মোহাম্মদ সোহেল । খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ০২ ডিসেম্বর ২০১৬: আমি মুসলিম, আমার পরিচয় আমি বাঙ্গালী। আমার জাতি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবই বাংলাকে ঘিরে। আমার প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার। বাংলাদেশ এবং মিয়ারমারের সীমানা জুড়ে রয়েছে নাফ নদী। আজ সেই নাফ নদী পেরিয়ে আমার কানে ভাসছে মিয়ারমারে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা-নির্মম নির্যাতন-বিতাড়িতের কান্নার আওয়াজ। এ আওয়াজ শুধু আমি নয়, বিশ্ব বিবেকে নাড়া দিচ্ছে। বিকড় আওয়াজে আমি আর চুপ থাকতে পারিনি। আমাকেও আওয়াজ দিতে হচ্ছে মানবতার স্বার্থে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে এ নির্মম নির্যাতনের করুন চিত্র প্রকাশ পেয়েছে।
এক ভয়াবহ নির্মমতার রাষ্ট্র এখন মিয়ানমার। জাতিসংঘের তথ্যমতে রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠি। শত শত বছর ধরে তারা নির্যাতিত ও নিপিড়ীত হচ্ছে। আজ মিয়ানমারের মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের কান্নায় পৃথিবীর আকাশ ভারী হয়ে উঠছে। মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুরা বাচাঁও বাচাঁও বলে আর্তচিৎকার করছে। মায়ানমারের বর্বর সরকার তাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাচ্ছে। হত্যা করছে অসংখ্য নিষ্পাপ শিশু, যুবক, বৃদ্ধাদের। ধর্ষণ করে কলঙ্কিত করছে অসংখ্য মা-বোনদের। বিধবা করছে হাজারো নারীদের। সন্তানহারা করছে অসংখ্য মাকে। স্বামীহারা করছে অসংখ্য স্ত্রীকে। ভাইহারা করছে অসংখ্য বোনকে। মুসলমানদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়েই থেমে নেই সেখানকার সেনা-পুলিশরা। মুসলমানদের ধর্মী উপাসনলয় মসজিদ, পবিত্র কোরআন শরীফ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ইমাম-মুয়াজ্জিনের উপর নির্যাতন শেষে পৈচাসিক কায়দায় খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিম পরিবারের উপর নির্যাতনের ঘটনা লোমহর্ষক থেমে নেই। মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের আহাজারীতে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠছে।
কোথায় আজ বিশ্ব মুসলমানদের সহযোগীতা ও ভ্রাতৃৃত্বের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলো। নীরব কেন আজ মানবধিকার সংস্থা? নিশ্চুপ কেন জাতিসংঘ?। পৃথিবীতে দেড়শ কোটি মুসলমান থাকার পরও কেন দেশে-দেশে মুসলমানরা আজ নির্যাতিত? মুসলমানগণ কি আমাদের কেউ নন?
মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের মদদেই সেনা-পুলিশ মিলে মুসলিম নির্মূলের নামে জঘন্যতম পন্থায় চিরুণী অভিযান চালাচ্ছে। তাদের সাথে এ নির্মম বর্বরতায় যোগ দিয়েছে সেখানকার বৌদ্ধ স¤প্রদায়। মানুষ হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণই প্রমাণ করে- মিয়ানমার সরকার একটা অসভ্য বর্বর-নিকৃষ্টতম জাতি। প্রকৃত অবস্থা জানতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার কর্মীদের মিয়ারমারের রাখাইন এলাকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মিয়ানমারের নোবেল শান্তি বিজয়ী নেত্রী অংসান সুচির নিরবতাই প্রমাণ করে এ গণহত্যাকে তিনি সমর্থন করছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর নিন্দাসহ সুচির নোবেল প্রত্যাহার করে নিতে বিশ্ব¦জুড়ে লাখ লাখ মানুষ আজ আওয়াজ তুলছেন। এ নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। বাংলাদেশেও উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। এমন জঘন্যতম বর্বরতা বন্ধে জাতিসংঘ মিয়ানমার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি কিংবা আন্তর্জাতিক আদালতে দাড় করার কথা। কিন্তু তা না করে জাতিসংঘ বাংলাদেশের বর্ডার খুলে দিতে বলেছে। এতে মিয়ানমার থেকে মুসলমান বের করে দেবার বিষয়ে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জাতিসংঘ আরো বলছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা নির্মূল করতে চায়। সে দেশের সেনারাও সরাসরি এ অপরাধে জড়িত। এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কমিটি (ওআইসি)’র জোরাল ভূমিকা না থাকার বিষয়টিও ভালভাবে নিচ্ছেন না বলে একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
জাতিসংঘের এ কথাও অজানা নেই যে, আমার রাষ্ট্র বাংলাদেশ মানবিকতার দেশ। মিয়ানমারে গণহত্যা-মানবিকতা বিপর্যয় রোধে যে কোন শান্তিপূর্ণ সমাধানে পাশে থাকার অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের ঘোষণা এবং বাংলাদেশের অবস্থান জানার পর পরই চীনের বর্ডার খুলে দিয়ে মানবতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাদেশের এই মানবিকতার প্রশ্নে চীনও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চিকিৎসা-খাদ্য-বস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। বহু রোহিঙ্গা মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে।
মিয়ারমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম নির্যাতন এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে গোটা বিশ্বের অমুসলিম শক্তি আজ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। আমরা এখনও নিশ্চুপ! রোহিঙ্গা মুসলমানদের কিই বা দোষ ছিল? যার কারণে তারা আজ নির্মম-জুলুম নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে? কারণ একটাই ওরা যে মুসলমান। ধর্মীয় পার্থক্য ও বৈপরিত্যের কারণেই রোহিঙ্গাদের উপর মায়ানমারের সামরিক জান্তা, প্রশাসন ও বৌদ্ধ এবং সা¤্রাজ্যবাদী গোষ্ঠিরা তাদের উপর সীমাহীন জুলুম চালাচ্ছে।
এ সহিংসতার মধ্যদিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমান স¤প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় মিয়ানমার সরকার, যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় ও জাতিসংঘসহ মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, অতি দ্রুত দাঙ্গা বন্ধ করার ব্যবস্থা করুন এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিরাপদে বসবাসের সুযোগ করে দিন নতুবা এর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক-ইয়ুর্থ জার্নালিস্টস ফোরাম বাংলাদেশ, নোয়াখালী জেলা শাখা এবং নোয়াখালী প্রতিনিধি- দৈনিক সংবাদ প্রতিদিন। ই-মেইল[email protected]