আলী যাকের ।। খোলা বাজার২৪, সোমবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬:
দেখতে দেখতে ডিসেম্বর চলে এলো। ডিসেম্বর এলেই মনটা যেন আনন্দে ভরে যায়।
এই মাসটির সঙ্গে বাঙালির জীবন, একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, বিজয় আমাদের সবার অন্তরে গাঢ়ভাবে আঁকা হয়ে আছে। সেই সঙ্গে ঘটেছে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়। জন্ম নিয়েছে ‘বাংলাদেশ’। এটিই আধুনিক বিশ্বে বাঙালির প্রথম বাংলা রাষ্ট্র। এখানে আমরা সবাই উদ্দীপনা নিয়ে স্লোগান দিয়েছি ‘জয় বাংলা’। আমরা নিঃশঙ্কচিত্তে আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতিচর্চা শুরু করেছি। উদ্যাপিত হচ্ছে প্রতিবছরই বাংলা নববর্ষ। সেই ষাটের দশকে ছায়ানট ও রবীন্দ্রপ্রেমীদের আয়োজনে যেমন উদ্যাপন শুরু হয়েছিল ১ বৈশাখে বাঙালির নববর্ষ, তা পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়েছে। ঢেউ তুলেছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই উদ্যাপনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রার। এই শোভাযাত্রা বর্ণময় করে তুলেছে নববর্ষের উৎসবকে। অবশেষে জাতিসংঘ এগিয়ে এসেছে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। বৈশ্বিক স্বীকৃত মিলেছে এই শোভাযাত্রার। ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এই বর্ণিল শোভাযাত্রাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে। আমরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি।
এবারে ফেরা যাক ডিসেম্বরের কথায়। এই মাসটা এলেই মনটা যেন কেমন-কেমন করে ওঠে! মনে হয়, আমার জীবনের সুদূর অতীতে ফিরে যাই আমি। চারটি দশক আগে। যখন বতর্মান ও ভবিষ্যতের করণীয় সব কাজ হঠাৎ করেই যেন থেমে গিয়েছিল। ফিরে যাই সেই সময়ে, যেই সময়টি আমার সারা জীবনকে ছেয়ে আছে। সারা জীবনের ওপর সব সময় প্রভাব বিস্তার করেছে। মনে পড়ে, আমার প্রথম সন্তান যখন জন্মগ্রহণ করে ১৯৭৬ সালে, আমার কোনো এক বন্ধু আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘জীবনে এর চেয়ে আনন্দের সময় কি তোমার কখনো এসেছে?’ আমার ভাবতে হয়নি। আমি বলেছিলাম, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল ১৯৭১ সালের ওই ৯ মাস। শুনে আমার স্ত্রী একটু বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু যা সত্য, তা তো আমাকে স্বীকার করতেই হবে। আমি বলেছিলাম যে ওই সময়ে যে কাজ করেছি, যে কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মোৎসর্গ করেছি, সেটি ছিল এ দেশের জন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অতএব দেশের সব মানুষ যেন তখন আমার সন্তান হয়ে গিয়েছিল। যখন দেশটি স্বাধীন হলো, সবার মুখে হাসি দেখলাম। মনে হলো এমন সুখের সময় আর জীবনে কখনো আসেনি। কখনো আসবে না। আজকে এই কলামটি লিখতে বসে আমি ভাবছি। কিছু এলোমেলো চিন্তা আমার মনে। ভাবলাম ডিসেম্বর নিয়েই লিখব।
ভাবতে বসে হঠাৎ মনে হলো, কী এমন লিখব, যা নতুন শোনাবে? যা আমার পাঠকরা কখনো পড়েননি? খুঁজে খুঁজে হয়রান, খুঁজে পাই না তো কিছু। এ কারণে খুঁজে পাই না যে সেই সময়ের, ১৯৭১ সালের সেই গৌরবোজ্জ্বল ৯ মাসের যত আবেগ-অনুভূতি, যত স্মৃতি, যত অভিজ্ঞতা সবই তো বলা হয়ে গেছে। পর মুহূর্তেই ভাবি, সবই বলা হয়ে গেলেও বলার তো কত কিছুই থাকে বাকি! বা বাকি যদি না-ও থাকে নতুন করে কেনই বা সেসব স্মৃতি, সেসব অভিজ্ঞতা আবারও বলব না? কারণ প্রতি দু-এক বছরেই তো সংযোজিত হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের সেই মানুষরা, যাদের এসব খবরাখবর জানা দরকার। এসব অভিজ্ঞতার কথা বোঝা দরকার এবং তারপর কেন দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল, কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল, কোন পথে যাবে, কেন সেই পথে যাবে, সে বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। এই যে বিষয়টি, এটি আমরা সবাই প্রায় ভুলে যাই। আমাদের যাদের সৌভাগ্য হয়েছিল সেই গৌরবমণ্ডিত সময়ে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করার, তাদের পরের যে প্রজন্ম, যাদের সেই অভিজ্ঞতা হয়নি কিংবা জন্ম হয়েছিল যুদ্ধের সময় কী যুদ্ধের পরে এবং অপরাজনীতির প্রভাবে পড়ে যারা সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়েছিল বা ভুিলয়ে দেওয়া হয়েছিল বা জানতে দেওয়া হয়নি কিভাবে, কোথা থেকে এই যে আমার দরিদ্র স্বদেশ কিন্তু স্বাধীন-মুক্ত বাংলাদেশ, তার জন্ম হয়েছিল। কারা এই জন্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, কিভাবে ইতিহাস এগিয়ে গিয়েছিল তখন, যখন নিরস্ত্র একটি মানবগোষ্ঠী সশস্ত্র হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘স্বাধীনতা চাই। ‘
লক্ষণীয় যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যে যুদ্ধের শুরু ও ১৬ ডিসেম্বর ওই একই বছর যে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অজর্নের মাধ্যমে, সেই যুদ্ধ ছিল আপামর জনসাধারণের যুদ্ধ। যে কারণে এটাকে ‘গণযুদ্ধ’ বলা হয়ে থাকে। এবং এই যুদ্ধে বাংলাদেশের সব মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে, তাদের যার যে পেশাই হয়ে থাকুক না কেন। আমরা যেমন দেখেছি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে যাওয়া মানুষ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তেমনি পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস, আনসার, সরকারি কমর্চারী সব পদের সাধারণ মানুষ এমনকি মুটে, মজুর, কৃষকরা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। দেশ স্বাধীন করার জন্য। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য। তারা সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে বুঝতে পেরেছে যে এ দেশের মুক্তি অনিবার্য। এ দেশের মুক্তি না হলে তাদের মুক্তি নেই। এটা ভেবেই তারা অংশগ্রহণ করেছে, আত্মত্যাগ করেছে এবং দেশের বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ। এটি নিয়ে অনেক ধরনের বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি করা হয়েছে পরে, বিশেষ করে যখন বঙ্গবন্ধুকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এই যে হত্যার চক্রান্ত, এই চক্রান্তটি ছিল কতিপয় পাকিস্তানমনা মানুষের চক্রান্ত এবং এতে যোগ দিয়েছিল সেসব মানুষ—সেই কুলাঙ্গাররা, যারা এ দেশের সব আদর্শ, চেতনা, মূল্যবোধ পায়ের নিচে পিষে ফেলে আবার একটি নব্য পাকিস্তান সৃষ্টি করার চিন্তা করেছিল। এমনকি কতিপয় ‘মুক্তিযোদ্ধা’ যারা বাধ্য হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে, সেই ক্রান্তিকালে, তারা পর্যন্ত ওই পাকিস্তানি চক্রান্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে ‘বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধা’ কথাটার অর্থ কী? যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী অস্ত্রধারী সব বাঙালিকে হত্যা শুরু করে। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমর্রত বাঙালিদের কতিপয় অফিসার বাধ্য হয়ে যুদ্ধে যুক্ত হয়েছিল। তারা প্রকৃত অর্থে মুক্তিযোদ্ধা নয়। এটিই হচ্ছে বাস্তবিক কথা। তবে সুখের কথা হলো এই যে তারা ছিল সংখ্যায় অতি সামান্য। দেশের বেশির ভাগ মানুষ ও সেনাবাহিনীর সদস্যের বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস ছিল। তারা দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিল বাংলাদেশের মুক্তিতে। আমরা শুনি অনেকেই মাঝেমধ্যে বলে থাকে যে বঙ্গবন্ধু নাকি মুক্তির বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। এই বিতর্ক সৃষ্টি করা হয় একটি ধোঁয়াশা তৈরির জন্য, যাতে পাকিস্তানিদের চক্রান্ত আবার ফলবতী হয় এই বাংলায়।
আমরা যদি একটু লক্ষ করি, তাহলে দেখব যে সেই সময় অর্থাৎ মার্চ ১৯৭১ সালে কিংবা তারও পরবর্তী সময়ে দেশের আপামর জনসাধারণ দেশের একজন নেতাকেই চিনত, তিনি ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। যদি গ্রামবাংলার হতদরিদ্র চাষিকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘আচ্ছা, স্বাধীনতার ডাক কে দিয়েছিল?’ তার উত্তর একটাই ছিল তখন। তারই নিজস্ব ভাষায় সে বলত ‘কে আবার? ওই শেখ!’ এই যে শেখ মুজিবের প্রতি ভালোবাসা মানুষের, এই যে বিশ্বাস, এই যে আস্থা, এটি নস্যাৎ করা কখনোই সম্ভব হয়নি। কখনো সম্ভব হবে না। সে জন্যই আমরা দেখতে পাই যে পরে যারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনাস্থা প্রচার করেছে, বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করেছে, যারা এই দেশে তাঁকে হত্যা করে নতুনভাবে পাকিস্তান সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, তারাই দেশের বিরোধী যে কতিপয় মানুষ ছিল, তাদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। বাংলাদেশের আদর্শকে নস্যাৎ করতে নেমেছে। এখন তো সব স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধী, তাদের বিচার যখন হচ্ছে তারা যেমন সমর্থন পাচ্ছে পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের তেমনি পাকিস্তানেরও বটে। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশবিরোধী তথা রাষ্ট্রবিরোধীদের পক্ষে সমর্থন এবং সেই সমর্থনে সায় দিয়েছে বাংলাদেশে বসবাসকারী পাকিস্তানি পুঙ্গবরা। ডিসেম্বরে এসব কথা মনে পড়ে যায়। ডিসেম্বর এলেই মনটা যেমন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে ১৬ ডিসেম্বরের সূর্যোদয় দেখার জন্য, ঠিক একইভাবে মনটা আবার মলিনও হয়ে যায়, দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে যায় কিছু চক্রান্তকারী এখনো যে বাংলাদেশে বিচরণ করছে তাদের কারণে। অবাক লাগে তারা যখন গণতন্ত্রের কথা বলে। সর্বপ্রথম তো বাংলাদেশে বিশ্বাস করতে হবে! বাংলাদেশে বিশ্বাস করতে হলে, বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’কে স্বীকার করে নিতে হবে। বাংলাদেশে বিশ্বাস করতে হলে, বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’কে স্বীকার করে নিতে হবে। বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে সব আদর্শ, চেতনা ও মূল্যবোধ নিয়ে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে বিশ্বাস করতে হলে, বাংলাদেশের ‘চার রাষ্ট্রীয় স্তম্ভ’কে বিশ্বাস করতে হবে। না হলে রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যেতে হবে। অতএব এগুলো বিশ্বাস করে, এই মৌলিক বিষয়ে বিশ্বাস করে, শুধুই তখন রাজনীতি কেমন হবে, গণতন্ত্র শুদ্ধ কি অশুদ্ধ—সেই সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করা সম্ভব। তা না হলে তাদের কোনো অধিকার নেই এই বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো কথা উচ্চারণ করার। তারা সর্বার্থে বাংলাদেশবিরোধী। ভিনদেশি।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
[সংকলিত]