ইসহাক খান :- খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ১ এপ্রিল ২০১৭: কিছু কিছু জিনিসের মূল্য দ্রুত বৃদ্ধিতে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি লক্ষ করা যাচ্ছে। এমন কিছু সবজি যা এখন অফ সিজন। খেতে স্বাদ লাগে না। মানুষের তেমন চাহিদাও নেই। তার পরও সেসব জিনিসের দাম বৃদ্ধিতে উদ্বেগ লক্ষ করা গেছে মানুষের মধ্যে। যেমন ফুলকপি। কেন যে এই সময় সবজিটির মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে তার ব্যাখ্যা দোকানিরাও দিতে পারছে না।
গ্রামের চাষিরা মুলা উত্পাদন করে মূল্যের অভাবে তা গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। অথচ সেই মুলা ঢাকায় ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মূল্যের এই হেরফের কেন, সে ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা অতি জরুরি বলে সবার ধারণা।
এদিকে চিনির মূল্য নিয়ে কঠিন বিপাকে পড়েছে ভোক্তারা। চিনির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে উদ্বেগের মাত্রাটা তাই অনেক বেশি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারের ধারাবাহিকতায় দেশের বাজারেও বাড়ছে চিনির দাম। এক বছরের ব্যবধানে ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি কেজি চিনি ৪৮ থেকে ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। চলতি বছরের একই সময়ে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকায়। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে প্রতি কেজিতে চিনির দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। তবে ঢাকার বেশ কয়েকজন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী ও টিসিবির রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা। চিনির আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির ঘটনা পুরনো হলেও সেটিকে পুঁজি করে নিয়মিত দাম বাড়িয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। যার চাপ সইতে হচ্ছে অসহায় ভোক্তাদের।
জানা গেছে, খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৬ টাকায়। এর মধ্যে সিটি গ্রুপের তীর ব্রান্ডের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৬ টাকায়। মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ টাকায়। যদিও গায়ে দাম লেখা রয়েছে ৬৯ টাকা।
এই অনিয়মের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করার কেউ নেই। এসব কি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিতে পড়ে না? নাকি তাদের সময় নেই! সবারই সময় হয়। শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁদেরই সময়ের বড় অভাব। তাঁরা বড় বড় প্রজেক্ট নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।
খবরে জানা গেছে, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বিভিন্ন মিলে উত্পাদিত প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে, গত এক মাস থেকে চিনির দাম একটু বাড়তি। খোলা চিনি ৭০ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনি ৭২ থেকে ৭৫ টাকায় খুচরা বিক্রি করছেন তাঁরা। তাঁদের যুক্তি, তাঁরা বেশি দামে কেনেন এ জন্য বেশি দামে বেচেন।
পাইকারি ব্যবসায়ীদের যুক্তি আরো জোরালো। তাঁরা বলছেন, চিনির আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত-অপরিশোধিত চিনির দাম বেড়ে যাওয়াই বাজারে দাম বাড়ার প্রধান কারণ। তাঁদের মতে, সামনে চিনির দাম আরো বাড়তে পারে। কারণ যে দামে চিনি বিক্রি করছে তাতে করে তারা লাভ করতে পারছে না।
দাম বাড়া প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ‘র সুগারের’ দাম বেড়েছে, পরিশোধিত চিনির দামও বেড়েছে। আমাদের টনপ্রতি শুল্কায়ন ১০ গুণ বেড়েছে। ফলে উত্পাদন খরচ পড়ছে ৬৮ টাকা। বিক্রি করছি ৬৮ টাকা। সামনে এটা আরো বাড়বে। কারণ আমাদেরও তো লাভ করতে হবে। [সূত্র : কালের কণ্ঠ]
উল্লেখ্য, গত বছর পরিশোধিত-অপরিশোধিত দুই ধরনের চিনি আমদানিতেই ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ২০ শতাংশ। এর ফলে টনপ্রতি পরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে চার হাজার ও অপরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে দুই হাজার টাকা শুল্ক প্রদান করা হচ্ছে। নতুন করে শুল্কায়নের ঘোষণা আসার আগেই ব্যবসায়ীরা চিনির মূল্যবৃদ্ধি করেছেন। শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণার পর আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে দাম বেড়ে ৪৮-৫০ টাকার চিনি এখন ৭০-৭৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চিনি ব্যবসায়ী সমিতির একজন ঊর্ধ্বতন নেতা বলেছেন, কনটেইনারের পণ্য ছাড়াতে আমাদের খরচ বেশি হচ্ছে। সে অনুযায়ী দাম যা বেড়েছে তা স্বাভাবিক। কোনো অসুবিধা তো দেখছি না। তবে আমরা পাইকারি বিক্রেতারা খুব একটা ভালো নেই। আমাদের বিক্রি কমে গেছে।
ব্যবসায়ীরা কখনো ভালো থাকেন না। প্রচুর মুনাফা করলেও তারা মুখস্থ বলে দেন, ব্যবসার অবস্থা ভালো না। এই ভালো না কথাটা ব্যবসায়ীদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। তাঁরা আরো মুনাফা চান। আরো। তাতে ভোক্তাদের অসুবিধা তাঁদের কাছে কোনো অসুবিধাই নয়।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী বছরে দেশে প্রায় ১৮ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন চিনি দেশে উত্পাদিত হয়। বাকি চাহিদা পূরণ করতে হয় পুরোপুরি আমদানি করে। বেসরকারিভাবে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপের মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণ করে থাকে। অর্থাৎ পুরো চিনির বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় বেসরকারি খাত থেকে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে টানা ঊর্ধ্বমুখী ছিল চিনির আন্তর্জাতিক বাজার। সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, ২০১৬-১৭ মৌসুমে চিনি উত্পাদন কমবে, এমন আশঙ্কা থেকেই নতুন বছরের প্রথম মাস থেকে দাম বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিনি উত্পাদন ও রপ্তানিকারক দেশ ব্রাজিল, ভারত ও থাইল্যান্ডে উত্পাদন কমার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি ভারতে চিনি উত্পাদন ৯ শতাংশ কমার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেই দেশটিতে কয়েক ডজন চিনি কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে আখের অভাবে।
অতএব আমরা ধরে নিতে পারি, চিনির মিষ্টতা আমাদের কাছে তেতো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তার ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আসছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচ বাড়বে। আর সেই চাপ এসে পড়বে জনগণের ওপর। এই সুযোগে আমাদের একশ্রেণির ব্যবসায়ী দাম বাড়ার একটা সহজ মওকা পেয়ে যাবেন। এমনিতে তাঁরা দাম বাড়ানোর নানা কৌশল খোঁজেন। সে ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি তাঁদের মোক্ষম হাতিয়ার হবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে।
যদিও নানা মহল থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করাকে অযৌক্তিক বলা হচ্ছে। ছোটখাটো রাজনৈতিক দল তারা মিছিল ও মানববন্ধন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করবে বলে মনে হয় না। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারকরা নতুন করে ভেবে দেখবেন—এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।
মনে রাখতে হবে, একটির সঙ্গে আরেকটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটার দাম বাড়লে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কিছুর দাম বাড়বে। ফলে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এমনিতে দেশে নানা ধরনের সংকট বিদ্যমান। তার ওপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দিলে তাদের নিঃশ্বাস ফেলা কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যাপারটা দায়িত্ব নিয়ে বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে দেশবাসী।
লেখক : গল্পকার, টিভি নাট্যকার
[সংকলিত]