Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

20k1আবুল কাসেম ফজলুল হক ।। খােলা বাজার২৪, শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭:
দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের তাগিদ পত্রপত্রিকায় নানাভাবে ব্যক্ত হয়ে আসছিল। ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানসম্মত, একমুখী শিক্ষার দাবি ছিল একদিকে; অন্যদিকে ছিল নাস্তিকতামুক্ত, ইসলামসম্মত, মুসলিম ঐতিহ্য অবলম্বী একমুখী শিক্ষার দাবি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল, সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল—ইত্যাদিও আলোচনায় ছিল। উভয় পক্ষেরই বিতর্কের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের বিজয় ও প্রতিপক্ষের পরাজয়। সত্যসন্ধ বিতর্কে যেমন উভয় পক্ষেরই লক্ষ্য থাকে সত্য, ন্যায়, সুন্দর ও সর্বজনীন কল্যাণ সন্ধান, সে রকম কিছু কি এই বিতর্কে ছিল? আছে? সত্যসন্ধ বিতর্কে কোনো পক্ষেরই পরাজয় হয় না, সত্যের সন্ধানে উভয় পক্ষেরই অবদান থাকে। তাতে যে পক্ষের চিন্তা ও চেষ্টা ভুল প্রমাণিত হয় সে পক্ষের চেষ্টাও সহায়ক হয় সত্য আবিষ্কারে। ঢাকাকেন্দ্রিক জাতীয় সংস্কৃতিতে উত্তেজনাপূর্ণ বড় বড় বিতর্কে ব্যাপারটি একেবারেই থাকে না। তবে সত্যসন্ধ চিন্তা বাংলাদেশে একেবারেই নেই, তা নয়, আছে; কিন্তু সত্যনিষ্ঠ সর্বজনীন কল্যাণচিন্তা প্রচারমাধ্যমের কার্যকর সহায়তা পায় না, আর জনসাধারণ উদাসীন, জনসাধারণ সহজেই হুজুগে মাতে।

একসময় বাঙালিকে বলা হতো ‘হুজুগে বাঙালি’। বিশ শতকের প্রথম দিকে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ‘বাঙালির মস্তিষ্কের অপব্যবহার’ ও ‘The Misuse of Bengalee Brain’ নামে দুটি পুস্তিকা প্রচার করেছিলেন। তখন তিনি বাঙালি সমাজে হুজুগ দেখেছিলেন। আমাদের বুঝতে হবে যে ‘হুজুগ’ আর ‘গণজাগরণ’ এক নয়। গণজাগরণে মহান লক্ষ্য থাকে, মহত্ নেতৃত্ব থাকে এবং জনগণের অন্তর্গত মানবীয় গুণাবলির সক্রিয়তা থাকে। হীন স্বার্থবুদ্ধি তাতে কর্তৃত্ব করে না। আর হুজুগে হীন স্বার্থান্বেষীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা রকম প্রচারের দ্বারা জনসাধারণকে আন্দোলনে মাতিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেয়।

আমাদের এখানে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে বিরোধ ও বিতর্ক, তার একদিকে আছে সংবিধানে নির্দেশিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং অন্যদিকে আছে সংবিধানে নির্দেশিত ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। এ নিয়ে গত ৪৫ বছরের মধ্যে চিন্তার ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যে পারম্পর্য তৈরি হয়েছে, তাতে সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের অভিপ্রায় রাজনৈতিকভাবে ধর্মপন্থীদের চিরবিলোপ, আর ধর্মপন্থীদের অভিপ্রায় রাজনৈতিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের চিরবিলোপ। উভয় পক্ষই চায় শুধু নিজেদের নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র চিরস্থায়ী কর্তৃত্ব ও অপরপক্ষের দুর্গতি ও চিরপরাজয়। এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যেমন আছে, তেমনি আছে বৈষয়িক স্বার্থের ব্যাপার। সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে? জুলুম-জবরদস্তি ও শক্তিপ্রয়োগ দ্বারা সমাধান হবে? আপস-নিষ্পত্তি হবে? কোন পক্ষ সরবে তার অবস্থান থেকে? কোনটা বাদ যাবে—ধর্মনিরপেক্ষতা, না রাষ্ট্রধর্ম? নাকি শেষ পর্যন্ত দুটিই বাদ যাবে? দুটিই বাদ গেলে কী ক্ষতি হবে?

দুই.

এবারের নতুন পাঠ্যপুস্তকে খুব অস্বাভাবিক অনেক ভুল দেখা যাচ্ছে। তার জন্য বিস্তর প্রতিবাদ চলছে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে অন্য সব কিছু ছাড়িয়ে পাঠ্যপুস্তকের ভুল নিয়েই আলোচনা চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভুল স্বীকার না করে পারছে না। স্কুলে স্কুলে সংশোধনের সার্কুলার পাঠিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে যা দেখা যাচ্ছে, তা আসলেই ভুল না, কোনো মতলব হাসিলের জন্য পরিকল্পনামাফিক করা; সে প্রশ্নও তুলছে কেউ কেউ। কিন্তু বুঝে ওঠা কঠিন। এসব বইয়ের যাঁরা লেখক, পরিমার্জক, সংকলক, সম্পাদক—প্রতিটি বইতে ডজনখানেক ডক্টর, প্রফেসর ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞের নাম আছে, তাঁরা বলছেন, তাঁরা এসব করেননি, তাঁরা এসব সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাঁদের অজ্ঞাতে, তাঁদের সম্মতি না নিয়ে, তাঁদের দেওয়া পাণ্ডুলিপি পরিবর্তন করে বই ছাপা হয়েছে। তাঁদের নাম অবশ্য লেখক, পরিমার্জক, সংকলক ও সম্পাদক হিসেবে ছাপা আছে। এনসিটিবির কর্মকর্তা তিনজনকে অভিযুক্ত করে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আমার মনে হয়, একজন-দুজন-তিনজনের ভুলের কিংবা নৈপুণ্যহীনতার কিংবা অযোগ্যতার ফলেই এটা ঘটেছে এমন নয়, একটি দীর্ঘস্থায়ী চরম অপব্যবস্থার মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই এটা ঘটেছে। গোটা অপব্যবস্থা অপরিবর্তিত রেখে, Status quo রক্ষা করে, কিছু লোককে শাস্তি দেওয়ার প্রদর্শনী আর জোড়াতালি দিয়ে অবস্থার উন্নতি সাধন করা যাবে? অপব্যবস্থা বহাল রেখে শিক্ষার উন্নতি আশা করা তো আহাম্মকি মাত্র। পাঠ্যপুস্তকের ভুল নিয়ে এই যে হৈচৈ, প্রতিবাদ, এর মধ্যে কোথাও কিন্তু অপব্যবস্থা নিয়ে একটি কথাও কেউ বলছে না। সব ঠিক আছে, কিছু লোকের ভুলের জন্য এমনটি হয়েছে, আগামী বছর থেকে সব ঠিক চলবে, ব্যাপার কি এ রকম? এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এ দেশে জাতি (Nation) গঠিত হবে? রাষ্ট্র (State)) গঠিত হবে? উন্নত জীবনের বাস্তবতা তৈরি হবে? জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে সৃষ্টিশীলতা দেখা দেবে?

রাজনীতিবিদরা, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো, সিভিল সোসাইটে সংগঠনগুলো, এনজিওপতিরা—জনসাধারণও কি শুভবুদ্ধি অবলম্বন করে চলছে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সমাজে শুভবুদ্ধি ও অশুভবুদ্ধির অন্তর্দ্বন্দ্বের রূপ-স্বরূপ কী? বাংলাদেশে যাঁরা শুভবুদ্ধির আদমজি-ইস্পাহানি, টাটা-বিড়লা, রকফেলার-বিল গেটস, তাঁরা কি অন্তর্গত শুভবুদ্ধি অবলম্বন করে চলছেন? নাকি অশুভবুদ্ধি? প্রসংগত বঙ্কিমচন্দ্রের একটি উক্তি স্মরণ হয় : ‘চিত্তশুদ্ধি থাকিলে সকল মতই শুদ্ধ, চিত্তশুদ্ধির অভাবে সকল মতই অশুদ্ধ। যাহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তাহার কোনো ধর্ম নাই। যাহার চিত্তশুদ্ধি আছে, তাহার আর কোনো ধর্মেরই প্রয়োজন নাই।

চিত্তশুদ্ধি কেবল হিন্দুধর্মের সার, এমত নহে, ইহা সকল ধর্মের সার। ইহা হিন্দুধর্মের সার, খ্রিস্টধর্মের সার, বৌদ্ধধর্মের সার, ইসলাম ধর্মের সার, নিরীশ্বর কোঁত্ধর্মের সার। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি আছে, তিনি শ্রেষ্ঠ হিন্দু, শ্রেষ্ঠ খ্রিস্টিয়ান, শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ, শ্রেষ্ঠ মুসলমান, শ্রেষ্ঠ পজিটিভিস্ট। যাঁহার চিত্তশুদ্ধি নাই, তিনি কোনো ধর্মাবলম্বীদিগের মধ্যেই ধার্মিক বলিয়া গণ্য হইতে পারেন না। …চিত্তশুদ্ধি মনুষ্যদিগের সকল বৃত্তিগুলির সম্যক স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যের ফল। ’

বুঝতে হবে যে চিত্তশুদ্ধি হঠাত্ এক দিনে অর্জন করে ফেলার মতো ব্যাপার নয়, জীবনব্যাপী সাধনার ব্যাপার। চিত্তশুদ্ধি শুধু মানসিক অনুশীলনের ব্যাপার নয়, সব রকম কাজকর্মের ও জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে অনুশীলনের ব্যাপার। চিত্তশুদ্ধি শুধু ব্যক্তিগত অনুশীলনের ব্যাপার নয়, সামাজিক, জাতীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তরাষ্ট্রিক অনুশীলনের ব্যাপার। চিত্তশুদ্ধি শুধু এক জেনারেশনের ব্যাপার নয়, জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে অনুশীলনের ব্যাপার। চিত্তশুদ্ধিতে পূর্ণতা অর্জনের চেষ্টা জীবনব্যাপী, জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে চালিয়ে যেতে হয়। চিত্তশুদ্ধি শুধু পূজা-অর্চনা ও নামাজ-রোজার ব্যাপার নয়, ব্যক্তিগত-পারিবারিক, আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সব কাজেরই ব্যাপার। গান্ধী আশা করেছিলেন, মানুষ অহিংস প্রাণী হয়ে উঠবে। সেটা যে রাতারাতি হয়ে ওঠার ব্যাপার নয়, শুধু ব্যক্তিগত অনুশীলনের ব্যাপার নয়, জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে অনন্ত সাধনার ব্যাপার ইত্যাদি বোঝার সামর্থ্য ছিল। তাঁর সত্যাগ্রহ, সর্বোদয়, অসহযোগও তেমনি যুগ যুগ ধরে অনন্ত অনুশীলনের ব্যাপার। অর্থনীতিবিদরা এসব ব্যাপার একটুও বুঝতে চান না। তাঁরা শুধু টাকা, ডলার, পাউন্ড দিয়ে সব কিছু বিচার করেন এবং মানবীয় ব্যাপারগুলাকে ঔদাসীন্য দিয়ে উড়িয়ে দেন। তাঁদের বিবেচ্য শুধু মাথাপিছু গড় আয়, মোট জাতীয় আয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব সরকারের পর থেকেই আমি নৈতিক ব্যাপারকে আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যাপারগুলোর মর্মে বিবেচনায় গ্রহণ করার জন্য বলে আসছি, লিখে আসছি। এ জন্য সাধারণ মানুষ আমার সঙ্গে সহমর্মিতা অনুভব করে, এটা বুঝতে পারি। যাঁরা ধর্মপন্থী হিসেবে সক্রিয় তাঁরা আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন—এটাও বুঝতে পারি। মার্ক্সবাদীদের অনেকে নৈতিক বিষয়কে বিবেচনার বিষয় নয় বলে মনে করেন এবং তাঁরা মনে করেন, সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি ঠিক করা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাঁরা আমার চিন্তার প্রতি বিরূপ। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী তাঁরা মনে করেন, নৈতিক বিষয়াদি ধর্মীয় লোকদের ব্যাপার, আমি নৈতিক প্রশ্ন সামনে এনে ধর্মীয় ধারার সহায়তা করি, এ জন্য তাঁরা আমার প্রতি বিরূপ। এই অবস্থায় চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও নিঃসঙ্গ আমি আমার উপলব্ধি ভয়ে ভয়ে ব্যক্ত করি। সাধারণ মানুষ তো দুর্বল। তাদের তো নেতৃত্ব নেই! বাস্তবে দেখতে পাই, ‘এ সমাজে যার ক্ষতি করার শক্তি যত বেশি তার প্রভাব-প্রতিপত্তি তত বেশি। মানুষের কল্যাণ করার শক্তি এ সমাজে কোনো শক্তি বলেই স্বীকৃতি পায় না। ’ সাধারণ মানুষ প্রবলদেরই অর্চনা করে, হুজুগে চলে। রবীন্দ্রনাথের একলা চলার গান, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে…’ আমার প্রিয়। কিন্তু বঙ্কিমের কথাও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না : ‘কেহ একা থাকিস না। যদি অন্য কেহ তোমার প্রণয়ভাগী না হইল, তবে তোমার মনুষ্যজন্ম বৃথা। পুষ্প সুগন্ধি, কিন্তু যদি ঘ্রাণগ্রহণকর্তা না থাকিত তবে পুষ্প সুগন্ধি হইত না। ঘ্রাণেন্দ্রিয় বিশিষ্ট না থাকিলে গন্ধ নাই। পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না। পরের জন্য তোমার হূদয়কুসুমকে প্রস্ফুটিত করিও। ’

সমস্যা নেতৃত্ব নিয়ে। সাধারণ মানুষ নিজেরা নিজেদের থেকে, নিজেদের জন্য নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে না।

তিন.

পাঠ্যপুস্তকের ভুল নিয়ে সমালোচনার মধ্যে সামনে এসেছে পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতীকরণের প্রশ্ন। বলা হয় যে ইসলামী ঐক্যজোট ও হেফাজতে ইসলামের প্রস্তাব অনুযায়ী লেখক, পরিমার্জক, সংকলক, সম্পাদকদের চূড়ান্ত করা পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং কিছু ভিন্নধর্মী লেখা অন্তর্ভুক্ত করে দেশব্যাপী ছাত্রদের হাতে বই দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, হেফাজতে ইসলামের দেওয়া ২৭ দফা প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করে চলেছে। রাষ্ট্রধর্মপন্থীদের থেকে নানাভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে ‘শিক্ষা আইন ২০১৬ জাতিকে নাস্তিক বানানোর নীলনকশা। ’ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষ থেকে পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতীকরণের তীব্র নিন্দা জানানো হচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোট ও হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনকে অভিনন্দিত করেছে। বিরোধের পরিণতি কী হবে?

গণতন্ত্রকে পরিণত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচনের অবস্থা সবাই জীবন দিয়ে উপলব্ধি করে। পাঠ্যপুস্তকের ফেফাজতীকরণ ও জাতীয় সংসদের নির্বাচন তো অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত। আশির দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি হুজুগসর্বস্ব। দেশি-বিদেশি হীন স্বার্থানেষীদের সৃষ্টি করা হুজুগে লোকে সহজেই মাতে। এ দেশের ভালো হবে কিভাবে? বিদ্যাসাগরের শেষ জীবনের একটি উক্তি স্মরণ হয় : ‘এ দেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাত পুরু মাটি তুলিয়া সম্পূর্ণ নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে তবে এ দেশের ভালো হয়। ’ আসল ব্যাপার তো পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষা নয়, আসল ব্যাপার রাজনীতি। রাজনীতির কি উন্নতি হচ্ছে? হবে? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামপন্থীদের বিরোধের মীমাংসা হচ্ছে? হবে?

চার.

অতীতের কথা বলে কোনো লাভ নেই। অতীত কখনো ফিরে আসে না। History never repeats itself. তবু নানা উদ্দেশ্যে অতীতের কথা প্রচার করা হয়।

আমার হাতে আছে আমি যখন ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি তখনকার বাংলা বই। এটি প্রণীত হয় ১৯৫৫ সালে। কয়েক বছর তা পাঠ্য ছিল। আমি সেটি পড়েছি। পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড প্রকাশিত সে বই অত্যন্ত চমত্কার। সেটার সংকলক ও সম্পাদক রূপে নাম ছাপা আছে একজন মাত্র ব্যক্তির, তিনি বেনজির আহমদ। তাতে বোর্ডের সভাপতি আলী আসগর শাহ লিখিত এক পৃষ্ঠার একটি ভূমিকা আছে। ভূমিকায় দেখা যায়, বোর্ড বইটি প্রণয়ন করে দেওয়ার জন্য বেনজির আহমদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। বেনজির আহমদ কিন্তু ম্যাট্রিকও পাস ছিলেন না। অথচ তাঁর সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাংলা সাহিত্য’ বইটি দুই বছর ধরে পড়ে আমরা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছি। এখন তো এনসিটিবির প্রতিটি বইয়ে লেখক, সংকলক, সম্পাদক, পরিমার্জক হিসেবে ১৫ জন ডক্টর-প্রফেসরের নাম মুদ্রিত থাকে। যাঁদের নাম থাকে তাঁরা প্রত্যেকেই অনেক বড় পণ্ডিত। পণ্ডিত বড় হলেও তাঁদের কাজ দেখলে মনে হয়, তাঁদের বিদ্যার বহর কম। লোকে বলে, ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট। ’ ব্রিটিশ আমলের বই, পাকিস্তান আমলের বই, বাংলাদেশ আমলের বই, পাঠ্যসূচি, শিক্ষাক্রম—সব কিছুতেই পরিবর্তন আছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতাও পরিবর্তিত হয়েছে। তখন আমরা পরাধীন ছিলাম, এখন স্বাধীন। স্বাধীনতার পর আমাদের গতি কি ভালোর দিকে? আমাদের শিক্ষার ও জাতির ভবিষ্যত্ কী?

মাদ্রাসা ধারাগুলো, ইংরেজি মাধ্যমের দেশি-বিদেশি ধারাগুলো, বাংলা মাধ্যমের ধারাগুলো—সব নিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা গোটা পৃথিবীতে জটিলতম। ‘শিক্ষা আইন ২০১৬’ পড়ে বুঝতে গেলে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার জটিলতা দেখে শরীর শিহরিত হয়—এই শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জাতি ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ ভেবে শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না।

বেনজির আহমদ সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাংলা সাহিত্য’ বইটিতে ‘পূর্ব পাকিস্তানি ও পাকিস্তান’ কথা দুটির জায়গায় ‘বাংলাদেশ’ বসিয়ে তা পাঠ্য করলে এখনকার বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমার ধারণা। ওই বই আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে ও জানতে, বাংলা সাহিত্যকে জানতে ও বুঝতে, সর্বোপরি আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি দ্বারা প্রণীত এখনকার বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে চেতনা জাগায়, তা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?

যাঁরা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ নিয়ে বিবাদ করতে করতে আমাদের জাতির ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যেক অন্ধকারের দিকে নিয়ে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে কি আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মসমালোচনা ও সর্বজনীন কল্যাণের বোধ জাগবে না? তাঁদের নেতৃত্বের চরিত্র কি উন্নত হবে না? তাঁদের মধ্যে শুভবুদ্ধির অনুশীলন কি দেখা দেবে না? অমানুষের ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না। কিন্তু মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখার কারণ পাই। ভালো-মন্দ মিলিয়ে মানুষ। ব্যক্তি মানুষের চেয়ে সম্মিলিত মানুষ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সৃষ্টিশীল-প্রগতিশীল ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ। ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে ক্রমাগত বদলায়। ’ আমি চাই মানুষ ভেতরে থেকে পরিবর্তিত হোক, ভালোর দিকে আমাদের জাতির যাত্রা সূচিত হোক। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায়, জেনারেশনের পর জেনারেশনের চেষ্টায় পৃথিবীই স্বর্গে পরিণত হবে। বাংলাদেশে সেই চেষ্টা সূচিত হোক।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[সংকলিত]