ওয়াহিদ নবি । । খোলা বাজার২৪, সোমবার, ২১ নভেম্বর ২০১৬: সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার পড়ে সবাই নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গেছেন। ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের মার্চ মাসে, অর্থাৎ সাড়ে তিন বছর আগে। আজ এত দিন পরে বেগম জিয়া ঘটনাটির একটি ব্যাখ্যা দিলেন। ঘটনাটি যখন ঘটে বা বেগম জিয়া ঘটান, তখন মানুষ অবাক হয়ে গিয়েছিল। আজ সাড়ে তিন বছর পরে মানুষ আবার অবাক হলো বেগম জিয়ার ব্যাখ্যা শুনে। যখন বেগম জিয়া এই ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন, তখন মানুষ শুধু অবাক হয়নি; লজ্জায় সবার মাথা নত হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে সৌজন্য সাক্ষাতের কথা ছিল বেগম জিয়ার। কিন্তু তিনি গেলেন না। অজুহাত হিসেবে হরতালের কথা বললেন। হরতালটি ডেকেছিল বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামী। ইন্টারভিউটিতে বেগম জিয়া বলেছেন, তিনি যখন ভারত সফরে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে বড় আকারের অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদানে বেগম জিয়া যা করেছিলেন, তাতে তিনি এবং তাঁর দলের লোকেরা কেমন বোধ করেছিলেন জানি না, তবে তাতে দেশবাসীর মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল।
অতিথিকে সম্মান করা সৌজন্যবোধের অংশ। অতিথির অসম্মান নিজেরই অপমান। বেগম জিয়া বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন। দেশের একটি বড় দলের নেত্রী ছিলেন তিনি। তিনি দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রাষ্ট্রীয় অতিথির সম্মান-অসম্মানের ব্যাপারগুলো তাঁর জানার কথা। সবাই তাই মনে করেছিল যে জেনেশুনেই তিনি কাজটি করেছিলেন। বিএনপির রাজনীতির চরিত্র যাঁরা জানেন, তাঁরা মনে করেছিলেন যে যেহেতু ভারতবিরোধিতা বিএনপি রাজনীতির অঙ্গ, তাই তিনি কাজটি করেছিলেন। কিন্তু দলীয় রাজনীতির চরিত্র যাই হোক দেশের মান-সম্মানের একটা ব্যাপার আছে। রাষ্ট্রীয় সৌজন্যের একটা ব্যাপার আছে। ব্যক্তিগত বা দলীয় ব্যাপার যা-ই হোক এমন কিছু কারো করা উচিত নয়, যাতে নিজের দেশের মাথায় লজ্জা নেমে আসে। এখানে শুধু একটি দেশের ব্যাপার নয়। একটি দেশকে অপমান করলে অন্যান্য দেশ সেটাকে ভালোভাবে নেবে না। এর ফলে দেশ শুধু যে সৌজন্যের অভাবের জন্যই অভিযুক্ত হবে না, অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভাঙলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মোদি যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন তাঁর প্রতি বিএনপি বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব দেখায়। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এর কারণ হয়তো এই যে যেহেতু কংগ্রেসকে আওয়ামী লীগের প্রতি বন্ধুসুলভ মনে হয়, কাজেই মোদির দল বিএনপির প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হবে। শত্রুর শত্রু বন্ধু হবে। এটা সব সময় হয় না। এখানে রাষ্ট্রের ব্যাপার আছে, সরকারের ব্যাপার আছে। দলকে সব সময় শুধু দলের কথা ভাবলে চলে না। বেগম জিয়া ও মোদির বৈঠকের যে বর্ণনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে এই সত্য স্পষ্ট করে প্রকাশ পেল। ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রতি যে অসম্মান দেখানো হয়েছিল সেটা মোদি পছন্দ করেননি। এখানে শুধু প্রণব মুখার্জি আর মোদির বিষয় নয়। এটা শুধু বিএনপি আর বিজেপির ব্যাপার নয়। এখানে দেশ ও সরকারের বিষয় জড়িত আছে। এসব কারণে মোদির কাছে বিএনপি খুব একটা সহযোগিতা পায়নি।
গত সাড়ে তিন বছর বিএনপি সমালোচিত হয়েছে প্রণব মুখার্জির প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি তাদের ব্যবহারের জন্য।
সাড়ে তিন বছর পরে বেগম জিয়া হরতালের মধ্যে চলাচলে প্রাণনাশের আশঙ্কার কথা বললেন। এমন একটা ব্যাপার জড়িত থাকলে বিএনপি অবশ্য তা করতে পারে যা তারা করেছিল। কিন্তু এত দিন পরে কেন তারা এসব কথা বললেন? যে কারণেই তারা এমন ব্যবহার করে থাকুন না কেন, তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু প্রাণনাশের ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস করবে কি? সাড়ে তিন বছর ধরে দল সমালোচিত হয়েছে। সাড়ে তিন বছর ধরে নেত্রী সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু প্রাণনাশের কথা কেউ বলেননি। আসলে কেউ কিছু বলেননি। আজ সাড়ে তিন বছর পরে এমন কথা বলায় নানা কথা উঠবে। কে এই তথ্যের উৎস্ত তিনি কি বিশ্বাসযোগ্য? তিনি যদি বিশ্বাসযোগ্যই হবেন, তবে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়নি কেন? উৎস নির্ভরযোগ্য হলে প্রাণনাশের ব্যাপারটা সবাই মেনে নিত। বিএনপি সমালোচিত হতো না। বেগম জিয়া সমালোচিত হতেন না। কিন্তু এত দেরি করে প্রাণনাশের বিষয়টি উল্লেখ করায় বিষয়টি কিভাবে সবাই দেখবে, সেটা চিন্তার বিষয়। বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলে এবং এত দেরি করে বিষয়টি প্রকাশ করার কারণ বলতে না পারলে বিএনপি হাসির পাত্রে পরিণত হবে।
সাক্ষাৎকারে বেগম জিয়া আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে আলাপ করাটাকে তিনি শেখ হাসিনার চাতুরী বলে উল্লেখ করেছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অবিশ্বাসের কোনো ব্যাপা নেই বলে উল্লেখ করেছেন। দলের সংস্কারপন্থীদের ব্যাপারে সময়মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইবেন। নিজের ব্যক্তিগত বিষয়েও তিনি আলোচনা করেছেন। ছোট ছেলের মৃত্যু এবং বড় ছেলের বিদেশে অবস্থান সত্ত্বেও তিনি একাকিত্ব বোধ করেন না। কারণ জনগণকে তিনি আপন মনে করেন।
আলোচনায় দুটি বড় বিষয় উঠে আসেনি। এর একটি হচ্ছে দশ ট্রাক অস্ত্র ও অন্যটি বাংলার মাটিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের আশ্রয়দান। মোদি এ দুটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। গত ১০ বছরে এই প্রথম তিনি সাক্ষাৎকার দিলেন। দেখা যাক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কিভাবে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন!
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো [সংকলিত]