
আপনার ল্যাবরেটরি আর যন্ত্রপাতি কোথায়?
প্রশ্নের উত্তরে আইনস্টাইন মাথা দেখিয়ে বলতেন, ওইটাই তাঁর ল্যাবরেটরি আর কাগজ-কলম হলো তাঁর গবেষণার যন্ত্রপাতি। ছোটবেলায় যখনই কেউ ভালো অঙ্ক করে বা বিজ্ঞানে তার প্রতিভা দেখায়, তখনই বেশির ভাগ লোক তাকে ‘ছোট্ট আইনস্টাইন’ বলে ডাকে। আর একটু বড় হলে, বিশেষ করে হাইস্কুলে বা কলেজে অনুরূপ ক্ষেত্রে সেটি হয় ‘তরুণ আইনস্টাইন’। কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের বেশির ভাগ মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের আইনস্টাইন বানাতে চান! তবে অন্য অনেক বিজ্ঞানীর মতো আইনস্টাইন কিন্তু ছোটবেলায় ক্লাসে ফার্স্ট হতেন না। এমনকি কখনো কখনো স্যারদের বকাও খেতেন। কিন্তু চিন্তার স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে আইনস্টাইন ছিলেন ব্যতিক্রম।গ্যালিলিও ছিলেন এক্সপেরিমেন্টাল বিজ্ঞানী। হাতে-কলমে করার লোক। যেমন তিনি একটা লোহার বলকে একটা কাঠের পাটাতনে গড়িয়ে দিতেন। তারপর ওই পাটাতনকে ক্রমাগত মসৃণ করতে থাকলেন। দেখলেন, সেটি যত মসৃণ হয়, ততই বলটি বেশি দূর যায়। আর এ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বাধা না থাকলে চলন্ত বস্তু চলতেই থাকবে। গ্যালিলিওর এ সিদ্ধান্তটি পরে নিউটনের বলবিদ্যার প্রথম সূত্র হিসেবে পরিচিতি পায়। পরীক্ষণ আর দালিলীকরণে নিউটন আবার ছিলেন পটু। তিনি মনে কোনো খটকা থাকলে সেটি পরীক্ষা করে দেখতেন। গ্যালিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি বায়ুশূন্য নলে স্বর্ণমুদ্রা ও পালকের পরীক্ষা করেন।
অন্যদিকে আমাদের আইনস্টাইন ছিলেন হাতে-কলমে কাজের ব্যাপারে খুবই অলস। তিনি কেবল ‘চিন্তন পরীক্ষা’ করতে ভালোবাসতেন। আর সেগুলো করেই তিনি আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিশেষ এবং সাধারণ রূপটি খুঁজে পান। ১৯০৫ সালে জার্মান ভাষায় একটি জার্নালে তাঁর একাধিক ধারণা প্রকাশিত হয়, যার প্রতিটিই ছিল যুগান্তকারী। আমার নিজের ধারণা, ১৯০৫ সালের দিকে তিনি যে তিনটি একেবারে নতুন ধারণা নিয়ে আসতে পেরেছেন, তার কারণ হলো তাঁর কোনো সুপারভাইজর ছিল না! ফলে তিনি তাঁর ইচ্ছেমতো কল্পনার ডানা মেলতে পেরেছিলেন। আইনস্টাইনের এই আলস্যের কারণে নোবেল পুরস্কার কমিটি বেজায় বিপদে পড়েন। ১৯১৯ সালে স্যার আর্থার এডিংটন ব্রাজিলের জঙ্গলে গিয়ে আলোর পথ বেঁকে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রমাণ করে আসেন। কিন্তু নোবেল কমিটির ‘পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হতে হবে’ আপ্তবাক্যের কাছে সেটি তো তুলনীয় নয়। তবে, শেষ পর্যন্ত ১৯২২ সালে সেই ১৯০৫ সালের আলোর তড়িৎ ক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন আর এ কারণে স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। সুরের ঐকতানের কারণে দুনিয়াজুড়ে একটা ঐকতানের পক্ষে ছিলেন। কাজেই নিলস বোর আর হাইজেনবার্গের নেতৃত্বে যখন কোয়ান্টাম বিশ্ব বিকশিত হচ্ছে, তখন তিনি এর বিরোধিতা করেন। অথচ ১৯০৫ সালে আলোর তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনিই প্রথম কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় সলভে কনভেনশনে নিলস বোরদের সঙ্গে তাঁর যে ঝগড়া, তা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানকেই এগিয়ে নিয়েছে। তবে অনেকে বলেন, সলভে কনভেনশনের সময়ে আইনস্টাইনের কোয়ান্টাম বিরোধিতার একমাত্র কারণ বেহালার সুর নয়। তত দিনে আইনস্টাইন বুড়ো হয়েছেন। আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালের মার্চের ১৪ তারিখে।
কোয়ান্টাম জগতে আইনস্টাইনকে মনে হয় বেচারা আইনস্টাইন! তবে, তিনি তরুণদের খুবই পছন্দ করতেন। এ কারণে আমাদের সত্যেন বসুর কাজটিকে সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন। গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরে জন্ম হয়েছিল নিউটনের। গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পরে স্টিফেন হকিংয়ের জন্ম। আর আইনস্টাইনের মৃত্যুর বছরে বিল গেটস আর স্টিভ জবসের। এ যেন ইতিহাসের ব্যাটন রেস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সত্য ও সুন্দরের পতাকা বহন করে চলা।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাড়িতে আইনস্টাইন থাকতেন, তার কাছেই এখন থাকেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান। হয়তো একদিন তিনি বিজ্ঞানের মহিরুহতে পরিণত হবেন।
আজ মহামতি আইনস্টাইনের জন্মদিন। কোনো একদিন পৃথিবীর ইতিহাস লেখা হবে চার পৃষ্ঠায় আর তার তিন পৃষ্ঠাজুড়ে থাকবে কেবল আইনস্টাইনের কথা।
শুভ জন্মদিন, আইনস্টাইন!