এ এম এম শওকত আলী ।। খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর ২০১৬: ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সম্পর্কিত হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ তথ্য গত ১১ নভেম্বর একটি পত্রিকার প্রধান খবর ছিল। চূড়ান্ত রায়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রধানত পুলিশ ও র্যাবের সদস্যদের জন্য পালনীয় ১৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনার মধ্যে ছিল—এক. কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার বিষয়টি লিপিবদ্ধ করে ওই ব্যক্তির সই নিতে হবে; দুই. গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়কে বিষয়টি ১২ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে; তিন. গ্রেপ্তার করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চাইলে পুলিশকে তার পরিচয়ের কার্ড দেখাতে হবে; চার. গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি স্বজনসহ তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন; পাঁচ. গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করা কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলে তার লিখিত বিবরণ প্রকাশ করতে হবে; ছয়. গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বললে পুলিশ ওই মামলার অনুলিপি আদালতে পেশ করতে বাধ্য থাকবে; সাত. প্রচলিত আইন অমান্য করে কোনো পুলিশ বা র্যাবের সদস্যের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং আট. অন্তরীণ (preventive detention) আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা ব্যক্তির জন্য পৃথকভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে না। ১৯ দফা নির্দেশনার মধ্যে ওপরে বর্ণিত অনুশাসনগুলোই প্রধান ছিল। এসব অনুশাসন পুলিশপ্রধানকে সব সদস্যের মধ্যে বিতরণ করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। আলোচ্য খবরে রায় সম্পর্কিত বিষয়ে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তার সবটাই বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় আটক ও পুলিশি হেফাজতে কোনো গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে নেওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ সম্পর্কিত বিষয়াবলি। অর্থাৎ প্রায় পুরোটাই ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত। উদ্দেশ্য হলো এসব ধারার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে নিরপরাধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নির্যাতন বন্ধ করা। প্রকাশিত তথ্যে পুলিশ বিধির কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। পুলিশের কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৪৩ সালে পুলিশ বিধি প্রণয়ন করা হয়।
১৯৪৩ সালের পুলিশ বিধি দুই খণ্ডে প্রকাশ করা হয়। এরপর পুলিশের কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়টি লক্ষণীয়। বিশেষ করে প্রতি বিভাগে পৃথক মহানগর পুলিশসহ র্যাবের সৃষ্টি। এদের আইনও পৃথক। এরা ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ও ১৯৪৩ সালের পুলিশ বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। বিদ্যমান বিধি আদৌ মহানগর পুলিশ বা র্যাবের প্রতি প্রযোজ্য কি না সে বিষয়টি অস্পষ্ট। যেকোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্মের উৎস ওই সব বাহিনীর প্রতি প্রযোজ্য আইন ও বিধি। পুলিশ ও র্যাব আইজি পুলিশের অধীনস্থ হলেও এই দুই বাহিনীর আইন আলাদা। বিধি র্যাব আইনে হয়েছে কি না জানা নেই। কারণ র্যাবের জন্মের উৎস আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের রেগুলেশন। পুলিশের বিধিতে গ্রেপ্তার, হেফাজত ও তদন্তের একাধিক ধারায় ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির মূলধারা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের এই আইন ও পুলিশের বিধিকে বর্তমানে অকেজো বলে এর সংস্কারের কথাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। এ যুক্তি যে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, তা বলা যাবে না। তবে ঢালাওভাবে এ ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সুদূর অতীতের ওই আইন ও বিধিতে নাগরিক অধিকার রক্ষার অনেক ধারা এখনো বিদ্যমান। উদাহরণ হলো, যেকোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারের জন্য হাজির করার কথা রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধিতেই এ ধারা প্রথম সংযোজন করা হয়। পুলিশের বিধিতে এর পুনরাবৃত্তি করা হয় এবং সবশেষে আমাদের সংবিধানেও এর উল্লেখ রয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড পূর্ববর্তী অথবা রিমান্ডে থাকাকালীন অবস্থায় নির্যাতন না করার বিধানও আমাদের সংবিধানে রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে অন্তত দুটি ধারায় পরোক্ষভাবে এর বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছে। উদাহরণ হলো—এক. ফৌজদারি কার্যবিধির একটি ধারায় উপযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক রিমান্ডের কোনো আদেশ না থাকলে বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি পুলিশি হেফাজতে রাখা নিষিদ্ধ করা আছে; দুই. এ ধরনের গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি নিজেই জামিন বা মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেতে পারেন এবং তিন. রিমান্ডের পর বিচারিক আদালতে কোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেওয়ার সময় ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটকে একটি সই করা লিখিত বক্তব্য দিতে হয়। এতে বলা থাকে যে তিনি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে বলেছেন যে ওই ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য নয় এবং স্বীকারোক্তি দিলে এটা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হবে। এ ছাড়া লিখতে হয় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি স্বপ্রণোদিত হয়ে অর্থাৎ কোনো চাপে না পড়ে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে।
এবার সুপ্রিম কোর্টের ১৯ দফা নির্দেশনার প্রধান বিষয়গুলো আলোচনা করা যায়। আগে উল্লিখিত প্রথম নির্দেশনা হলো, কোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার বিষয়টি লিপিবদ্ধ করে ওই ব্যক্তির সই নিতে হবে। যেকোনো গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির গ্রেপ্তার করার বিষয় লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা ফৌজদারি কার্যবিধিতে রয়েছে। এর আইনি নাম হলো কেস ডায়েরি। এ বিষয়টি কোনো মামলার তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আইন অনুযায়ী এ ডায়েরি আসামি বা অন্য কোনো ব্যক্তি দেখতে পারবে না। নির্দেশনার বিষয়টি ভিন্নতর বলে মনে হয়। এটা পুলিশের গ্রেপ্তারবিষয়ক প্রতিবেদন। নির্দেশনায় বলা নেই যে সই করার আগে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি লিপিবদ্ধ বিষয়টি দেখে সই করবে। এর অপব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। চূড়ান্ত রায়ের দ্বিতীয় নির্দেশনা হলো, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়কে বিষয়টি ১২ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে হবে। এ ধরনের কোনো নির্দেশনা ফৌজদারি কার্যবিধি বা পুলিশ বিধিতে নেই। নাগরিক অধিকার রক্ষায় এ নির্দেশনা মেনে চললে খুবই ভালো হবে। তিন নম্বর নির্দেশনা হলো, গ্রেপ্তার করার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চাইলে পুলিশকে তার পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। উল্লেখ্য, ইউনিফর্ম পরিহিত অথবা সাদা পোশাকের পুলিশকে নিজস্ব পরিচয়পত্র বহন করার বিধান পুলিশ বিধিতে রয়েছে। তবে কাউকে দেখানোর কথা স্পষ্টভাবে বলা নেই। যে দৃষ্টিকোণে বিচার করলে এ নির্দেশনা নাগরিক অধিকার সুসংহত করবে। পরিচয়পত্র না চাইলেও তা দেখানোর বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হলে আরো ভালো হতো।
এ বিষয়ে আরো বলা যায়, বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে থানাহাজতে পাঠানোর আগে তাকেই টেলিফোনে বিষয়টি আত্মীয়স্বজনকে জানানোর অধিকার সংরক্ষণ করা হলে আরো উত্তম হতো। চার নম্বর নির্দেশনা হলো, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি আত্মীয়স্বজনসহ তার আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে পারবে। এ নির্দেশনাও পুলিশ মেনে চললে তা নাগরিক অধিকার রক্ষায় সহায়ক হবে। পাঁচ নম্বর নির্দেশনা হলো, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করা হলে তার বিবরণ প্রকাশ করতে হবে। বলা যায়, এ বিষয়টি গ্রেপ্তারসংক্রান্ত তথ্য জানার অধিকার রক্ষা করবে। স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করবে। ছয় নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছে যে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখালে পুলিশকে ওই মামলার অনুলিপি আদালতে পেশ করতে হবে। এ নির্দেশনাও হয়রানিমূলক মামলা থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
সাত নম্বর নির্দেশনার বিষয় হলো, প্রচলিত আইন অমান্য করে গ্রেপ্তার করা হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের পদক্ষেপ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নেওয়া বাঞ্ছনীয় কিন্তু তা বাস্তবে হয় না। সব ক্ষেত্রেই প্রত্যাহার অথবা ‘ক্লোজড’ করা হয়। বে আইনিভাবে আটক করা ফৌজদারি কার্যবিধিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত নয়। এখন যা করা হয় তা হলো, কদাচিৎ বিভাগীয় মামলা যা ফলপ্রসূ নয়। অথবা পথভ্রষ্ট পুলিশ সদস্যকে দূরের কোনো জায়গায় দণ্ডমূলক শাস্তি হিসেবে বদলি করা হয়। বদলি কখনো দণ্ড হতে পারে না। এটাই প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক বিধি। সবশেষে আট নম্বর নির্দেশনা হলো, অন্তরীণ আইনের আওতায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে পৃথকভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে না। এ নির্দেশনাও নাগরিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক হবে। কারণ অন্তরীণ আইনে কোনো জামিনের বিধান নেই। ওই আইনে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আসামি মুক্তি পায়।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ও পরে পুলিশের নির্যাতন রোধ করার বিধান পুলিশ বিধিতেই দৃশ্যমান। এ-সংক্রান্ত বিধির আওতায় গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে থানাহাজতে পাঠানোর আগে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে ওই ব্যক্তিকে পরীক্ষা করার বিধান রয়েছে। উদ্দেশ্য হলো তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন অথবা তিনি সুস্থ আছেন কি না তা নির্ণয় করা। এ বিধির পাদটীকায় বলা হয়েছে যে এর উদ্দেশ্য হলো পুলিশ সদস্যদের গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে নির্যাতনের অভিযোগ থেকে রক্ষা করা কিন্তু বাস্তবে তা দেখা হয় কি না এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কী কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রযোজ্য আইন ও বিধি অমান্য করে নাগরিক অধিকার নির্বিচারে ক্ষুণ্ন করছেন তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আমাদের সংবিধানে এসব বাহিনীকে বলা হয় শৃঙ্খলা বাহিনী (Disciplined Force)। বাস্তবে এর বিপরীত চিত্র দৃশ্যমান। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এ বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞাত, তা নয়। তাঁদের কারো কারো মতে, একাধিক কারণে দুর্নীতিসহ অন্যান্য অনিয়ম রোধ করা যাচ্ছে না। যেমন নিয়োগে অনিয়মসহ রাজনৈতিক প্রভাব। পক্ষান্তরে অতীতে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাবের কথা নাম প্রকাশ না করে মিডিয়াকে বলেছেন। এর জন্য পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো (Chain of Command) ভেঙে গেছে মর্মে অভিযোগ রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে জনমনে প্রশ্ন হলো, সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা আদৌ নাগরিকদের আইনি অধিকার সুরক্ষা করতে পারবে কি না। উল্লেখ্য, আলোচ্য নির্দেশনার পর আরো একটি বে আইনি বিষয় মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। তা হলো, যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেই হাতকড়ার ব্যবহার। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও হাতকড়ার ব্যবহার যে বাধ্যতামূলক নয় সে বিষয়টি পুলিশ বিধিতে উল্লেখ করে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আইন ও বিধি মানা হচ্ছে না। পুলিশের স্বপক্ষে যা বলা যায় তা হলো, সব কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যই এ ধরনের বে আইনি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত নন। কিন্তু যারা এ ধরনের বে আইনি আচরণে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা একমাত্র পুলিশ কর্মকর্তারাই নিতে পারেন। সর্বোচ্চ আদালতসহ জনগণের এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা [সংকলিত]