ম. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া।। খোলা বাজার২৪, রবিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০১৬: মানুষ, পৃথিবী, কল্যাণ, শান্তি ও অংশীদারি—এই পাঁচ মূল এজেন্ডা সামনে রেখে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি উদ্দেশ্য অর্জনের রূপকল্প নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে থাকা জাতিসংঘ প্রণয়ন করেছে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০’। এবারের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ও তাই ‘টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ি, ১৭টি লক্ষ্য অর্জন করি’।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী বসবাসরত প্রায় এক বিলিয়ন প্রতিবন্ধী মানুষের প্রত্যাশার কতটুকু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে, তা আজ নতুন করে ভাবনার বিষয়। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজির বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে আমাদের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের দেশে বিপুল এই প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণ আজ সময়ের দাবি। এ জন্য প্রথমত প্রয়োজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি নির্ভরযোগ্য জরিপ বা পরিসংখ্যান। দ্বিতীয়ত, প্রতিবন্ধিতা সংবেদনশীল বাজেট ও শিক্ষা। সঙ্গে প্রয়োজন তাদের টেকসই জীবনধারা, মানবাধিকার, জেন্ডার সমতা, শান্তি ও সব ধরনের বৈষম্য দূরীভূত করার নতুন এক সংস্কৃতির চর্চা। আর এ চর্চার মূল শক্তি ‘প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি’। তাহলেই আজ ২৫তম আন্তর্জাতিক ও ১৮তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় অনেকাংশে সার্থক ও অর্থময় হবে ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানমতে, বিশ্বের ১০-১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। তাদের কেউ জন্মগতভাবে, কেউবা জন্ম-পরবর্তী অসুস্থতার কারণে, কেউ দুর্ঘটনা কিংবা কেউবা ভুল চিকিৎসার কারণে প্রতিবন্ধিতার শিকার। তাদের মধ্যে ধরন অনুসারে বিশ্বের মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ৩২ শতাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, ২৭.৮ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধী, ১৮.৭ শতাংশ শ্রবণপ্রতিবন্ধী, ৩.৯ শতাংশ বাকপ্রতিবন্ধী, ৬.৮ শতাংশ মানসিক প্রতিবন্ধী ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতার শিকার ১০.৭ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরিপের আওতায় এ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখেরও বেশি। যদিও জরিপটি এখনো চলমান। এই বিশাল প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর চিরন্তন মর্যাদা, মূল্য ও সমান অধিকার আদায়ে জাতিসংঘ ১৯৯২ সাল থেকে ৩ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ পালন করে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুনভাবে স্বপ্ন দেখান। প্রতিবছর দিবসটি শুরু হয় প্রতিবন্ধী মানুষের স্বপ্নপূরণের আরেকটি নতুন সকাল হয়ে। কখনো তা পূরণ হয়, আবার কখনো হয় না। তবে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের কল্পিত সোনার বাংলা প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়ে গড়ে উঠছে এবং ভবিষ্যতেও হয়ে উঠবে এ প্রত্যাশা আজ দেশে বসবাসরত এক কোটি ৭০ লাখ প্রতিবন্ধী মানুষের। দেশে এ বছর প্রথম দেশসেরা সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অ্যাওয়ার্ড, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কর্মরত সফল প্রতিষ্ঠান ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায় ও কল্যাণে নিয়োজিত সফল সমাজসেবক অ্যাওয়ার্ড রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রদান করতে যাচ্ছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নবতর উদ্যোগ দেশে বসবাসরত প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার আদায়ের পথ আরো সুগম করবে এবং পরিবর্তিত হবে এ সম্প্রদায়ের প্রতি মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির।
দেশে ২০০৭ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (সিআরপিডি) গৃহীত হওয়ার পর রাষ্ট্র তথা সমাজে প্রতিবন্ধিতা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এ সনদ স্বীকৃতি দিয়েছে, প্রতিবন্ধিতা কোনো অস্বাভাবিকতা নয়, বরং মানববৈচিত্র্যের অংশ। প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের মধ্যকার ভিন্নতার মতো প্রতিবন্ধিতাও ভিন্নতারই অংশ। সনদের আলোকে এর মধ্যেই দেশে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’ প্রণীত হয়েছে। এ আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক অধিকার সমুন্নতকরণ অনেকাংশে সহায়ক হবে। তা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে জাতীয় পর্যায়ে সব ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যদিও এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে পাঁচটি লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের কথা যুক্ত করা হয়েছে। লক্ষ্যগুলোর মধ্যে ৪-এ উল্লিখিত প্রতিবন্ধী মানুষের শিক্ষা, ৮-এ কর্মসংস্থান, ১০-এ অসমতা দূরীকরণ ও ১১তে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশাধিকার, নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে। এ লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হলে প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা।
বাংলাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম একটি। তথাপি এখনো অনেক শিশু আছে যারা শারীরিক বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার, আর্থসামাজিকভাবে ঝুঁকিগ্রস্ততা, দরিদ্রতা, দুর্গম এলাকায় বসবাস, পথশিশু কিংবা উপজাতি শিশু হওয়ার কারণে বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। দেশের প্রায় ৩৫ লাখ প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু স্কুলগামী। তাই তাদের টেকসই উন্নয়নে সরকারের প্রতিবন্ধীবান্ধব শিক্ষাক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তা ছাড়া দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকল্পে দেশে একটি ‘বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন আজ সময়ের দাবি। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মসংস্থানের দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী যুবক ও যুবতী কোনো কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এর পেছনের মূল কারণ উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, কর্মবান্ধব পরিবেশ না থাকা, কর্মস্থলে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবন্ধী কোটা যথাযথভাবে অনুসরণ না করা। দেশের কর্মক্ষম প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য একটি প্রতিবন্ধীবান্ধব অর্থনৈতিক জোন স্থাপন করা হোক; যেখানে প্রতিবন্ধী মানুষগুলো চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বিকাশে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার বিশ্বব্যাপী কিছুটা সুনিশ্চিত হলেও আজ অবহেলিত তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের পাশাপাশি তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃত হওয়ায় স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সব স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এক ন্যায্য দাবি। এতে কিছুটা হলেও সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি বৈষম্যতা কিংবা অসমতা দূরীভূত হবে। তা ছাড়া এখনো সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশাধিকার, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত নয়। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নয়, প্রয়োজন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। সমস্যা সমাধানে প্রশাসনিক অঙ্গীকারের চেয়ে বড় প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এই বোধ সৃষ্টি হোক অপ্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে—এবারের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর এটাই একান্ত চাওয়া।
লেখক : চেয়ারপারসন, মৃত্তিকা প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন
[সংকলিত]