
তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ।। খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬: জন্ম শব্দটির সাথে মিশে আছে চিরন্তন সত্য আর একটি শব্দ মৃত্যু। এর চাইতে কঠিন সত্য আর কি আছে পৃথিবীতে? জন্মেছেন যিনি মৃত্যু তার হবেই হবে। তথাপি কিছু কিছু মৃত্যু কে মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়। যদি সে মৃত্যুটি হয অসময়ে, অস্বাভাবিক। আর ব্যক্তিটি যদি হন অনণ্য অসাধারণ। বরুণ রায় এঁর মৃত্যুটি তেমনই একটি মৃত্যু। ২০০৯ ইং সালে ৮ ডিসেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া চিন্ন করে পর পারে চলে যান। অতি আপন জনের মৃত্যুর মতোই তাঁর মৃত্যুর দু:সংবাদটি আমাকে চরম ব্যাথিত করেছিল। কোন এক সময় বরুন রায় কে জেনেছি একজন মমহান মুক্তিযোদ্ধের সংগঠক ও অতুলনীয় ব্যক্তি হিসেবে। তাঁর মৃত্যুতে প্রগতিশীল রাজনীতির অপুরণীয় ক্ষতি হলো। এই শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বরুণ রায় নামটি ছিল অতি উজ্জ্বল নাম। তিনি তাঁর সারা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের দাবী আদায়ের ও মুক্তির লক্ষ্যে তীব্র আন্দোলন-সংগ্রামে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে আরাম-আয়েশ ও ভোগ বিলাসের জীবন ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের কাঁতারে এসে দাঁড়িয়ে তিনি স্থান করে নিয়েছিলেন মানুষের মনের গভীরে। মানুষের কল্যানে নিবেদিত অগ্নী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কিংবদন্তি পুরুষ হিসেবে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর সাদাসিধে ও সৎ জীবন যাপন ধারা অনণ্য উদাহর হয়ে থাকবে।
বরুণ রায় নামে তিনি এতই খ্যাতি ও পরিচিতি ছিলেন যে, এই নামের আড়ালে তার আসল নামটি ‘প্রসূন কান্তি রায়’ ঢাকা পড়ে যায। তিনি একই ভুখন্ডে তিন তিনটি ভিন্ন রাজত্বে শাসনামলের অধীনে বসবাস করে বিচিত্র অভিঞ্জতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছিলেন। একজন প্রাঞ্জ রাজনীতিবিদের সচেতন সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে তিনি তিনটি কালকে অবলোকন করে গেছেন। এই নক্ষত্রের সততা ও সংগ্রামী জীবন আদর্শের কথা নতুন প্রজন্মের তরুণ-যুবদের দেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ করবে বলে আশা করছি। কমরেড বরুন রায় এমনই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন যার জীবন ছিলো সকল ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার উর্দ্ধে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রসুন কান্তি রায় ডাক নাম বরুন রায় জন্ম গ্রহন করেন এক এতিহ্যবাহি আলোকিত জমিদার পরিবারে। তাঁর পিতা করুণা সিন্ধু রায় জমিদারি পরিচালনায় জড়িত না হয়ে প্রথম জীবনে নিজেকে মানুষ গড়ার কারিগড় হিসেবে নিয়োজতি করে পরবর্তীতে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। তিনি প্রজার ভুমির উপর প্রজাস্বস্ত প্রতিষ্ঠার নেতা হিসাবে কৃষকদের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন। বরুণ রায়ের জন্মস্থান পিতৃভুমি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী থেকে অনেক -অনেক দূরে ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী ‘পাটনা’য়। তাঁর পিতামহ রায় বাহাদুর কৈলাস চন্দ্র রায়, বিহার রাজ্রেও শিক্ষ বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারী ছিলেন। সেই সুবাদে বরুন রায়ের পিতা মাতা তার পিতার কর্মস্থল পাটনায় বসবাস কালেই সেখানে বরুন রায় জন্ম গ্রহণ করেণ। এমন এক সমৃদ্ধ পরিবারে উত্তরাধীকার নিয়ে বরুন রায় জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর পিতার কলেজ জীবনের বন্ধু ও সহপাঠি ছিলেন সুভাসচন্দ্র বোস। তাঁরই সহচর্যের প্রভাবেই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। নিজে জমিদার হয়েও জমিতে প্রজাস্বত্বের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করেন।
আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি কৃষকদের নিয়ে আন্দোলন করে কৃষকদের প্রাণের দাবী প্রজাস্বত্বের অধিকার প্রতিষ্টা করেন। তাঁর পারিবারিক এমন অসংখ্য বর্ণাঢ্য বর্ণনা রয়েছে। বরুণ রায় সিলেট এমসি কলেজে বিএ ক্লাশে অধ্যায়নরত অবস্থায় ১৯৪৮ সালে পরীক্ষার প্রক্কালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি সেই আন্দোলনে জাঁপিয়ে পড়েন। এমন পারিবারিক ঐতিহ্য ও চেতনায় বরুন রায় জন্মগ্রহণ করলেও সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের কথা বলতেই তিনি রাজনীতিতে সংক্রিয় হয়ে পড়েন। বরুন রায় সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে জেল খেটে, নির্যতিত হয়ে মানব কল্যানে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন।
পাকিস্তানী অন্ধকার যুগের এক নন্দীত বিপলবী জননেতা বরুন রায়। মাতৃভুমি ও জনগনের কল্যাণে জীবন উজার করে তিনি আজীবন ত্যাগের রাজনীতি করেছেন। জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দিনগুলো হয় জেলে না হয় আত্মগোপনে কাটিয়েছেন তিনি। ৭১ এ মুক্তিযোদ্ধে তিনি অনণ্য সাহসী সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধস্থ বাংলাদেশের পূর্ণগঠনে ও ৭৫ পরবর্তী দু:সময়ে মুক্তিযোদ্ধের অর্জন ও চেতনা ধরে রাখতে তিনি অকুতোভয় সৈনিকের মতোই দায়ীত্বশীল ভুমিকা পালন করেছেন। সাধীনতার বেশ ক’ বছর পরের কথা, আমি তখন প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র। স্কুল ছুটির পর আমাদের বাড়িতে হঠাৎ দেখি অনেক মানুষের ভীড়। খুবই কষ্টে ঘরে ঢুকলাম। আম্মার কাছে জানতে চাইলাম এত মানুষ আমাদের বাড়িতে কেন ? আম্মা বলছিলেন বরুন বাবু আইছইন। তোমরা এখন দুরে যাও খাওয়া-দাওয়ার পরে আইসো। শতশত মানুষ ঠেলে খুব কষ্টে গেলাম বরুণ বাবুর সেহাসীষ আমার প্রায়াত কাকা শফিকুর রহমান চৌধুরী কাছে। তিনি আমাকে কোলে তুলে বরুণ বাবুর কাচে নিয়ে পরিচয় দিলে তিনি আমার গালে ধরে আদর করেন। তখন আমার বাবা মফিজুর রহামান চৌধুরীর সাথে কি যেন গুরুত্ব দিয়ে কথা বলছিলেন। কিছু দিন পরই দেখি বরুণ বাবুর ছবিসহ “তালা চাবি” মার্কার পোষ্টার এসেছে আমাদের ঘরে। আব্বা আর কাকা আমাকে ডেকে সারা গ্রামে বরুন বাবুর পোষ্টার লাগানোর দায়িত্ব দিলেন। আমি আমার সহপার্টিদের নিয়ে সারা গ্রাম জুড়ে বরুণ বাবুর পোষ্টার লাগিয়েছিলাম। আমার কাকা ছিলেন তাঁর একজন খুব কাছের দলীয় কর্মী।
শৈশবের এমন মধুর স্মৃতিতে আজ শ্রদ্ধার সাথে মনে পড়ছে সেই কিংবদন্তি নেতা বরুন রায় কে। এই মহান সংগ্রামী জননেতা ১৯৮৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে ৮ দল কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেব সুনামগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকা (জামালগঞ্জ, ধরমপাশা, তাহিরপুর) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদসদস্য থাকা কালে তিনি এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৭ সালে তাঁকে কারাবণ করতে হয়। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের বজ্র কন্ঠের কারণেই তিন জীবনের বেশীর ভাগ সময়েই জেল খেটেছেন। সাধীনতার মাসে ৮ ডিসেম্বর তাঁর সপ্তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও লাল সালাম জানাই।
লেখক, সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, জামালগঞ্জ প্রেসক্লাব, সুনামগঞ্জ।