খোলা বাজার২৪, সোমবার, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭:
এম আবদুল হাফিজ
২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্প ‘নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ’-এ বিশ্বব্যাপী সহিংসতার একটি পূর্ণ চিত্র প্রকাশ পায়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই গবেষণায় বলা হয়, ‘৯০ শতাংশেরও বেশি আত্মঘাতী হামলা বিদেশি দখলদারির প্রত্যুত্তর। ‘ একই গবেষণা থেকে আরো যে সত্য বেরিয়ে এসেছে তা হলো, বিদেশি দখলদার বিতাড়নের এটাই সহজ পথ, সম্ভবত সুবিধাজনকও। অনেক পশ্চিমা ব্যাখ্যাকার ও রাজনীতিকের জন্য অনেক সহজ, এমনকি নিরাপদ দায়েসকে প্রসঙ্গ রূপে আলোচনা-সমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া। এতে তাদের কোনো নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় না।
১৯৯৯ সাল নাগাদ ইরাকে কোনো উগ্রবাদী ধর্মীয় চরমপন্থা প্রচারে ব্রতী হয়নি। অবশ্য তখনো ইরাক সন্ত্রাস বা সহিংসতামুক্ত ছিল না। তখনো ইরাকে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। ইরাকিরা তখন ওই সব সহিংসতার জন্য আমেরিকানদের দুষেছে, এখন যেমন আমেরিকা ও তার পশ্চিমা দোসররা তাদেরই পরোক্ষ মদদে সৃষ্ট দায়েসকে (ইসলামিক স্টেট ফর ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত) দোষারোপ করে।
জঙ্গিবাদের নেপথ্য ইতিহাস স্পষ্ট করতে ২০০৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করা যায়। ‘সিনস ২০০১, অ্যা ড্রামাটিক ইনক্রিজ ইন সুইসাইড বোমবিংস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বোমা হামলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে পাঁচটি উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২১ হাজার ৩৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত ও আরো প্রায় ৫০ হাজার আহত হয়। তবে বিস্ময়কর উপাত্ত হচ্ছে এই দীর্ঘ ২৫ বছরজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে নয়, মাত্র সাত বছরে এসব হামলার ৫ ভাগের ১ ভাগই চালানো হয় বিগত সাত বছরে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের আফগান অভিযানের পরই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস নতুন রূপ নেয়। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই আত্মঘাতী হামলা চালানোর ঘটনা হঠাৎ করেই বেড়ে যায়।
মার্কিনিরা আফগানিস্তানে ২০০১ সালে সামরিক অভিযানের সূচনা করে। ২০০৩ সালে ইরাকের জ্বালানি সম্পদে প্রলুব্ধ মার্কিনিরা দেশটিতে আফগানিস্তান এপিসোডের পুনরাবৃত্তি করলে ধরাপৃষ্ঠে নরকের অবতরণ ঘটে (অষষ যবষষ নৎড়শব ষড়ড়ংব)।
অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন সূত্রে ওয়াশিংটন পোস্টের ওই খবরে আরো বলা হয়েছিল, বৈরুত হামলার পর ২৫ বছরে বিশ্বে এক হাজার ৮৪০টি আত্মঘাতী আক্রমণের ঘটনা ঘটে। আর্জেন্টিনা থেকে আলজেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া থেকে চীন, ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এ হামলার শিকার হয়। তবে হামলাগুলোর ৮৬ শতাংশই ঘটেছে ২০০১ সালের পর, যে সালে যুক্তরাষ্ট্র জঙ্গি দমনের নামে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে। ওই সময় অর্থাৎ ২০০৮ সাল পর্যন্ত ইরাকে ৯২০টি ও আফগানিস্তানে ২৬০টি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়। তারপর গত প্রায় এক দশকে জঙ্গিবাদী হামলা কত গুণ বেড়েছে? এক শব্দেই বলা যায় ‘বেশুমার’।
চলতি সপ্তাহেই আফগান পার্লামেন্টের খুব কাছে নতুন এক জোড়া বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় অন্তত ৩৮ জন এবং আহত হয় আরো ৭২ ব্যক্তি। বিস্ফোরণের পরপরই দায় স্বীকার করে তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠী। এর আগে হেলমন্দ প্রদেশে এক জঙ্গি উড়িয়ে দেয় নিজেকে। কন্দহরেও কূটনৈতিক এক বৈঠকে হামলা চালিয়ে খুন করা হয় অন্তত সাতজনকে। এর দিনকয়েক আগে বর্ষশেষের রাতে ইস্তাম্বুলে নাইট ক্লাবে হামলায় নিহত হয় দুই ভারতীয়সহ ৩৯ জন। হামলাকারী সিরিয়ায় দায়েস তথা আইএসের হয়ে লড়েছিল বলে জানাচ্ছে তুর্কি সংবাদমাধ্যম।
দায়েস একটি অভিধা, যা অলক্ষে নতুন কোনো ব্র্যান্ড নামে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। বদলে যেতে পারে তার কৌশল সময় ও পরিস্থিতির তাগিদে। সংগঠনের অনুসারীরা সমাগত সহিংসতার আকারকে পরিমাপ করতে সক্ষম বিধায় প্রয়োজনমাফিক আত্মঘাতী কটিবন্ধ, বিস্ফোরকবোঝাই গাড়ি, ছুরি অথবা দ্রুতগতিতে ধাবমান ট্রাক ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু যেটা গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ তা হচ্ছে যে দায়েস এরই মধ্যে একটি প্রপঞ্চে পরিণত হয়েছে, যা এখন অঞ্চল বিশেষে দিবালোকের মতো দৃশ্যমান।
দায়েস একটি ধারণা ও একটি উপলব্ধি (ওফবধ), যা কোনো একক গোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ নয়। দায়েসের পরাজয় নির্ভর করে ওই সব চিন্তাধারা, যা এর উৎপত্তি ঘটিয়েছে, সেসবের অবলুপ্তিতে। অন্য কথায় জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়ার ও জন হাওয়ার্ডদের মন্ত্রকে পরাজিত করার সক্ষমতার। এ কথা ঠিক যে দায়েস ও তার অনুসারীরা সহিংস, কিন্তু শেষ অবধি ক্রুদ্ধ, বিচ্ছিন্ন (অষরবহধঃবফ), পথভ্রষ্ট ও চরমপন্থী তরুণরা তাদের হতাশাগ্রস্ত অবস্থার পরিবর্তনে যে নিন্দনীয় প্রতিশোধস্পৃহার পন্থা গ্রহণ করেছে, যদিও এই প্রক্রিয়ায় তাদেরও জীবনপাত ঘটছে।
গত বছর ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলবর্তী পর্যটন শহর নিসে বাস্তিল দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ভিড়ে একটি ট্রাক ভূমি কর্ষণের মতো করে সবাইকে পিষ্ট করে দ্রুতবেগে চলে যায়। পরে ‘দায়েস’ ঘটনাটির পরোক্ষ দায় স্বীকার ও কৃতিত্ব দাবি করে। পূর্ণ সচেতনতার সঙ্গে ইচ্ছাকৃত এই হত্যাকাণ্ডে ৮৪ জন নিসে বাস্তিল দিবস উদ্যাপনকারী, যার অন্তর্ভুক্ত শিশু ও এক-তৃতীয়াংশই মুসলিম ছিল। কিন্তু ‘দায়েসে’র বিশ্বব্যাপী সহিংসতা ও নিসের ট্রাক দিয়ে উৎসবমুখর মানুষকে পিষে মারা ও তার পরোক্ষ দায় স্বীকারের অর্থ এই নয় যে ওই দানবীয় আক্রমণে তাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই এবং ট্রাকচালক ঘাতক তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত মুহম্মদ বুহলেলের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই।
নিসের হামলাকারী বুহলেলের প্রোফাইল তাঁর কোনো নিষ্ঠুর জিহাদি ঘাতকের পরিচয় বহন করে না, যেমনটি মিডিয়ায় বা সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে আমরা পাই। তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত ৩১ বছর বয়স্ক নিসের এই অধিবাসী স্থানীয় পুলিশের কাছে পরিচিত ভয়ংকর সন্ত্রাসী রূপে নয়, রাস্তাঘাটে ছোটখাটো অপরাধের জন্য। ফ্রান্সের সন্ত্রাসী নজরদারির তালিকায়ও তাঁর নাম ওঠেনি।
১৪ জুলাই নিসে হামলার পর ফরাসি প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ঘোষণা দেন তিনি ইরাকে ও সিরিয়ায় তাঁর দেশের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম আরো মজবুত করবেন—এ কথার কী অর্থ দাঁড়ায়। একটি আপাত ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়ে আস্ফাালন ছাড়া যদি নিসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ফ্রান্সেরই অভ্যন্তরীণ সমাজ বিন্যাস ও তার মধ্যে অসংখ্য অসংগতির কারণে হয়ে থাকে (যা ভুক্তভোগীরা বিশ্বাস করে), তাহলে ফরাসি প্রতিশোধস্পৃহার মূল্য ইরাকি বা সিরীয়রা কেন দেবে? স্পষ্টতই ওলাঁদের ঘোষণার পেছনে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ বা যুক্তি নেই।
ওলাঁদের আরেকটি বক্তব্য যে ‘সমগ্র ফ্রান্স ইসলামিস্ট সন্ত্রাসের হুমকির মুখে’ নিছক বিদ্বেষপূর্ণ, যেমন তা যুক্তি-প্রমাণহীন। ভীতিজনকভাবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের বিভিন্ন উক্তির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় ওলাঁদের হুমকি-ধমকিতে। ১৫ বছর আগে জর্জ বুশ প্রলয়ংকরী ইরাক যুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, যাকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধ দুর্ভাগ্যক্রমে আরো সন্ত্রাসের উৎপত্তি ঘটিয়েছিল, জন্ম দিয়েছিল এক ভয়াবহ বিশৃঙ্খলার। সেই যে মধ্যপ্রাচ্যের সমগ্র অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল, তা এখনো অব্যাহত আছে।
বহির্বিশ্ব জানে যে ওলাঁদের গ্রহণযোগ্যতা (জধঃরহম) এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে, যেমনটি ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাক আক্রমণের ফলে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের ভাগ্যে জুটেছিল। আমরা সেই আক্রমণে নেতিবাচক সব কিছু প্রত্যক্ষ করেছি, দেখেছি কিভাবে জর্জ বুশের সামরিক স্ট্র্যাটেজি ব্যর্থ হয়েছিল।
নিসে হামলার কিছুদিন পর তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ফ্রান্সের বেপরোয়া বিমান হামলায় এক বিধ্বংসী হত্যাকাণ্ডের সংবাদ আসে। খবরে ওই হামলায় কয়েক ডজন বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু এতে করে কি ওলাঁদের অভ্যন্তরীণ সহিংসতার অবসান ঘটবে! এই সহিংসতার নেপথ্যে রয়েছে আর্থসামাজিক অসমতা ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ, যা উত্তর আফ্রিকার ফরাসি উপনিবেশগুলো থেকে আগত লাখ লাখ ফরাসি নাগরিক হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে।
তবু আমেরিকানদের মতোই ফরাসি কর্তৃপক্ষ এই বাস্তবতাকে আমলে নিতে চায় না। যদিও বাস্তবতা অস্বীকৃতির ফল কদাচিৎ শুভ হয় এবং তাতে করে তাদেরই পতন ত্বরান্বিত হয়। এ সত্যকে অস্বীকার করে যে দায়েস সম্ভবত সহিংসতার একটি ক্ষুদ্র অংশ, যেখানে হুমকির মূল উৎস পাশ্চাত্যের শক্তিধরদের যত্রতত্র হস্তক্ষেপ এবং তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এগুলোই আসলে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সহিংসতার আগুন সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। ইরাক যুদ্ধ না হলে সম্ভবত দায়েসের উৎপত্তির কোনো ক্ষেত্রই প্রস্তুত হতো না।
দায়েসকে লক্ষ করে বোমা হামলায় কিংবা কোনো অঞ্চল থেকে তাদের উৎখাত করার মাধ্যমে তাদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যই হবে, কিন্তু তাতে কি সেই ধারণার মৃত্যু হবে, যার প্রতি আনুগত্যশীল হাজার হাজার তরুণ, যারা ঘরছাড়া হয়েছে এই ধারণারই মোহে? এ রকম অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পেতে হয়তো দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হবে।