Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

11kএ কে এম আতিকুর রহমান । খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ২৯ মার্চ ২০১৭:  পৃথিবীতে মানব সভ্যতার বিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষ সংগঠিত হতে শেখে। নিজেদের কল্যাণে বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় মানুষের মনে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক হয়। সংগঠিত হওয়ার জন্য নেতৃত্ব বিষয়টিও একই সঙ্গে চলে আসে। আর মনের অজান্তে এভাবেই সমাজে রাজনীতির চর্চা শুরু হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তাধারাও বিকশিত হতে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন অবয়বে। তাই হিসাব করলে রাজনীতির ইতিহাস অবশ্যই হবে খুব দীর্ঘ, প্রাচীন ও বৈচিত্র্যময়।

আমরা জানি, একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে এমন একটি কাঠামো, যা একটি সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পদ্ধতিকে উপস্থাপন করে। রাজনীতি ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে সংগঠন। সাধারণত কোনো ব্যক্তি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাইলে তাকে অবশ্যই সংগঠনের আশ্রয় নিতে হবে। এখানে একটি কথা না বলে পারছি না যে রাজনীতির বিচরণ যেমন গণতান্ত্রিক দেশে রয়েছে, তেমনি রয়েছে সামরিকশাসিত বা রাজতান্ত্রিক দেশেও। তবে পার্থক্য শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব, কর্মকাণ্ড এবং দেশ শাসনের উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে।

জনগণের জন্যই রাজনীতির জন্ম, বিস্তার ও উৎকর্ষ। আর রাজনীতির কারণেই রাজনীতিকদের অস্তিত্ব। জনগণ, রাজনীতি এবং রাজনীতিক—এই তিনটি শব্দের সম্পর্ক একটি অতি সহজ সমীকরণে আবদ্ধ। মূলত এগুলো শুধু তিনটি শব্দই নয়, তিনটি বিশাল বিষয়। তবে এ কথা সত্যি যে রাজনীতি ও রাজনীতিক ছাড়া জনগণ চলতে পারে, তবে জনগণ না থাকলে অন্য দুটির কোনো অস্তিত্বই থাকে না। তাই তো রাজনীতিতে বা রাজনীতিকদের কাছে জনগণ এত গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় বলতে গেলে, জনগণ রাজনীতি সৃষ্টি করে এবং রাজনীতি সৃষ্টি করে রাজনীতিকদের। এই তিনের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবেশ, শান্তি, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্যতা।

রাজনীতির অনুশীলন প্রাথমিকভাবে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা লাভের জন্য শুরু হলেও বর্তমানে প্রায়ই ব্যতিক্রম অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। একজন রাজনীতিক ক্ষমতা লাভের পর জনগণের কল্যাণের কথা ভুলে সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করেন নিজের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য। তিনি মনে রাখেন না যে জনগণই হচ্ছে শক্তি আর ক্ষমতার উৎস। তাই নিজের স্বার্থ দেখতে গিয়ে জনগণ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসব এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ভয়াবহ প্রভাব শুধু ওই রাজনীতিকের ওপরই পড়ে না, রাজনীতিকে আদর্শচ্যুত করে জনমনে ওই দলের প্রতি আস্থাহীনতার জন্ম দেয়। ধীরে ধীরে তিনি জনগণের বা রাজনীতির মাঝ থেকে হারিয়ে গেলেও সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশ ও জনগণ।

বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে অনেককেই দেখা যায় সাধারণ নির্বাচন এগিয়ে এলে তাঁরা জনগণের কাছে ভোটের জন্য ছুটে যান। নির্বাচনী এলাকায় তাঁদের আসা-যাওয়া চলতে থাকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত। নির্বাচনে বিজয়ী হলে কিছুদিন পর্যন্ত তাঁদের আসা-যাওয়া অব্যাহত থাকে। তবে ধীরে ধীরে তাঁরা নির্বাচনী এলাকায় যাওয়া কমিয়ে দেন বা নিজের বিশেষ কাজ ছাড়া পারতপক্ষে যান না। রাজধানী ঢাকাতেই তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে দাঁড়ায়। যত দিন জনগণের কাছে ক্ষমতা ছিল তত দিন জনগণের কাছে গেছেন, ভোট প্রার্থনা করেছেন। এখন সব ক্ষমতা তাঁদের হাতে এসেছে, জনগণ তাঁদের কাছেই আসবে এবং কোনো কিছু পেতে হলে তা প্রার্থনা করবে। দিনের পর দিন তাঁদের পেছনে ঘুরবে যত দিন না তাঁরা সদয় হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। নির্বাচনের সময় গ্রামের যে ব্যক্তিটির সঙ্গে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বসে চা পান করেছিলেন এবং ভোট চেয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিকে এখন আর চিনতেও পারেন না। এ ধরনের উদাহরণ পরবর্তী নির্বাচন না আসা পর্যন্ত চলতেই থাকে।

যে জনগণ তাঁদের ক্ষমতা দিয়েছে দেশ ও জনগণকে সেবা করার জন্য, তাঁরা সেবকের পরিবর্তে প্রভু বনে যান। জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিল নির্বাচনের আগে, তা ভেঙে খান খান হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে যেসব উন্নয়নমূলক কাজকর্ম হয়, সেসব নিজে বা পছন্দের ব্যক্তিদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতেই হয়ে থাকে। কিন্তু এতে কোনো সুফল বয়ে আনে না। বরং জনগণ থেকে দূরত্বের সৃষ্টি করে। অথচ সব সময় এলাকায় যাতায়াত থাকলে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততাই শুধু দৃঢ়তর হতো না, এলাকার যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রণয়ন, তদারকি ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা সহজ হয়ে যেত।

রাজনীতিতে স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্র কতটুকু পর্যন্ত বিস্তৃত, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। দেশ, কাল ও পাত্রভেদে এর বিস্তৃতি আমরা লক্ষ করে থাকি। জানি না এ বিষয়ক কোনো সূত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্থান পেয়েছে কি না। যেহেতু রাজনীতি নামক মাধ্যমের দ্বারা জনগণ ও রাজনীতিকদের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে, সেহেতু রাজনীতির স্থিতিস্থাপকতা বলতে এখানে জনগণ ও রাজনীতিকদের সম্পর্কের মাত্রাকে বোঝানো হয়েছে। রাজনীতিতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনগণ রাজনীতির সুফল ও কুফল ভোগ করে থাকে রাজনীতিকদের কারণে। তাই একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত রাজনীতিকদের গতিবিধি বা কার্যকলাপ জনগণের গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে থাকে। ওই সীমা ছাড়িয়ে তা যতই বেশি দূরত্বে যাবে, সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ততই গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যান। জনগণ ও রাজনীতিকদের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে সমানুপাতিক, তবে বিপরীতমুখী। অর্থাৎ এ দুয়ের মধ্যে যতই দূরত্ব বাড়বে, ততই রাজনীতিকদের গণসম্পৃক্ততা সমানুপাতিক হারে কমতে থাকবে। ফলে রাজনীতি দুর্বল হবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো হোঁচট খেতে পারে।

জনগণকে এক পাশে রেখে বা উপেক্ষা করে বর্তমান পৃথিবীতে কোনো রাজনীতিকের রাজনীতি করা একটি অকল্পনীয় ব্যাপার। যাঁরাই যখন এ কাজটি করতে গেছেন তাঁরাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। অনেক সময় সামরিক শাসকরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে দেশ চালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু জনগণ ওই শাসনকে ঘৃণা করে, প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে এবং গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। পরিশেষে ওই সামরিক শাসকরা হয়তো দেশ ছেড়ে পালায়, নতুবা তাদের স্থান হয় নিভৃত কারাগারে। ইতিহাসে এমন নজিরের অভাব নেই। জনগণকে উপেক্ষা করার পরিণতি সব সময়ই ভয়াবহ হয়ে থাকে। যত শক্তিধর রাজনীতিকই হোন না কেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকা যায় না। একদিন চরম পরিণতি তাঁকে বরণ করতেই হয়, এর থেকে নিস্তার নেই। কারণ জনগণই হচ্ছে রাজনীতিকদের ক্ষমতা প্রদানকারী। আর ক্ষমতা দেওয়া হয় একমাত্র জনগণকে সেবা করার জন্যই। এর ব্যত্যয় ঘটালেই ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা।

তাই যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত বা রাজনীতিকে যাঁরা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁরা যদি সত্যিকারভাবে দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে তাঁদের গণসম্পৃক্ততা দৃঢ়তর করার বিকল্প নেই। মালয়েশিয়ায় প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর কর্মরত থাকাকালে শুক্র, শনি ও রবিবার কখনো কোনো দেশের জাতীয় বা স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান করতে দেখিনি। কারণ রিসেপশন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য কোনো মন্ত্রী বা উপমন্ত্রীকে শুক্রবার বিকেল থেকে রবিবার পর্যন্ত কুয়ালালামপুরে পাওয়া যায় না। রাজধানীতে জরুরি কোনো প্রয়োজন ছাড়া মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা সাপ্তাহিক ছুটির সময় যে যাঁর নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করেন। এ কারণে এলাকার লোকজন সাধারণত কুয়ালালামপুরে এসে কারো বাসায় ভিড় জমায় না। এলাকায় বসেই তাদের সুখ-দুঃখের কথা, সমস্যার কথা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জানতে পারেন। এই সাপ্তাহিক যাতায়াতের ফলে জনগণ রাজনীতিকদের কাছে পায়, সুখ-দুঃখের ভাগী হিসেবে মনে করে। এ ছাড়া এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ সরাসরি পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করার সুযোগ থাকে। জবাবদিহি নামক প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। রাজনীতিকদের সঙ্গে জনগণের এই সম্পৃক্ততা শুধু তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতিকেই শক্তিশালী করে না, এর প্রভাব পড়ে দেশের সার্বিক রাজনীতিতে।

মালয়েশিয়ার এ আয়োজন যদি একটি প্রশংসনীয় ও কল্যাণকর উদ্যোগ বলে মনে হয়, তাহলে আমাদের দেশে কি এ ধরনের কিছু একটা আমরা করতে পারি না? বাংলাদেশে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকে। সংসদ অধিবেশনের সময় ছাড়া অন্ততপক্ষে এ দুদিন আমাদের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা তাঁদের নির্বাচনী এলাকায় রীতিমতো অবস্থান করতে পারেন। এর ফলে তাঁরা এলাকার জনগণের সব সমস্যার কথা, সুখ-দুঃখের কথা এলাকায় বসেই জানতে পারবেন। ঢাকায় মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের বাসা আর অফিসে এসে ভিড় করার প্রয়োজন পড়বে না। এলাকার মানুষ অনেক সময় দালালকে খরচাপাতি দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে তদবির করতে। অর্থের এই অপচয়ও বন্ধ হবে। এলাকায় অবস্থানের কারণে তাঁরা এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সরাসরি তদারক করার সুযোগ পাবেন। ফলে ওই সব কর্মকাণ্ড গতিশীল ও যথাসময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। প্রতি সপ্তাহে তাঁদের যাওয়া-আসার কারণে এলাকায় প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মরতদের জবাবদিহি অনেকটাই নিশ্চিত হবে। বর্তমানে যেসব কর্মচারী কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে কাজে ফাঁকি দিয়ে থাকেন, এলাকায় সংসদ সদস্যদের উপস্থিতির ফলে সেই প্রবণতা অনেকাংশেই কমে যাবে। এলাকায় দুর্নীতি হ্রাসে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁদের এ উপস্থিতি ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। তাঁরা জনগণকে যেমন বুঝতে পারবেন, জনগণও তেমনি তাঁদের বুঝতে সক্ষম হবে। জনগণ তাঁদের পাশে পাবে, তাঁদের দুঃখ-সুখের অংশীদার হিসেবে মনে করবে। দুয়ের মধ্যে সৃষ্টি হবে পারস্পরিক বোঝাবুঝির এক সেতুবন্ধের। রাজনীতিকদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক পারস্পরিক আস্থা, নির্ভরশীলতা এবং বিশ্বাস ও ভালোবাসার বন্ধনকে দৃঢ় করবে। যে রাজনীতিক যত বেশি গণসম্পৃক্ত হতে পারবেন, তিনি ততই এলাকার উন্নয়নমূলক কাজগুলো করতে সক্ষম হবেন। পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাঁর জয়লাভ অনেকটাই সহজ হবে। জানি না বিষয়টি নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল চিন্তা-ভাবনা করবেন কি না। যদি করে, বোধ হয় খারাপ হবে না। একবার পরীক্ষা করে দেখলে ক্ষতি কী?
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত
[সংকলিত]