আতিউর রহমান ।। খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৯ জানুয়ারি ২০১৭: বছরের শেষ দিনে ‘বাংলাদেশ ইকোনমিস্টস ফোরামে’ দেওয়া মূল বক্তৃতায় ‘নগরে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি’ বিষয়ে যেসব কথা বলেছি, সেসবের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতে চাই এই নিবন্ধে।
বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
তবে গরিব মানুষের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার এই সাফল্য গ্রামপর্যায়েই বেশি হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের প্রসার গ্রামেই আগে ঘটেছে। এখন শহরেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সম্প্রতি উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রূপান্তরের ফলে সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের মানুষের নতুন হিসাব খোলা, কৃষিঋণ, খুদে ও মাঝারি ঋণ, মোবাইল ব্যাংকিংসহ সৃজনশীল অনেক আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ ব্যাংকগুলো নিতে শুরু করেছে। সার্বিকভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রসার ঘটলেও নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ এখনো সেই অনুপাতে আর্থিক সেবার সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় হালে যে সাফল্য চোখে পড়ছে তাতে নগরে বা তার আশপাশের গরিব মানুষ, খুদে উদ্যোক্তাদের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। একমাত্র জিনজিরাতেই ১২ লাখের মতো খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তা নানামুখী শিল্পায়নে যুক্ত রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের খুব সামান্য অংশই প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবা পেয়ে থাকেন। খুদে ও মাঝারি ঋণের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও নগরে ও তার আশপাশের উদ্যোক্তাদের এখনো আমরা সেভাবে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং চালু হওয়ার কল্যাণে নগর-দরিদ্রদের বেশ সুবিধা হয়েছে। যেসব শ্রমিক গার্মেন্ট কারখানায় কর্মরত তাঁদের অনেকেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন পাচ্ছেন এবং সেই বেতনের একাংশ গ্রামে ফেলে আসা পরিবারের সদস্যদের তাঁরা দ্রুতই পাঠাতে পারছেন। কিন্তু শুধু টাকা-পয়সা লেনদেনই তো আর আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পুরোটা বোঝায় না। তাদের সঞ্চয়, ঋণ, ইনস্যুরেন্স সেবাও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অংশ হতে পারে। এ দিকটায় নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
এসব কথা বলছি বাংলাদেশের উন্নয়নের সাফল্যের প্রেক্ষাপটে। এই উন্নয়নের ধারা টেকসই করতে হলে আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। একাত্তরে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ শুরুতে ছিল পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। কিন্তু মাত্র সাড়ে চার দশকেই দেশটির প্রায় ৩০ শতাংশ জিডিপি শিল্প থেকে আসছে। এই শিল্পের প্রধান অংশই গার্মেন্ট খাত। ঢাকা শহর ও তার আশপাশেই এ শিল্পের প্রধান অংশ অবস্থিত। চট্টগ্রামেও এর খানিকটা অবস্থান রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লায়ও গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার ঘটেছে। ওষুধ শিল্প, সিরামিক, প্লাস্টিক শিল্পেরও প্রসার নগর বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়ই লক্ষ করা যায়। এসব শিল্পে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা বয়সে নবীন এবং তাঁদের বেশির ভাগই নারী। নগর ও তার আশপাশের এই দ্রুত শিল্পায়নের ফলে পানি, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ওপর বড় ধরনের চাপ পড়েছে। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ পানি ব্যবহূত হয়, তার দ্বিগুণেরও বেশি পানি ব্যবহূত হয় শুধু গার্মেন্ট খাতে। এই পানিতে রং মিশিয়ে ফেলে দেওয়া হয় আশপাশের জলাশয়ে। তাই নগরের পরিবেশ হয় বিপন্ন। এই পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সরকার ও উদ্যোক্তারা নানামুখী উদ্যোগ নিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা সামান্য। বর্জ্য শোধনাগার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবুজ বস্ত্র খাত তৈরির অভিপ্রায়ে সবুজ অর্থায়নের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এর পরিমাণ যথেষ্ট নয়। সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব উদ্যোগ না নিলে এই বিশাল শিল্পের সবুজায়ন সহজে সম্ভব হবে না। আর তা না হলে আখেরে এই পরিবেশবিধ্বংসী শিল্পায়নই আমাদের গলার ফাঁস হিসেবে দেখা দিতে পারে।
সে কারণেই নগরের পরিবেশ সবুজ করার জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।
মনে রাখতে হবে, আমাদের নগরবাসীর সংখ্যা খুবই দ্রুতগতিতে বাড়ছে। প্রায় অর্ধেক মানুষই এখন শহরবাসী। গ্রাম থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ শহরে আসছে। কর্মের সংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা ধরনের সুযোগের সন্ধানে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। এক বর্গমাইল এলাকায় শহরে যে পরিমাণ মানুষ বাস করে তার অর্ধেকেরও কম মানুষ বাস করে ওই পরিমাণ গ্রামীণ এলাকায়। আর নগরমুখী মানুষের আগমন তো অব্যাহত রয়েছেই।
এ অবস্থায় নগরবাসীর নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সরকার একদিকে স্থানীয় সরকারগুলোর আর্থিক স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধি করে যেতে পারে, অন্যদিকে যাতায়াত ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে উদ্যোগী হতে পারে। আর নগর বা তার আশপাশের খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ, দক্ষতা বৃদ্ধির মতো কর্মসূচিকে উৎসাহ দিতে পারে।
নগরের দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের অবস্থা গ্রামের গরিবদের চেয়েও খারাপ। বস্তিতে বাসস্থান, পানি ও স্যানিটেশন সুযোগের অভাব ও অব্যবস্থাপনার কথা লিখে বোঝানো যাবে না। তাদের সন্তানদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগও খুবই সামান্য। গ্রামে তা-ও নানা ধরনের সামাজিক সমর্থন ও সরকারি ভাতা মেলে। শহরের নারী ও বৃদ্ধাদের এমন কোনো সুযোগও নেই। নদীভাঙা, জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার শরণার্থী এসব নগরবাসীর দুঃখমোচনের মতো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পিত উদ্যোগ আমরা এখনো নিয়ে উঠতে পারিনি। তবে নগরের আশপাশের কল-কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকসহ ব্যাপকসংখ্যক কর্মীর আয়-রোজগার মন্দ নয়। কাজ করে তাদের দক্ষতা ও বেতন দুই-ই বাড়ছে। এর প্রভাব সার্বিকভাবে দেশের দারিদ্র্য নিরসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমাদের এই রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ফলে গ্রাম থেকে আসা শ্রমজীবী মানুষের পরিবারে বেশ খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ বেড়েছে। ফলে আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়ছে, একই সঙ্গে তার বৈষম্য ততটা বাড়ছে না।
আমাদের নগর অর্থনীতিকে পরিকল্পিত উপায়েই সবুজ করার সুযোগ রয়েছে। শুধু প্রবৃদ্ধির ওপর এককভাবে ভর না করে গুণগত মানের নগরায়ণের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সে জন্য মানুষের বাসযোগ্য করে তাকে সবুজায়ন করতে হবে। জ্বালানি সাশ্রয়ী বাড়ি নির্মাণ ও পুনর্র্নিমাণ, মেট্রোসহ অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, গ্রিন বন্ডসহ সবুজ নগরায়ণের পক্ষে আর্থিক সমর্থন প্রদান, পরিকল্পিত সবুজ উপ-নগরী গড়ে তোলার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এই উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, ইনস্যুরেন্স নিয়ন্ত্রক সংস্থা, এনবি আর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সহযোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।
গ্রামে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো যে সাফল্য দেখিয়েছে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে শহরের দারিদ্র্য বিমোচনেও তাদের উদ্যোগী হতে হবে। শক্তি ফাউন্ডেশন, ডিএসকে, সেফসেভসহ প্রায় ৩০০টির মতো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান এখন ঢাকা শহরে কাজ করছে। এমন আরো প্রতিষ্ঠান নগরে কাজ করতে এগিয়ে আসবে বলে আমার প্রত্যাশা। ব্যাংকগুলোও তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে কাক্সিক্ষত মানের নগরায়ণের জন্য তাদের অবদান রাখবে—এমনটিই আশা করছি। বিশেষ করে নগরের পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে সাধারণের সেবা বাড়াতে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধ কাজগুলো যেন অব্যাহত রাখে, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। মোবাইল ব্যাংকিং সেবার প্রচলন হওয়ার পর থেকেই নগরের কম আয়ের মানুষদের পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা পাঠানো অনেকটাই সহজতর হয়েছে। গ্রামের মানুষ শহরে পড়াশোনা করা সন্তানদের জন্য নিয়মিত কম খরচে অর্থ পাঠতে পারছে। নগরের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ফিসহ অন্যান্য লেনদেনেও মোবাইল ব্যাংক বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলেছে। দিন দিনই এই আর্থিক সেবার ব্যাপ্তি বাড়ছে।
নগরের বাড়িগুলোর ছাদে বাগান ও সোলার প্যানেল লাগানোর মতো সবুজ কর্মে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা ও কারিগরি সহযোগিতা দেওয়ার উদ্যোগ সরকার নিশ্চয় নিতে পারে। সামাজিক সংগঠনগুলোও সরকারকে এ জন্য সহযোগিতা করতে পারে। কেনিয়ায় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সঞ্চয় করে বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল লাগানোর এক অভিনব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। নাম তার ‘এমকোপা’। এ রকম কর্মসূচি আমাদের দেশেও শুরু করা সম্ভব। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেছে তার সদ্ব্যবহার করে শহর ও শহরতলির খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কম খরচে আর্থিক সেবা দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বস্ত্র ও চামড়া খাতের সবুজায়নে বেশ কিছু অভিনব সবুজ অর্থায়ন কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছে। এসব উদ্যাগকে আরো সফল ও সক্রিয় করার জন্য নীতিনির্ধারকদের আরো তৎপর থাকতে হবে।
সারা বিশ্বেই মোবাইল টেলিফোন ব্যবস্থায় নতুন নতুন সেবা ও প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে। অচিরেই আমাদের দেশেও ‘ফোরজি’ মোবাইল প্রযুক্তির প্রচলন ঘটবে। তখন আর ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করেই অতিদ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পন্ন করা যাবে। ‘প্রথমেই মোবাইল’ স্লোগানের আওতায় ব্যাংকিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ই-কমার্সসহ নানামাত্রিক ব্যবসা ও আর্থিক সেবার প্রচলন ঘটবে। ব্যাংকগুলো আর অনেক খরচ করে শাখা খুলবে না। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বড় বড় বিলবোর্ড স্থাপন করে পয়সা নষ্ট করবে না। মোবাইলেই সব ধরনের বিজ্ঞাপন সম্পন্ন করা যাবে। ট্রাফিক মাড়িয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। দ্বিমুখী ‘ফোরজি’ প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে টেলিমেডিসিনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা যাবে। থরে থরে পণ্য সাজানো দোকানপাটে আর মানুষ তেমনটি যাবেন না। বরং মোবাইলেই ই-শপিংয়ের কাজটি সেরে নেবেন। আমাজন, আলীবাবা, চালডালডটকমের মতো অসংখ্য ই-কমার্স সাইট গ্রাহকদের ঘরে বসে কেনাকাটার সুযোগ করে দেবে। আপনার দুই ঘণ্টার জন্য ড্রাইভার দরকার? ‘উবারে’র মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনেই তাকে পেয়ে যাবেন। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ‘খান একাডেমি’র মতো অসংখ্য একাডেমি খুঁজে পাবেন।
এভাবেই মোবাইল প্রযুক্তির কল্যাণে নগরজীবনে নানামাত্রিক সেবা গ্রহণের সুযোগ সৃর্ষ্টি হবে। এসবের সমর্থনে ক্যাশবিহীন আর্থিক সেবাও চালু হবে। মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের বলে আপনার সব দেনা-পাওনা আপনি বুঝে নিতে পারবেন। তবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এই সুবিধাগুলোর পাশাপাশি সাইবার ঝুঁকির বিষয়টিও ভালো করে মনে রাখতে হবে। এসব প্রযুক্তিভিত্তিক সেবা যেন সাইবার অপরাধীদের খপ্পরে পড়ে বদনাম না কুড়ায় সেদিকে তীক্ষ নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
এসব ঝুঁকি রয়েছে বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করেই আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে। চীনা প্রবাদে আছে, পাথর স্পর্শ করে করেই নদী পার হতে হয়। আমাদেরও সেভাবেই এগোতে হবে। সুন্দর পৃথিবী গড়ব বলেই আমাদের এমন করে এগোতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[সংকলিত]