Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1kআবু হাসান টিপু।। খােলা বাজার২৪, সোমবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৭: ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারী বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীসমূহের ইতিহাসের এক কলঙ্কদায়ক দিবস। এই দিনটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল এলাকায় অ্যাডভান্সড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (এসিআই) ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানায় একজন অসহায় নিরস্ত্র শ্রমিকের বুকে গুলি চালিয়ে হত্যার পৈচাষিকতা সৃষ্টির করার জঘন্যতম দিবস। শুধুমাত্র মজুরী বৃদ্ধিসহ ৬ দফা দাবীতে আন্দেলন করার অপরাধে কারখানাটির তৎকালীন জিএম ইসতিয়াক ক্রোধান্বিত হয়ে তারই কথিত আত্মীয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসির নেতৃত্বে ঐ মধ্যযুগীয় বর্বরতার সৃষ্টি করে। কারখানাটির মূল গেট বন্ধ করে দিয়ে পুলিশ নির্বিচারে শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। বুকে পিঠে, হাতে-পায়ে গুলি বিদ্ধ হয়ে আন্দেলনরত শ্রমিক এনামুল হকসহ অর্ধশতাধিক শ্রমিক তৎক্ষণাৎ মাঠে লুটিয়ে পরে। তাদের মৃত্যু যন্ত্রনা আর বেঁচে থাকার আকুতি চিৎকারে সেদিন এসিআই-এর আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এসিআই-এর সবুজ ঘাসকে বুকের রক্ত দিয়ে রাঙ্গিয়ে প্রাণ হারান এনামুল হক। বোতলে আটকে পরা মৃত্যু পথযাত্রি কিটের মতো বাঁচার কি যে ছটফটপনী তাই যেন সেদিন প্রত্যক্ষ করেছে নারায়ণগঞ্জের মানুষ।

অথচ অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ঘটনার ১২ দিন পূর্বে স্থানীয় আইইটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে শ্রমিকদের সংকট সমস্যার বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর শ্রমিকরা তাদের এক লিখিত দাবীনামা উত্থাপন করেন মালিক পক্ষের নিকট। সেখানেই তৎকালীন দৈনিক মজুরী ১২০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা ও কর্মরত অবস্থায় অসুস্থ বা আহত শ্রমিকের চিকিৎসাসহ ৬দফা দাবী উত্থাপন করা হয়েছিল, যত দিন পর্যন্ত ৬দফা মানা না হবে তত দিন পর্যন্ত প্রতিদিন এক ঘন্টার কর্ম বিরতিরও ঘোষনা ছিল তাতে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন সকালে শ্রমিকরা কারখানায় হাজিরা দিয়ে কাজ শেষে চা-বিরতিতে বেরিয়ে আসে। এবং তারা কাজে না ফিরে কারখানার ভেতরের মাঠে অবস্থান নেয় তাদের পূর্ব ঘোষিত ১ ঘন্টা কর্ম বিরতির জন্য। এ সময় শ্রমিকরা তাদের দাবি পূরণে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে।

মালিক পক্ষের পরামর্শে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি বদরুল আলমের নেতৃত্বে দাঙ্গা পুলিশসহ শতাধিক পুলিশ সদস্য কারখানার বাইরেও ভেতরে অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কারখানার জিএম ইশতিয়াক আহমেদ কোন প্রকার দাবী-দাওয়া মানা সম্ভব নয় বলে ঘোষণা দিয়ে শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের দাবির প্রতি অনড় থাকে। তখন জিএম পুলিশকে তাদের মতো ব্যবস্থা নিতে বললে পুলিশ শ্রমিকদের বেধড়ক লাঠিপেটা ও রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। এ ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে শ্রমিকরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও বোতল ছুড়ে মারতে থাকলে শুরু হয় উভয়ের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষ। ওষুধ কারখানা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ এলোপাতাড়ি রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। এতে শ্রমিক এনামুল হক গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এনামুলের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হলো এসিআই-এর সবুজ মাঠের প্রান্তর। পরে তাকে নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যা হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

আরিফ, মুন্না, শামীম, আক্তার, হারুন, সাজ্জাদ, সিরাজ, হারুন, আরিফুল আলম, ময়না, সজীব, বিললাল, মামুন, রাসেল, আতিকুল্লাহ, সোহেল, তৌহিদুল ইসলাম জাবেদ, মাছুম, সাদ্দাম, নজরুল, ইউনুছ, আসাদ, রুবেল, রেহেনা, হেলাল, আকতারুজ্জামান, আরিফ, মুরাদ, সাহেদসহ অর্ধশতাধিক শ্রমিক সেদিন পুলিশের লাঠিপেটা ও রাবার বুলেটে রক্তাক্ত আহত হয়েছিলেন। জিএম-এর নির্দেশে কারখানার মূল ফটক বন্ধ করে রাখার কারণে আহতদের সহকর্মীসহ এলাকাবাসী আহত শ্রমিকদের দেয়াল টপকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় ।

নিহত এনামুলের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ভাঙনি বেদগাড়া গ্রামে। সে কারখানার অ্যানিমেল হেলথ বিভাগে কাজ করতো। মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে সহকর্মীদের জানাজা দিতে না দিয়ে রাতের অন্ধকারে এনামুলের লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফলে আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগে আইটি স্কুল সংলগ্ন পদক্ষেপ প্রাঙ্গনে গায়বানা জানাজার আয়োজন করে।

বিকেল হতে না হতেই কয়েক শত পুলিশ ও র‌্যাব দুইজন ম্যাজিষ্ট্রেট-এর নেতৃত্বে জানাজা স্থল দখল করে নেয়; এবং শ্রমিকদের জানাজায় অংশগ্রহন করতে ব্যপক বাধা প্রদান করে। এসিআই শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান উপদেষ্টা আবু হাসান টিপুকে (আমাকে) গ্রেফতারে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বেশ কয়েক জন শ্রমিককে গ্রেফতার করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নিয়ে গিয়ে চরম নির্যাতন করে। এমন কি কারখানাটির মালিক পক্ষ শহীদ এনামুলকেই প্রধান আসামী করে প্রায় আড়াই শতাধিক শ্রমিকের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানাতে ২টি মিথ্যা মামলা করে। এর পরও শ্রমিকরা আন্দোলনের ব্যপারে অনড় থাকলে মালিক পক্ষ অত্যন্ত সুচতুর ভাবে এক সামাজিক মিট-মিমাংশার নামে স্থানীয় কতিপয় টাউট বাটপারকে সংগঠিত করে তাদের মাধ্যমে নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতি পূরণসহ শ্রমিকদের ন্যায় সঙ্গত দাবী-দাওয়া মেনে নেয়ার আশ্বাস প্রদান করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।

এই সামাজিক মিট-মিমাংশার আয়োজনে স্থানীয় টাউট বাটপারদের সাথে দু-এক জন বামপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্বও হালুয়া রুটির লোভ সামলাতে পারেননি। এভাবে শ্রমিক আন্দোলনের পেছন দিয়ে গলায় ছুরি চালিয়ে উক্ত টাউটরা নিজ নিজ পকেট ভারী করলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। এনামুল হত্যার ৬ বছর পার হলেও সেই হত্যার আজও কোন বিচার হয়নি। সময়ের কারণেই শ্রমিকদের কিছু মজুরী ও আনুসাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও এনামুলের রক্তস্নাত সেই ঐতিহাসিক ৬ দফা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। মালিক পক্ষের সেই মিথ্যা মামলা আজও পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি। এখনও তৎকালনি সময়ে গ্রেফতার হওয়া শ্রমিকদের সংশ্লিষ্ট মামলাতে বছরের পর বছর ধরে হাজিরা দিতে হচ্ছে। বহু শ্রমিক আজও চাকুরী হারা। বিচারের বানী যেন আজও নিরবেই কাঁদছে এসিআই-এর আকাশ জুড়ে। আজকের এই দিনে এনামুল তোমাকে লাল ছালাম।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটি।
ফোন: ০১৬৮২-৮১৪৫৬৪।
ইমেইল: [email protected]