ক্রিস্টন ক্যাপস । খােলা বাজার২৪।। শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০১৭: প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র, তাদের দেখাদেখি ব্রিটেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আটটি দেশের বিমানবন্দর থেকে দেশ দুটির এয়ারপোর্টগামী সব ফ্লাইটে ল্যাপটপ বহন নিষিদ্ধ করেছে। মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্ণধাররা যথারীতি নিরাপত্তার ধুয়াই তুলেছেন। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কাই কি আসল কারণ? নাকি ডাল মে কুছ কালা হায়!
সবার জানা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের এই আদেশের পেছনে রয়েছে স্বার্থের সংঘাতের এক দীর্ঘ ইতিহাসও। ডেল্টা, ইউনাইটেড ও আমেরিকান—যুক্তরাষ্ট্রের তিন বড় বিমান কম্পানির সঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি বিমান কম্পানির দ্বন্দ্ব আজকের নয়। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বলে আসছেন ‘আগে আমেরিকার অর্থনীতির স্বার্থ রক্ষা করো’ এই আদেশ হচ্ছে সেই নীতির ধারাবাহিকতা।
হেনরি ফারেল ও আব্রাহাম নিউম্যান দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের লেখায় প্রতিষ্ঠান তিনটির নাম উল্লেখ করেই বলেছেন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী এই পদক্ষেপের নেপথ্যে সম্ভবত ইউনাইটেড, আমেরিকান ও ডেল্টার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রক্ষার ধারণা বেশি কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান কম্পানিগুলো বরাবর কঠোরভাবে বলে এসেছে যে উপসাগরীয় কিছু বিমান, বিশেষ করে এমিরেটস, ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজ ও কাতার এয়ারওয়েজ সরকারি ভর্তুকির সুবাদে অন্যায্য অনেক সুবিধা পেয়ে আসছে। সম্প্রতি এই কম্পানিগুলো শিকাগো ও ওয়াশিংটন ডিসির মতো কিছু মার্কিন নগরীতেও সেবা দিতে শুরু করে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইউনাইটেড, আমেরিকান ও ডেল্টার প্রধান নির্বাহীরা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে একটি যৌথপত্র দেন। চিঠিতে তাঁরা এই বলে অভিযোগ করেন, ‘তিনটি উপসাগরীয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান কম্পানি সরকারের ভর্তুকি সুবিধা নিয়ে যাত্রীদের এত বেশি ছাড় দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানগুলো তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না, যুক্তরাষ্ট্রের চাকরি বাজারও তারা এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ’ এর পরপরই ট্রাম্প নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ঘোষণা দেন, আমেরিকান বিমানগুলোকেও সামনে ‘উল্লেখযোগ্য’ হারে কর রেয়াত দেওয়া হবে; সেই সঙ্গে নিয়মকানুন সহজ করা হবে; এককথায় বিমানশিল্পের উন্নয়নে সরকার যতটুকু সম্ভব করবে।
ল্যাপটপ নিষিদ্ধের ফরমানটি জারির পর এখনো স্পষ্ট হয়নি, সব বিমান এর আওতায় পড়বে, নাকি কোনো কোনোটি। এক হতে পারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই আটটি দেশ থেকে যে বিমানই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা করুক, কোনো যাত্রী ল্যাপটপ বহন করতে পারবে না। এমনও হতে পারে, শুধু উপসাগরীয় বিমান কম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেই আদেশটি প্রযোজ্য হবে। দুবাই থেকে ওয়াশিংটনের ডুলেস বিমানবন্দরগামী সরাসরি একটি ফ্লাইটের ভ্রমণ সময় কম করে হলেও ১৪ ঘণ্টা। যাত্রীরা স্বভাবতই ল্যাপটপ, ট্যাব বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিকস ডিভাইস খুলে সময় কাটাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে থাকেন। তাঁদের অনেকে ল্যাপটপে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজও করে থাকেন, বিশেষ করে বিজনেস ক্লাসের যাত্রীরা। নিষেধাজ্ঞাটি তাদের জন্য ভালো হলো না।
যেকোনো একতরফা নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবেও দেখা দেবে। বহু বছর ধরেই অনেক বিমান কম্পানি নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করে আসছে। গত সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন তথা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এক আদেশে বলে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এয়ারবাস কম্পানিকে দুই হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের ছাড় দিয়েছে, যা অবৈধ। এ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, এ হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিতর্ক। ’
এদিকে ব্রিটেনের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ডান হাতটির ওপর বড় আঘাত আসবে। ব্রিটেনের ফিন্যানশিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বশেষ এই নিষেধাজ্ঞা শুধু অমার্কিনি বিমান কম্পানির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। যেমন—সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস, রয়্যাল জর্দানিয়ান এয়ারলাইনস, এমিরেটস, ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজ, কাতার এয়ারওয়েজ, কুয়েত এয়ারওয়েজ, টার্কিশ এয়ারওয়েজ, ইজিপ্টএয়ার ও রয়্যাল এয়ার মারোক। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশই নিজ নিজ দেশে উল্লেখযোগ্য হারে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পেয়ে থাকে। তবে মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশাবলিতে কোনো বিমান কম্পানির নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারা এ-ও বলেনি, যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানিগুলোও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে কি না।
কিন্তু সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্যারিয়ারগুলো এই আদেশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না; কারণ তারা তালিভাভুক্ত দেশগুলোর কোনো বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করে না। ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া গেল, তাদের এই ব্যাখ্যা ভালো ও মন্দ দুটিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ডেল্টা কম্পানি মিসরের কায়রো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে এয়ার ফ্রান্সের মাধ্যমে। ওদিকে ইস্তাম্বুল থেকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত আমেরিকান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট পরিচালনা করে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। ডেল্টা ও ইউনাইটেড নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা এয়ারপোর্টগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামী ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে লুফথানসা, কেএলএমসহ আরো কিছু কম্পানির সহযোগিতায়।
যোগাযোগ করা হলেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি ট্রাম্প সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আরো খতিয়ে দেখলে নতুন জটিলতাও বেরিয়ে আসবে। যেমন—ব্রেক্সিটের পর কাতার এয়ারওয়েজ ব্রিটিশ এয়ারওয়জের জন্য তাদের মূল কম্পানিতে মালিকানা ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। এখন কাতার এয়ারওয়েজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানেই আঘাতটা আসছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ওপরও।
এজাতীয় বিরোধে ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়। যেমন—এখন আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলোয় নেটফ্লিক্স ভিডিও চলে। প্রতিশোধ হিসেবে উপসাগরীয় বিমান সংস্থাগুলো বলতেই পারে, আমাদের কোনো ফ্লাইটে এখন থেকে নো নেটফ্লক্সি! ট্রাম্প আক্ষরিক অর্থেই নিরাপত্তার খাতিরে ফরমানটি জারি করেছেন, নাকি সত্যিই নেপথ্যে মার্কিন কম্পানিগুলোর হয়ে তিনি ষড়যন্ত্রে নেমেছেন, তা শিগগিরই স্পষ্ট হয়তো হবে। কারণ যা-ই হোক, হয়রানি থেকে বাঁচার কোনো উপায় আপাতত যাত্রীদের জন্য নেই।
লেখক : সিটিল্যাবডটকমের স্টাফ রাইটার, ওয়াশিংটন সিটি পেপারেও লিখে থাকেন।
সূত্র: সিটিল্যাব
[সংকলিত]