক অর্থে আত্মরক্ষার কৌশল অবলম্বনে বাধ্য করেছে, যা তাঁর দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনের পথনির্দেশনার সুযোগ অনেকটা স্ফীত করে দিয়েছে। তবে হিলারির জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রথম মেয়াদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ওবামা সরকারের এখন পর্যন্ত যে পররাষ্ট্রনীতি সেটার পরিকল্পনার পেছনে তাঁর বড় ভূমিকা রয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি নির্বাচিত হলে ওবামা নির্দেশিত পথেই হাঁটবেন সেই ইঙ্গিত প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণায় থাকার কারণে তাঁর দিক থেকে নির্বাচিত হলে কী করণীয়, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন পরবর্তী এজেন্ডা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা, যা করতে তিনি এখন পর্যন্ত চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সময়ের নাফটা চুক্তি ও বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সপ্যাসিফিক চুক্তির ঘোর বিরোধিতা করলেও মার্কিন অর্থনীতিতে এর বিকল্প ভালো প্রস্তাবনা কী হতে পারে সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। উপরন্তু তাঁর অভিবাসী ও মুসলিমবিরোধী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সুস্পষ্টভাবে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রুপের ভোট থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বঞ্চিত করা হবে দলীয় মনোনয়নের দৌড়ে থাকা অবস্থায় এমন বক্তব্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও তিনি এখন পর্যন্ত তাঁর সে সময়ের উক্তি সংশোধন করেননি। মূলত ট্রাম্পের কথার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অন্য অভিবাসীরা ২০০১ পরবর্তী জর্জ ডাব্লিউ বুশের সময়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন, যখন ৯/১১ হামলার পর ব্যাপকভাবে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই নয়, বিশ্বব্যাপী মুসলিম, ইসলাম ও অভিবাসীবিরোধী মার্কিন নীতি ব্যাপকভাবে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। বারাক ওবামার আট বছর সময় সেই অর্থে অতটা উদার না হলেও বুশের মতো আক্রমণাত্মক নীতি দেখা যায়নি। উপরন্তু বুশের সময়ে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বিজয়ী যেই হোক, ট্রাম্প কিংবা হিলারি, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সে রকম কোনো পরিবর্তনের আভাস বা নতুনত্বের স্লোগান কোনো প্রার্থীর মধ্যেই নেই। এবারের নির্বাচনে সঠিক প্রার্থী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কে কতটা উদার মানসিকতা ধারণ করেন সে বিষয়টি, যা জনমত জরিপেও উঠে এসেছে। মূলত প্রার্থীদের একের সঙ্গে অন্যের আচরণ, বক্তব্যের ধরন ও ব্যক্তিগত জীবনাচরণই এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। সেদিক দিয়ে হিলারি এগিয়ে থাকলেও এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে। সেই দিক বিবেচনায় যদি নতুন কোনো চমক সৃষ্টি হয়, তবে সেটার জন্যও যথেষ্ট সময় এখনো বাকি রয়ে গেছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় [সংকলিত]