Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

3kখোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর ২০১৬: দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার পুকুরি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন নূর আলী। জন্ম থেকেই পা দুটি বিকলাঙ্গ তাঁর। হাত দুটোও সরু। একটি চোখ ট্যারা। মনে মনে অনেক কষ্ট অনুভব করেন তিনি।। কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম, অদম্য সাহস আর সীমাহীন মনের জোরেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে তিনি হার মানিয়েছেন দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার নূর আলী খোন্দকার। সবকিছুকে ছাপিয়ে হতে চান একজন আদর্শবান শিক্ষক। আদর্শবান শিক্ষক হয়ে তিনি দেশ ও জাতির উন্নয়নে অংশীদার হতে চান।

দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার পুকুরি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন নূর আলী। ফুলবাড়ী উপজেলার তেঁতুলিয়া দ্বিমুখী দাখিল মাদ্রাসা থেকে ২০০০ সালে বিজ্ঞান বিভাগে দাখিল ও মানবিক বিভাগ থেকে পাশ করেন এবং হাকিমপুর ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০০৬ সালে এইচএসসি ও ২০১০ সালে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। পরিবারে চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বড় ভাই, বোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। বাবাও ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। হয়তো সে কারনেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর দুচোখ ভরা স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার।

২০১৩ সালে প্রি-প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। যেখানে তাঁর রোল নং- ছিল ২০৭৭৬। মৌখিক পরীক্ষায় আবেদন ও সনদপত্র জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে জমা দিতে গিয়ে তিনি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ একরামুল হকের সাথে সাক্ষাত করেন। মোঃ একরামুল হক তাঁকে আশ্বস্ত করেন, তাঁর প্রাপ্য কোটা থাকলে অবশ্যই তা পূরণ করা হবে। কিন্তু তা আর পূরণ করা হয়নি। মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলে রহস্যজনকভাবে তাঁকে বঞ্চিত করা হল। কি কারণে চাকুরীটা তাঁর হল না তা আজ পর্যন্ত অজানাই থেকে গেছে। অথচ তাঁর যোগ্যতার পক্ষে দুটি কোটা আছে।একটি হল সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত ‘প্রতিবন্ধী’ সনদ ও বাবার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে পোষ্য সনদের কোটা।এবং ২০০৬ সালে প্রাইমারি শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন প্রশিক্ষণ গ্রহণেরঅগ্রাধিকার সনদ আছে। কারও কাছে কোন অভিযোগ করলেন না তিনি। আবার হালও ছাড়লেন না।

পরের বছর ২০১৪ সালে প্রি প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বিজ্ঞপ্তিটা আবারও তাঁর চোখে পড়ে, আবেদন করলেন। অনেক কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফুলবাড়ি থেকে দিনাজপুরেএকা এসে পরীক্ষায় অংশ নিলেন। এবারও রাখলেন মেধার স্বাক্ষর। লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে তাঁর রোল নম্বর ৩৭৭০০ দেখতে পাওয়া গেলো । আবারও ভাইভা দেয়ার পালা। দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েও তাঁর চাকুরীটা হয়নি। বারবার কোন এক অজানা কারণে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এবারও কাউকে কোন কথা বললেন না তিনি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বারবার লিখিত পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়ে তিনি যেন সমাজের মানুষদের এই বার্তাই দিচ্ছিলেন, “আমি অক্ষম নই, প্রতিবন্ধী বলে আমার যোগ্যতাকে ছোট করা হচ্ছে।” বুকে অদম্য সাহস নিয়ে লক্ষ্য পূরণে অনড় নূর আলী ২০১৫ তে আবারও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন প্রি প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়। তবে এবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। যেটির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৬ তে। এবারও তিনি লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। যেখানে পরীক্ষায় তাঁর রোল নম্বর হচ্ছে ১০৮৭৫। বাবা মরহুম মনসুর আলী খোন্দকার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর বাবা বাংলাদেশ স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। অথচ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া কোন সুযোগ সুবিধা পাননি। কারন অন্য সব কাগজপত্র থাকলেও তাঁর মুক্তিবার্তা নম্বর নাই। অথচ তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র সচিব মহোদয় কর্তৃক প্রদেয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদ পত্র তাঁরআছে। এছাড়াও ইয়ুথ ক্যাম্পে ৩ নং ক্রমিকেও তাঁর বাবার নাম তালিকাভূক্ত আছে। ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার কর্তৃক প্রদত্তসাব সেক্টর ৬ এর এ দিনাজপুর থেকে ছাড়পত্র প্রদানের সনদ আছে। সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ১০ নং ক্রমিকেও তাঁর বাবার নাম তালিকাভূক্ত আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সর্বশেষ অনলাইনে আবেদন করা চূড়ান্তভাবে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই হবে ডিসেম্বরের মাসে। কিন্তু তখন আর তাঁর চাকুরী হওয়ার কোন সুযোগ থাকবেনা। তাঁকে পরনির্ভরশীল হয়ে পুরো জীবনটাই কাটাতে হবে।জেলা প্রশাসক মহোদয় ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের প্রতিতাঁর অনুরোধ,যেন তারঁ বিষয়টি এবার সুবিবেচনার সাথে দেখা হয়।

নূর আলী তাঁর প্রাপ্য যোগ্যতার সম্মানটুকু চান। তিনি বলেন,মানুষের কিছ না কিছুু শারীরিক সীমাবন্ধতা থাকতেই পারে, তাই বলে তাদের প্রতিবন্ধী হিসেবে ছোট করে দেখা ঠিক নয়। প্রতিবন্ধীদের কাজ করার সুযোগ দিলে তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না, রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবেই জীবন যাপন করতে পারবে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর কাছে তাঁর সশ্রদ্ধ অনুরোধ, “আমি দুইবার লিখিত পরীক্ষায় নির্বাচিতহয়ে কোটা থাকা সত্বেও চাকুরী পাইনি, আমি আমার দু:খের কথা কার কাছে গিয়ে জানাবো?” বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি আরও বলেন,আমি মানসিকভাবে খুব হতাশ। এখন আমার সরকারি চাকুরীতে আবেদন করার বয়স শেষের দিকে। আর মাত্র কয়েক মাস বাকি আছে। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না। আমি সারা জীবন কারও অনুকম্পা নিয়ে বাঁচতে চাই না। অত্যন্ত বিশ^াস নিয়ে তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এবার আমাকে নিরাশ করবেন না।আমি সম্মানের সাথে মাথা উুঁচু করে বাঁচতে চাই। একজন আদর্শবান শিক্ষক হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে চাই, কারণ আমার বাবাও যে একজন মুক্তিযোদ্ধা।”