আবু আহমেদ ।। খোলা বাজার২৪, সোমবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৬: আজ যখন পেছনের দিকে ফিরে তাকাই তখন মনে হয়—হায়, সময়টা কত দ্রুত পার হয়ে গেছে! এই তো সেদিন ছিলাম প্রাইমারি স্কুলে। সকালে ধর্মীয় শিক্ষার শিক্ষালয় মক্তব থেকে এসে ১০টার দিকে যেতাম বাড়ির সামনের প্রাইমারি স্কুলে, স্কুলটি ছিল টিনের ঘর। পরে ১৯৫৯ সালে আমরা যখন পঞ্চম শ্রেণি পাস করে বের হয়ে আসছি তখন পাকা দালান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের সেই প্রাইমারি স্কুলকে ‘মডেল’ স্কুল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা বুঝলাম, আমাদের প্রাইমারি স্কুলটা প্রথম শ্রেণির। আসলেও তাই ছিল, ওই স্কুলের শিক্ষকরা অন্য স্কুল থেকে মেধা-মননে ভালো ছিলেন। আমার শিক্ষকরা মন দিয়ে পড়াতেন। ভালো ছাত্র হওয়ার আকাক্সক্ষা সেই প্রাইমারি স্কুল থেকেই মনে জেগেছিল। আমিও আমার সেই মডেল প্রাইমারি স্কুল থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। সেই বৃত্তি পরে আমাকে এগিয়ে যেতে শুধুই সাহায্য করেছিল। হাই স্কুলেও পূর্ণ ফ্রি নিয়ে পড়েছিলাম। খরচের মধ্যে ছিল খাতা-কলমের জন্য খরচ। আর দুপুরে নাশতার জন্য সামান্য ব্যয় হতো। তা-ও কোনো দিন স্কুল লাগোয়া বাজারে গিয়ে নাশতা করতাম। একটা পরোটা ও এক কাপ চা। তখন গরুর দুধের চা অত্যন্ত উন্নতমানের ছিল। পয়সার অভাবে কোনো দিন নাশতা করতে পারতাম না। তবে না পারলেও অভাব অনুভব করিনি। একটা আশা সব সময় মনে জাগরূক থাকত, এই বুঝি আমার ষষ্ঠ শ্রেণি শেষ হলো, এই সপ্তম শ্রেণি, তারপর অষ্টম, নবম; তারপর এসএসসি পরীক্ষা, আর একটি ভালো রেজাল্ট। তাই হয়েছিল, অষ্টম শ্রেণিতেও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম। আর এসএসসিতে করলাম স্ট্যান্ড। মেধাতালিকায় প্রথমের দিকে। সত্যি সেই রেজাল্ট ছিল অকল্পনীয়। মোটেই ভাবিনি যে আমি মেধাতালিকায় স্থান নিয়ে এসএসসি পাস করব! কিন্তু তাই হয়েছে। দুপুরে শহরে গিয়ে পত্রিকা খুলে দেখলাম দুটি বিষয়ে ডিসটিংকশনস (Distinctions) নিয়ে আমি এসএসসি পাস করেছি। এর পরে এইচএসসি পড়ার জন্য প্রাচীন ও বিখ্যাত সেই চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হলাম। সেই কলেজ ছিল মেধাবীদের সৃষ্টি করার জন্য একটা বড় শিক্ষা-কারখানা। আমিও মানবিক বিভাগে ওই কলেজ থেকে এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করে পাস করলাম। অর্থনীতি নিয়ে পড়ব—সেটা কলেজে থাকতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম কলেজেও স্নাতক সম্মান কোর্সটি ছিল। ওই বিভাগের ছাত্রদের কাছে অর্থনীতি ও অর্থনীতিবিদদের নাম ও কাজ নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি। আসলে সেই সব শোনা মিথ্যা ছিল না। পরে অর্থনীতি পড়তে গিয়ে শুধু এটাই বুঝেছি, এই বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে জানতে হলে একে মনপ্রাণ দিয়ে অধ্যয়ন করতে হবে। তাই করেছিলাম। অর্থনীতি পড়তে আমার ভালো লাগত। যতই পড়তাম ততই নতুন নতুন অনেক কিছু জানতাম। একটা বিষয়ে কোনো লেখকের বই পড়ে কিছু না বুঝতে পারলে পরে দেখতাম একই বিষয়ে অন্য লেখক অনেক সহজভাবে ও বোধগম্য ভাষায় সেটা লিখেছেন। অথচ অর্থনীতি সর্বত্র প্রবেশ করেছে, এই অংশও এমন কঠিন কিছু নয়, শুধু মন দিয়ে শিখে নিতে হবে। প্রায়োগিক অর্থনীতি এমন প্রতিটি ক্ষেত্রকে দখল করে নিয়েছে। এমনকি ডাক্তারি ও হেলথ সায়েন্সের সব শাখায়ও প্রায়োগিক অর্থনীতির বহুল ব্যবহার হচ্ছে। ব্যবসা প্রশাসন নামে একটি বিষয় অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই বিষয়টিতে প্রায়োগিক অর্থনীতির বহুল প্রচলন ঘটেছে। যাঁরা ভালো অর্থনীতি জানেন, তাঁদের পক্ষে ব্যবসা প্রশাসন বোঝা অনেক সহজ। অর্থনীতি পড়তে-পড়াতে অনেক আনন্দ অনুভব করেছি। এমন কিছু কোনোদিন অনুভব করিনি যে আমি একটা রসহীন সাবজেক্ট ছাত্রদের কাছে উপস্থাপন করছি। ছাত্ররাও যাতে অনুভব করে, এ বিষয়ে জানার আছে, বোঝার আছে সেভাবেই উপস্থাপন করেছি। শিক্ষকের কাজ হলো বইয়ে যা আছে সেটাকে সহজভাবে উপস্থাপন করা, এই বইয়ে যা নেই তা-ও উপস্থাপন করা। যে শিক্ষক ভালো পড়ান সেই শিক্ষকের ক্লাসে ছাত্রদের রোল কলের মাধ্যমে ক্লাসে আনতে হয় না, তারা এমনিই শোনার জন্য-জানার জন্য আসে। ছাত্ররাই বলতে পারে কে ভালো শিক্ষক, কে মন্দ শিক্ষক। বিদেশে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, চাকরির চুক্তিপত্র নবায়নের ক্ষেত্রে ছাত্রদের মূল্যায়ন বিবেচনায় নেওয়া হয়। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ নিয়ম চালু হলে ভালো হতো।
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আমরা জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি এভাবে মাস গুনতে থাকি। গোনার মধ্যে থেকে সাল পার করে দিই। তারপর শুরু করি ফের জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি গুনতে। তার পরও এসে যায় আরেক নতুন সাল। প্ল্যান করি, আশা করি অনেক কিছু। তারপর সেই সালও শেষ। এরপর গুনতে থাকি কখন কাজ শেষ হবে। ভালো চাকরি বা কিছু করা থেকে অবসর নেব। কখন বিশ্ববিদ্যালয় বা নিয়োগদাতা বলবে, তোমার বয়স হয়ে গেছে। তোমাকে আমরা সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে চাই। তুমি ইচ্ছা করলে অবসর গ্রহণ-পূর্ব প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে যেতে পার। সেটা না নিতে চাইলে সরাসরি অবসরে যেতে পারো। তোমার স্বাস্থ্য ও কাজের ক্ষমতা যতই থাকুক না কেন, বিধি মোতাবেক তুমি ৬৫ বছরের বেশি কাজে নিয়োগ থাকতে পারবে না। চিঠি এসে গেছে। আগে থেকেই বুঝছিলাম চিঠি এসে যাবে। তাই যখন প্রকৃতই চিঠি এসে গেল তখন সে জন্য দুঃখিতও হলাম না, চিন্তাও করলাম না, সহজভাবে চিঠি নিলাম। আমি সেই চিঠি পেয়ে গেছি এখন থেকে প্রায় তিন বছর আগে; বুঝলাম চাকরি শেষে যখন অবসরে যাচ্ছি তখন কাজ থেকেও অবসরে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে বললাম, আমি কি কোনো রকমে থাকতে পারি না? বিশ্ববিদ্যালয় সদয় হয়ে আমাকে অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছুদিনের জন্য অনারারি অধ্যাপক পদে (Honourary professor) রাখতে রাজি হয়েছে। ভাবছি সেটাও তো শেষ হয়ে যাবে। হলে হবে। একদিন তো আমিও শেষ হয়ে যাব। আফসোস নেই। কাজ করেছি, ফল পেয়েছি, নিজেকে সব সময় তৃপ্ত মনে হয়েছে। আজও কাজ করি। তবে কাজের ধরন ভিন্ন। কেউ বললে বক্তৃতা দিই। কেউ বললে লিখি। আর শেয়ারবাজারের খোঁজখবর নিই। সময় আমার ভালোই কাটে। আমি অবসরে যাওয়া অন্য লোকদের কথা ভাবি। তাঁরা কোনো কাজ ছাড়া কিভাবে আছেন? তাঁদের জন্য সরকার কি বাড়তি কিছু করতে পারে? কাজ থেকে চলে এলে শরীর ও মন দুটিই দুর্বল হয়ে যায়। তবে যাঁরা তাঁদের সৃষ্টিকর্তার রহমতের ওপর পূর্ণভাবে আস্থাশীল তাঁদের ক্ষেত্রে এসব দুর্বলতা প্রকাশ্য রূপ নেয় না। তাঁরা কী পেয়েছেন, কী পাননি সেটা নিয়ে ভাবেন না। তাঁরা মনে করেন, জীবনের এই স্বল্প সময় তাঁরা সঠিকভাবে চলতে পেরেছেন কি না।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়