খােলা বাজার২৪, শনিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭: গরুর বদলে এখন চাষ হয় ট্রাক্টর দিয়ে। আগে ধান পাকলে কাটত মানুষ, এখন পাকা ধান মাড়াইয়ের যন্ত্রও আছে। মানুষই এসব যন্ত্র চালায়। এবার মানুষ ছাড়া যন্ত্র চালনারও সময় চলে এসেছে। বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছেন ফসলের জন্য মাটি তৈরি, বীজ বপন ও উৎপাদন—এসব কোনো কাজেই আর মানুষের প্রয়োজন নেই। মেশিনই কাজ করবে মাঠে, দিন থেকে রাত, ২৪ ঘণ্টা। শস্যের উৎপাদন বাড়াতেই এমন ব্যবস্থা।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা যদি বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে খাবারের প্রয়োজন পড়বে বর্তমানের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। আর বর্তমান পদ্ধতিতে চাষ চললে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ শস্যের উৎপাদন কমবে ২৫ শতাংশের মতো। আবার মানুষ বাড়লে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে উৎপাদন কমবে আরো! সুতরাং জমি আর বর্তমান আবাদ ব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখলে চলবে না। কঠিন এ সমস্যা দূর করতে তাই কোমর বেঁধে নেমেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এমন একটি সমাধানের দিকে যাচ্ছেন, যেখানে আবাদি জমির প্রয়োজনীয়তা কমবে। শস্য উৎপাদন হবে অটোমেটিক কারখানায়। সেখানে বহুতল ভবনের প্রতি তলায় থাকবে নির্দিষ্ট শস্য উৎপাদনের জন্য উপযোগী সেট-আপ। সেখানে কাজ করবে বিভিন্ন ধরনের রোবট।
এমন একটি খামারের কাজ শেষ পর্যায়ে। খামারটিতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে প্রতিদিন উৎপন্ন হবে ৩০ হাজার লেটুস। শুধু প্রথম বীজ বপনে মানুষ লাগবে। বাকি সব হবে স্বয়ংক্রিয়। জাপানের কিয়োটো শহরের স্প্রেড নামের এই খামারের উৎপাদন শুরু হবে এ বছর থেকেই।
স্প্রেডের আন্তর্জাতিক বিপণন ব্যবস্থাপক জে জে প্রিন্সের মতে, জাপানের মতো আবাদি জমির পরিমাণ কম আছে, এমন দেশগুলোয় এ ধরনের খামারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। তিনি জানান, এই খামারটি আকাশচুম্বী ভবনের মতো। এর বিশেষায়িত এলইডি লাইট প্রযুক্তি শস্য ও সবজি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় আলো সরবরাহ করবে। এ যেন সিনেমা। ১৯৭২ সালের ‘সাইল্যান্ট রানিং’ সিনেমায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সব দেশের হয়তো জাপানের মতো ইনডোর সমাধানের প্রয়োজন নেই। তবে কৃষিক্ষেত্রে বিশ্ব স্বয়ংক্রিয় সমাধানের দিকে ঝুঁকছে। মার্কিন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইন্টার গ্রিন রিসার্চের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় কৃষিজ যন্ত্রের বাজার ৮২ কোটি ডলার থেকে বেড়ে হবে এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার। বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্সের পূর্বাভাস আরো বেশি, তাদের মতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই বাজারের আকার হবে ২৪ হাজার কোটি ডলার।
যেভাবে কাজ করবে
কৃষিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তিকে ‘ইন্টারনেট অব প্লান্টস অ্যান্ড ফিল্ডস’ নাম দিয়েছেন ডিপফিল্ড রোবটিকসের ড. ডোনাল্ড লেইনফ্রস্ট। জার্মান এই প্রতিষ্ঠানটি ড্রোন প্রযুক্তিতে সন্দেহজনক গাঁজা চাষের স্থান শনাক্ত করে। এদিকে ইংল্যান্ডের শর্পশয়ার কম্পানি চেষ্টা করছে ড্রোন ব্যবহার করে পুরো জমি নখদর্পণে রাখতে। এখানে ড্রোনই মাঠের পাশে থাকা বিভিন্ন যন্ত্রকে নির্দিষ্ট কাজ করতে নির্দেশনা দিবে। প্রতিটি যন্ত্রে থাকবে একটি করে ট্যাবলেট কম্পিউটার। ড্রোন থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করবে ট্যাবলেটটি। এসব যন্ত্র চালনার শক্তির উৎস হিসেবে সৌরশক্তি ব্যবহার করা হবে। সাধারণত খোলা মাঠে দিনের বেলায় প্রচুর পরিমাণে সূর্যের আলো থাকে। প্রতিটি যন্ত্রেই থাকবে নিজস্ব সোলার সেল। এসব সেলে জমে থাকা শক্তি দিয়ে যন্ত্র চালানো যাবে ১২ ঘণ্টার মতো। অর্থাৎ রাতেও কাজ চলবে নিরবচ্ছিন্ন। বিশ্বের বড় কিছু খামারে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার চলছে।
চ্যালেঞ্জ
সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আগাছা ছাঁটা। শস্যের খামার মানেই আগাছা। আগাছা চেনার জন্য যন্ত্রের থাকা চাই বিশেষ বুদ্ধিমত্তা। সেটিও আছে। তবে দিনের আলোয় একসঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় বলে অনেক গাছের মধ্যে আগাছা শনাক্ত করতে রোবটের সমস্যা হয়। রাতে আবার এ সমস্যা নেই। কারণ রাতে রোবটের নিজস্ব আলোয় অল্প কয়েকটি গাছ দেখা যায়।
এ ব্যবস্থার আরেক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ইন্টারনেট সংযোগ। ইন্টারনেট যদি হুট করে সমস্যা করে, তাহলে মেশিন উল্টাপাল্টা কাজ করে সর্বনাশ করতে পারে।
এ সমস্যা সমাধান করতে ইনস্টিটিউট অব কগনেটিভ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ড. ভিতো ট্রিয়ানি বলছেন, এসব ক্ষেত্রে থ্রিজি বা ফোরজি ইন্টারনেটের ওপর ভরসা না করে বরং আল্ট্রা-ওয়াইডব্যান্ড রেডিও প্রযুক্তির ওপর ভরসা করাই ভালো।