Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

22
খোলা বাজার২৪, শনিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭:

আলী যাকের
কলাবাগান অঞ্চলে আমার বাবা ও তাঁর বন্ধুরা মিলে প্রত্যেকে এক বিঘা করে জায়গা কিনেছিলেন। বাবাকে বলতে শুনেছি, বন্ধুরা কিনেছে তাই।

থাকুক পড়ে। জমির দাম তো বাড়তেই থাকে। সেটা ছিল ১৯৫৪ সাল। শুনেছি, তখন ওই এলাকায় জমির দাম ছিল বিঘাপ্রতি দেড় হাজার টাকা। আজ শুনলে হাসি পায়। কলাবাগান তখন ছিল শহরের ভেতরে গ্রাম। মনে আছে, প্রচুর কাঁঠালগাছ ছিল ওই জায়গায়। মাঝেমধ্যে দু-একটা মাটির ঘর। প্রচুর পাখি। আর দিন পড়ে এলে শুরু হতো শিয়ালের ঐকতান। ওই জমিতে যাওয়ার কোনো রাস্তা ছিল না। বাবার সঙ্গে আমরা সবাই মিরপুর রোডে গাড়ি রেখে ধানের ক্ষেতের মাঝের আলপথ দিয়ে হেঁটে প্রায় আধাকিলোমিটার দূরের ওই জমিতে যেতাম। ছুটির দিনে পরিবারের সবাই মিলে আমরা ওই জমিতে পিকনিক করতেও যেতাম। ক্রমে ওই এলাকায় উন্নয়নের সময় এলো। আমার বাবা ও তাঁর বন্ধুরা মিলে তাঁদের জায়গার মাঝামাঝি একটা ২০ ফুট রাস্তা বের করার জন্য প্রত্যেকে আড়াই কাঠা করে জায়গা ছেড়ে দিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেকের জায়গার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াল সাড়ে ১৭ কাঠা। আমাদের রাস্তাটা ছিল কানাগলি। আমাদের প্লটের ২০০ গজ পশ্চিমে গলির শেষ, আর প্রায় ২০০ গজ পূর্বে গলিটা গিয়ে পড়েছে বড় রাস্তায়। পশ্চিমের শেষ মাথা থেকে আমাদের পূর্বে একটা প্লট পর্যন্ত সবাই আড়াই কাঠা করে জমি ছেড়ে দেওয়ায় বেশ চওড়া ও সুদৃশ্য একটা রাস্তা তৈরি হলো বটে, তবে পূর্ব দিকে আমাদের প্লটের পর থেকেই ক্রমে গলিটা সরু হয়ে এলো। কেউ কথা রাখল না। বড় রাস্তার কাছাকাছি গলিটা এমনই সরু হলো যে দুটি রিকশা একে অন্যকে পেরোতে পারে না। একটা গাড়ি কোনোমতে কষ্টেসৃষ্টে গলিতে প্রবেশ করতে পারে। আমরা বড় হওয়ার পর মানুষের অসততায় ও অসংবেদনশীলতায় এতই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম যে একে একে ওই জমিতে নিজেদের ভাগগুলো বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র চলে যাই।
বছরবিশেক আগে একটা টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছিলাম। সেখানে আমি ছিলাম ঢাকা শহরের কোনো একটি এলাকার দোর্দণ্ড প্রতাপধারী এক বৃদ্ধ। আমার ছিল অগাধ পয়সা আর বিশাল স্থাবর সম্পত্তি। আমি একটা পাড়ার মালিক ছিলাম, যেখানে প্রবেশ করতে হতো একটা প্রায় কানাগলি দিয়ে। ওই গলির দুই পাশের বাড়িগুলোরও মালিক ছিলাম আমি। সেই গলিতে শুধু একটা রিকশা প্রবেশ করতে পারত। অনেকেই আমাকে অনুরোধ করত ওই গলিটাকে চওড়া করতে। আমি কারো কথা কানে তুলতাম না। আমার জমির এক ইঞ্চিও আমি ছাড়তে নারাজ। ওই গলির শেষ প্রান্তে ছিল আমার বাড়ি। সেখানে আমি একটি সুদৃশ্য দ্বিতল অট্টালিকায় বসবাস করতাম। আমার নিজস্ব গরু ছিল, গরুর জন্য গোয়ালঘর ছিল। সবজিবাগান, ফুলের বাগান—এসব নিয়ে তিন বিঘার ওপরে একটা ছোটখাটো জমিদারি ছিল আমার। একটি মূল্যবান গাড়িও আমার ছিল। যেহেতু ওই গলির ভেতর বিশাল গাড়িটির প্রবেশ অসম্ভব, সেহেতু আমি বড় রাস্তার ওপরে একটা গ্যারেজ ভাড়া নিয়েছিলাম এবং বাড়ি থেকে গাড়ি অবধি রিকশায় যাতায়াত করতাম। হঠাৎ একদিন মাঝরাতের পর আমার হৃপিণ্ডের ওপর প্রচণ্ড এক আঘাত এলো। ব্যথা-বেদনায় আমি কুঁকড়ে যেতে থাকলাম। আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। আমি অসহায়ের মতো ডুকরে কেঁদে উঠলাম। আমার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে দৌড়ে এলো আমার ঘরে। আমার অবস্থা দেখে তারা শহরের একটি নামকরা হাসপাতালে অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য ফোন করল। যথাসময়ে অ্যাম্বুল্যান্স হাজির; কিন্তু আধাকিলোমিটার দূরে বড় রাস্তার ওপরে তা আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আমার বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারে সে অবস্থা তো আমি নিজেই রাখিনি। অতএব, ওই গলির ভেতরে অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকতে পারল না। আমার দুই ছেলে আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে যখন বড় রাস্তায় পৌঁছল তখন আমি আর ইহজগতে নেই। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, এই হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু করে আমার মৃত্যু পর্যন্ত দৃশ্যটি অভিনয় করা ছিল আমার অভিনয়জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে চরিত্রটির সঙ্গে এমনভাবে আমার আত্তীকরণ হয়েছিল যে অভিনয় করতে করতে সত্যি মনে হয়েছিল, আমার মরণ অত্যাসন্ন।
কলামটি লেখার জন্য আমার টেবিলের পাশে বসে এই দুটি অতীতের ঘটনা মনে এলো এ কারণে যে কিছুদিন আগে রানা প্লাজায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে বড় বেদনাহত ছিলাম। এর আগেও এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে নিমতলী ও বেগুনবাড়ীতে। নিমতলীতে অসহায় মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়, বেগুনবাড়ীতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর দালান ভেঙে পড়ে অথবা প্রায়ই আমাদের প্যাসেঞ্জার লঞ্চগুলো ক্ষমতার বাইরে যাত্রী বহন করার জন্য হাজার হাজার মানুষের সলিলসমাধি হয়। এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার জন্য যে শুধু তারাই দায়ী, যাদের দায়িত্ব আইনের প্রয়োগ, তা কিন্তু নয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বোধ হয় আমরা নিজেরাই। আমাদেরই কৃতকর্মের ফল আমরা পেয়ে যাই প্রায় নিয়তির বিধানে। আমাদের লোভ, আমাদের লালসা, আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা অথবা বে আইনি কর্মকাণ্ডের প্রতি উদাসীনতাই প্রধানত এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। আমাদের এই ভূখণ্ডে দুর্নীতি ও অনিয়ম সংস্কৃতিগতভাবে যেন আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে। অনেক দিন আগে থেকেই আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কিছু অভ্যাস প্রচলিত আছে। যেমন কোনো একটি পরিবারের মেয়ে দেখতে বরপক্ষের লোকেরা যখন আসে তখন কনেপক্ষ থেকে প্রথম যে প্রশ্নটি তাদের করা হয় সেটি হলো, ‘ছেলের উপরি কত?’ বেতনের চেয়েও তার উপরির প্রতি লোলুপ দৃষ্টি থাকে সবার। আমি নিশ্চিত যে এখনো আমাদের আজকের বাংলাদেশে এ ধরনের প্রশ্ন অবলীলায় করা হয়ে থাকে। আমাদের সংস্কৃতিই যেন এ ধরনের কিছু দুর্নীতিকে বৈধ হিসেবে প্রশ্রয় দেয়। আজকের বাংলাদেশে দুটি জনপ্রিয় শব্দ হচ্ছে, ‘এক নম্বর’ ও ‘দুই নম্বর’। প্রথমটি ওই ধরনের কাজ কিংবা অর্জনকে বোঝায়, যা স্বচ্ছ ও সৎভাবে অর্জিত হয়েছে। আর ‘দুই নম্বর’ হচ্ছে সেই অর্জন, যা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। দুর্ভাগ্য আমাদের যে আজকের সমাজে আমরা শুরুতেই এক নম্বর পথটিকে দূরে সরিয়ে রেখে দুই নম্বর পথে পা বাড়াই। আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে না এবং এটা ঘটে সামাজিক, ধর্মীয় অথবা নৈতিক সব ধরনের অনুশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
আমি এর আগেও একাধিকবার লিখেছি যে আমরা আমাদের নিজেদের জাগতিক অর্জনের জন্য কোনো অপরাধকেই অপরাধ বলে মনে করি না। আমরা কখনোই কোনো বিষয়ে নিজেদের অথবা অন্যদের কোনো প্রশ্ন করি না। আমরা দুষ্কৃতির প্রতি উদাসীন একটি জড়পিণ্ডতে পরিণত হয়েছি। এই সমাজে ঘাতক বাস রিকশাকে ধাক্কা মেরে গুঁড়িয়ে দেয়, রিকশার যাত্রীরা প্রাণ হারায়। তবু যদি কেউ বাসের ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বলে, তাহলে অন্য যাত্রীরা বিরক্ত হয়। তারা প্রতিবাদ করে বলে, আমরা পয়সা দিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ার জন্য বাসে উঠিনি! আর একটি বাস এক তরুণীকে পিষে মারে, আমরা বাসটিকে আটক করে পুড়িয়ে দিই, বাসের ড্রাইভারকে পিটিয়ে আধামরা করে ফেলি; অথচ কেউ জানার চেষ্টা করি না যে মেয়েটি মুঠোফোনে কথা বলায় তন্ময় থেকে রাস্তা পার হচ্ছিল। পাশেই কিন্তু ফুট ওভারব্রিজ। বেশ কিছুদিন আগে মহাখালী থেকে গুলশান-১-এর দিকে গেছে যে সড়ক, সেটার ওপরে একটি দ্রুতগতির বাসের নিচে চাপা পড়ে এক কলেজ ছাত্র। তার মৃত্যু হয়। সেই সময় বিস্তর গাড়ি ভাঙচুর হয় এবং সিটি করপোরেশন ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী সেখানে একটি সুদৃশ্য ফুট ওভারব্রিজ তৈরি করে দেয়। কিছুদিন আগেও আমি দেখেছি যে সেই ফুট ওভারব্রিজ অব্যবহৃত। ছাত্রছাত্রীরা দিব্যি রাস্তার ওপর দিয়ে পারাপার হচ্ছে এবং ব্রিজের দুই পাশের সিঁড়িতে বসে তরুণরা কলকাকলিতে মত্ত। অর্থাৎ ফুট ওভারব্রিজের দাবিটি ছিল তাদের অরাজকতাকে সিদ্ধ করার একটি প্রক্রিয়া। আমি স্বীকার করি, যে দালানগুলো বলা নেই, কওয়া নেই মুখ থুবড়ে পড়ে অথবা যে বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় এবং সেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি পৌঁছানো হয় দুষ্কর, এগুলো সবই সম্ভব হয় রাজউক অথবা ওই ধরনের কোনো কর্তৃপক্ষের কতিপয় দুর্বৃত্তের দুর্নীতির কারণেই। তবে এটাও স্বীকার করতে আমরা বাধ্য, যে মানুষগুলো অন্যদের জীবন নিয়ে এমন হোলি খেলে তাদেরও জন্ম ও বেড়ে ওঠা এমন এক সমাজে, যেখানে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ও দুর্নীতির প্রতি পূর্ণ সমর্থন এখন সহজাত হয়ে গেছে।
অতএব, আমাদের পাপ আমাদেরকেই আঘাত করে বারবার এবং সে জন্যই ফিরে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের সেই অবিস্মরণীয় কবিতার পঙিক্ততে, ‘কার নিন্দা কর তুমি? মাথা কর নত, এ আমার এ তোমার পাপ। ‘ এই মুহূর্তেই আমাদের প্রয়োজন একটি পরিকল্পিত আন্দোলনের সূচনা করা, যে আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা থাকবে এ দেশের আপামর সৎ ও শুদ্ধ মানুষের। এটা অবশ্যই সত্য যে আমাদের এই হতভাগা দেশেও দুষ্ট মানুষের চেয়ে ভালো মানুষের সংখ্যা অধিক। প্রসঙ্গত, সব ধরনের গণমাধ্যমকে বলি যে আপনারা আপনাদের কাটতি কিংবা জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য কানকথার ওপর নির্ভর করে অসত্য প্রতিবেদন করা থেকে বিরত থাকুন। যদি বিপথগামী সাধারণ মানুষকে দুটি কড়া কথাও বলতে হয় সেখান থেকে পিছপা হবেন না। একটি সৎ জনগোষ্ঠী যদি শাসকের দুরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, তাহলে তা কার্যকর হয়। অসৎ জনগোষ্ঠীর কথা কেউ শোনে না। সব কিছুই শেষমেশ হয়ে দাঁড়ায় অরণ্যে রোদন।