Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

15kমেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.) : খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬:  নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২২ ডিসেম্বর, অর্থাৎ আগামী বৃহস্পতিবার। শেষ সময়ে এসে সংগত কারণেই সব পক্ষের প্রচার অভিযান এখন তুঙ্গে।
নারায়ণগঞ্জ শহর ভোটের আমেজ ও উত্তাপে মাতঙ্গ এবং সরগরম। দেশ থেকে বহু দূরে বসেও টান টান একটা উত্তেজনার আভাস পাচ্ছি এবং অনুভবও করছি। এর একটা বাড়তি কারণ বোধ হয় যে এবারই প্রথমবারের মতো নারায়ণগঞ্জে মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে। এ পর্যন্ত যা বোঝা গেছে, তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সিটিং মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী ও বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনের মধ্যে যথারীতি মেয়র পদের জন্য মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কে জিতবেন আর কে হারবেন তা নিয়ে জ্যোতিষী সাজা ঠিক নয় বলে মনে করি। তবে মেয়র পদে ভোট যেহেতু দলীয় ভিত্তিতে হবে, তাই দুই দলের প্রার্থীই নিজ নিজ দলের রিজার্ভ ভোট পাবেন। তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এগিয়ে থাকবেন। কারণ ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হিসাব করলে দেখা যায়, বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ গড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে আসছে। যদিও এই চারটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে দুইবার বিএনপি এবং দুইবার আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। এর একটি কারণ হতে পারে, জাতীয় নির্বাচনে মোট প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হারের সঙ্গে সংসদ সদস্যপদ প্রাপ্তির শতকরা হারের কোনো মিল থাকে না। কিন্তু মেয়র পদ একটাই। এখানে যিনি গণনায় সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনিই নির্বাচিত হবেন। এ রকম একক পদের জন্য সুয়িং ভোট অর্থাৎ দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে ওঠে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের ভোটের ওপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করবে। সুয়িং ভোট সাধারণত তাঁর পক্ষেই বেশি যাওয়ার কথা, যিনি ভোটারদের বিবেচনায় তাঁদের জন্য বেশি কাজ করতে পারবেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এটা এখন সবাই জানেন, সরকারদলীয় প্রার্থী জয়ী হলে যত বেশি কাজ করতে পারেন এবং বিপদে-আপদে মানুষকে সাহায্য করতে পারেন অন্য দলের প্রার্থী জয়ী হলে তা পারেন না। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আরো দুই বছর ক্ষমতায় আছে। তারপর ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে কী হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এটা বলা যায়, বিগত কয়েক বছর একটার পর একটা ব্লান্ডার করায় জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপি যত দূর পেছনে চলে গেছে, তা কভার আপ করা দুরূহ ব্যাপার হবে।
নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি দুই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেছে। সে সময় বিএনপির কার্যকলাপ ও পারফরম্যান্স মানুষের মনে থাকার কথা। তারপর এত দিনে দেশের ভেতরে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি, কোনো সংস্কার তারা আনেনি। মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য, সম্ভাবনাময় ও বাস্তবসম্মত কোনো ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা তারা তুলে ধরতে পারেনি। অন্যজন খুব খারাপ, এমন ঢালাও বক্তব্য তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মানুষ গ্রহণ করবে না। জানতে চাইবে আপনি কেমন, আগে কী করেছেন, ভবিষ্যতে ভালো করবেন তার বাস্তবসম্মত প্রমাণ কোথায়? সুতরাং দলীয় ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জের মেয়র পদের নির্বাচনে দল হিসেবে বেছে নেওয়ার মতো নতুন কোনো আকর্ষণ বিএনপি সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই বিএনপির সর্বশেষ আমল অর্থাৎ ২০০১-০৬ মেয়াদের শাসনে বাংলাদেশের মানুষ আবার ফিরে যেতে চাইবে, সেটি কারো ভাবনায় আসার কথা নয়। অনেক কিছু ঘটতে পারে, তবে গণতন্ত্র তো যুক্তির কথা বলে, তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করতে চায়। রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর সম্পর্কে মানুষ এখন অনেক সজাগ। প্রার্থী হিসেবে সেলিনা হায়াত আইভী ও অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে তাতে বোঝা যায়, দুজনকেই মানুষ মোটামুটি সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জানে। আইভীর জন্য অতিরিক্ত ক্রিডেনশিয়াল তিনি পরীক্ষিত, গত পাঁচ বছর মেয়র ছিলেন। তিনি অভিজ্ঞ ও সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি তাঁর রয়েছে। গত পাঁচ বছরে পত্রপত্রিকায় আইভী সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক খবর দেখা যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে অনৈতিক কার্যকলাপ ও গুণ্ডা-বদমায়েশ লালন-পালন করার কোনো অভিযোগ নেই। সুতরাং প্রার্থিতার তুলনায়ও আইভী এগিয়ে আছেন। এত সময়ে যে বিশ্লেষণ তুলে ধরলাম সেগুলো বিএনপির নীতিনির্ধারকরা সবাই জানেন। তবে এ কথা ভাবার কারণ নেই যে জেনেশুনে শুধু হেরে যাওয়ার জন্য বিএনপি নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিএনপির আসল উদ্দেশ্য কী বা কী করতে যাচ্ছে, তা এ মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে এটা বোঝা যায়, এই সময়ে স্থানীয় একটা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চেয়ে এখন বিএনপির জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ডিরেইলড অর্থাৎ লাইনচ্যুত অবস্থান থেকে জাতীয় রাজনীতির মূল ট্র্যাকে ফিরে আসা। দল হিসেবে টিকে থাকার জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচনে একটা সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করা বিএনপির জন্য অনেক বেশি জরুরি। এ জন্য তাদের এখন নতুন নতুন রাজনৈতিক ইস্যু দরকার। ইতিমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে তারা একটা ইস্যু তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন নারায়ণগঞ্জের সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইস্যু তৈরি করতে পারলে নির্বাচন কমিশন গঠনে তাদের প্রস্তাবনার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার মতো একটা কিছু উপাদান হাতে পাবে বলে তারা ভাবতে পারে। পাঁচ বছর আগে নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের বিগত নির্বাচনের সময় এমন একটা চেষ্টা বিএনপি করেছিল। তখনো নতুন নির্বাচন কমিশন অর্থাৎ বর্তমান কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। সেবার নারায়ণগঞ্জ সিটি বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। তখন দলীয় প্রতীক বা আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় ভিত্তিতে মেয়র পদে নির্বাচন হয়নি। তাই আওয়ামী লীগ দল থেকে মেয়র প্রার্থী ছিলেন দুজন এবং দুজনই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও জাঁদরেল প্রার্থী। তাতে আওয়ামী লীগের ভোট দ্বিখণ্ডিত হয়ে ত্রিমুখী লড়াইয়ে বিএনপির প্রার্থী তৈমূর আলমের জয়ী হওয়ার একটা ভালো সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দেখা গেল, ভোটগ্রহণের ঠিক আগের রাতে সেনা মোতায়েন না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে কেন্দ্রের নির্দেশ মতো টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন তৈমূর আলম। এই নাটকের মাধ্যমে সেদিন বিএনপি যাদের সহানুভূতি পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল, শেষ পর্যন্ত সেটি পেতে তারা ব্যর্থ হয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ইস্যু তৈরির প্রবণতা বরাবরই বাংলাদেশের মানুষ দেখে আসছে। ২০১১ সালে সেনাবাহিনীতে একটা অভ্যুত্থানের চেষ্টার সঙ্গে জড়িত হয়ে পালিয়ে যাওয়া এবং এখনো পলাতক। পুলিশের ভাষ্যমতে, জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত মেজর জিয়া তখন পালিয়ে গেলে বিএনপি থেকে বলা হলো, সেনাবাহিনীর অফিসারও নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ওই বছর মে মাসের ২০ তারিখে সেনাবাহিনীর ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে অপচেষ্টা করেছিলেন, তার ক্ষত শুকাতে অনেক দিন লেগেছে। আসন্ন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় যথারীতি সেনা মোতায়েনের দাবি তোলা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন, সেনা আইন ও সারা বিশ্বের চিরাচরিত নিয়ম হলো, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে, যদি সে রকম সংকটের সৃষ্টি হয়। মোতায়েন হলেও ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদার বাইরে সেনাবাহিনীর কোনো কার্যক্রম চালানোর সুযোগ থাকে না। দীর্ঘ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে কোথাও কোনো অনিয়ম ও কারচুপি হলে তা প্রতিরোধ করার কোনো সুযোগই সেনাবাহিনীর নেই। আইনগতভাবে যাদের যে কর্তৃত্ব নেই, তাদের সে কাজে নিয়োগ করার অর্থই হলো ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেলেই শুধু সেনাবাহিনী সহায়তা করতে পারে। সারা দেশে এখন কেবল নির্বাচন হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে। তাই নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করলে যত বেশি প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে মোতায়েন করতে পারবে। তাই সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবির পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং অযথা তাদের রাজনৈতিক বিতর্কে জড়ানোর ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, যা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর। নিজেদের পেশা ও প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সদস্যরা আমাদের ধুরন্ধর কিছু রাজনীতিকদের কবলে পড়ে কি রকম হেনস্তা হয়, সেটা তো প্রতিনিয়তই দেখা যায়। তবে এটা পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব, তাদের সেটি ফেস করতে হবে। কিন্তু পুলিশের জায়গায় টেনে এনে সেনাবাহিনী ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মধ্যে ভালো কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। তাই অপ্রয়োজনীয় সেনা মোতায়েনের দাবি, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিগত নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে নিজ দলের মেয়র প্রার্থীকে নির্বাচন বয়কট করতে বাধ্য করার উদাহরণ ইত্যাদি আলামত দেখে মনে হয়, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে জয়ী হওয়া বিএনপির মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। হতে পারে এর মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতির জন্য নতুন কোনো ইস্যু পেলে সেটাই হবে বিএনপির জন্য লাভ।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
[সংকলিত]