Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

14kখােলা বাজার২৪।। সোমবার, ৩ এপ্রিল ২০১৭: প্রতিবছর ২ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। দশমবারের মতো এবারও বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন হতে যাচ্ছে। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২ এপ্রিল দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের স্লোগান Toward Autonomy and Self-Determination.
অটিজম কোনো মানসিক রোগ বা মানসিক প্রতিবন্ধিতা নয়। তবে সমাজে এর ব্যাপকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটি মূলত শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশজনিত একটি সমস্যা, যা তার সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে। এর অপর নাম অটিজম স্পেকট্রাম সিনড্রোম (এএসডি)। বিজ্ঞানীরা স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশজনিত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অটিজমে মস্তিষ্কের গঠনতন্ত্রে বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে না, কিন্তু এর চিন্তাধারা ও কার্যাবলি ভিন্ন ধারায় ও ভিন্ন খাতে পরিচালিত হয়।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ আইনে তাদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা ও প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিতার বেশ কয়েকটি ধরন রয়েছে। অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাকপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা, অন্যান্য প্রতিবন্ধিতাসহ মোট ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে দেশের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, দেশে মোট প্রতিবন্ধী ১৫ লাখ ৯ হাজার ৭১৬ জন। এর মধ্যে ৪৫ হাজার ৪০৪ জন হচ্ছে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।
অটিজম শিশুরা পরিবেশ তথা তার চারপাশের মানুষের সঙ্গে যথাযথভাবে যোগাযোগ বা ভাব বিনিময় করতে পারে না। ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে তাদের খুব কষ্ট হয়। সামাজিক আন্তঃক্রিয়ার ব্যাপারটিও তাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। এতে নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। অথবা সামাজিক হতে গিয়ে তারা অনেক সময় বেসামাল বা অপ্রত্যাশিত আচরণ করে ফেলে। এতে তারা নিজেরাও বিব্রত বোধ করে এবং বিভিন্ন মাত্রায় উদ্বেগ ও আতঙ্কে ভোগে। এই উদ্বেগ থেকে মুক্তির জন্যই হয়তো তারা একই কথা বারবার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে, একই কাজ বা আচরণ বারবার করতে থাকে অথবা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলেছেন, অটিজমে মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অক্ষমতা হলো, এরা পরিস্থিতি অনুমান করতে পারে না। ফলে কোনো একটি বিশেষ ঘটনা কিসের পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে এটা যেমন তাদের বোঝাতে অসুবিধা হয়, এই ঘটনার ফলে পরবর্তী সময় কী ঘটতে পারে তা বুঝতেও তারা যথেষ্ট বিভ্রান্তিতে ভোগে। অনেক সময় কোনো একটি ঘটনার ক্ষুদ্র অংশ বিশেষের প্রতি তারা বিশেষ বা অতিমনোযোগী হয়ে পড়ে অথচ সামগ্রিকভাবে ঘটনাটিকে উপলব্ধি করতে পারে না।
অটিজমে ব্রেইনের সামাজিক বিকাশের এই বিশেষ অক্ষমতাগুলোর কারণে যেকোনো সামাজিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে শিশুর ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি হয়। সামান্য সামাজিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করা তাদের জন্য অতি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপযুক্ত সাহায্য ও সহযোগিতা বা আশ্বাস না পেলে একসময় তা আতঙ্কে পরিণত হতে পারে।
অটিজমের আরেকটি বড় অসুবিধা হলো, এদের স্নায়ুতন্ত্র ভীষণ সংবেদনশীল। পরিবেশের আলো, শব্দ, গন্ধ বা স্পর্শ যা অন্যের কাছে স্বাভাবিক, তা অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তির কাছে অসহ্য মনে হতে পারে। এই স্বাভাবিক উদ্দীপকগুলো তাদের স্নায়ুতন্ত্রে অনেক সময় অস্বাভাবিক উন্মাদনা তৈরি করে। কোনটা ছেড়ে কোনটাকে মোকাবেলা করবে তা বুঝতে না পেরে ওই শিশুরা অহেতুক উদ্বেগ, আশঙ্কা ও হতাশায় ভোগে। অস্থিরতা, চঞ্চলতা এমনকি আক্রমণাত্মক আচরণে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ‘অনুমানের দুর্বোধ্যতা’ থেকেই সামাজিক ভাব-বিনিময়ের সমস্যাগুলো জন্ম নেয়। শিশুটি যখন সুস্থ, সুন্দর ও দেখতে অবিকল স্বাভাবিক, সমস্যা তখনই বেশি হয়। তার মা-বাবা, বন্ধুবান্ধব, স্কুল ও সমাজের অন্যরা তাকে ক্রমাগত ভুল বোঝে। সবাই মনে করে, শিশুটি বুঝি ইচ্ছা করেই দুষ্টুমি করছে। যে এত কিছু বোঝে, সে এই সামান্য ব্যাপারটি বুঝবে না কেন? শিশু স্কুলে শিক্ষকের তিরস্কার, বন্ধুদের টিপ্পনি বা নিপীড়ন, বাড়িতে অভিভাবকদের কটূক্তির ভারে ক্রমাগত ভারাক্রান্ত হতে থাকে। শিশুও বুঝতে পারে না তার সমস্যাটি কোথায়। এর ফলে হয়তো সে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও হতাশায় ভোগে। এর থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে অনেক সময় সে পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণে লিপ্ত হয় অথবা কোনো নির্দিষ্ট ক্রম বা ধারা অনুসারে উদ্দেশ্যবিহীন বাতিকধর্মী আচরণে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। এমন পরিস্থিতিতে দেরি না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কাউন্সেলর বা সাইকোথেরাপিস্ট, যাঁরা শিশুদের বিকাশজনিত সমস্যা নিয়ে কাজ করেন তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
প্রতিবন্ধিতা জীববৈচিত্র্যের একটি অংশ হলেও সব প্রতিবন্ধিতা দৃশ্যমান নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ীও নয়। বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থায়ী প্রতিবন্ধিতা দেখা যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবন্ধীদের বেশির ভাগই দারিদ্র্যের শিকার তথা তারা নিম্ন আয়ভুক্ত। এই জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসন ও জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি। পাশাপাশি গ্রহণ করতে হবে উপযোগী চিকিৎসা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানে লক্ষ্যভিত্তিক পরিকল্পিত কার্যক্রম। আশার কথা যে বিগত সময়ে এ ব্যাপারে বাংলাদেশে ব্যাপক কর্মতত্পরতা দেখা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সবাই আরো সচেতন হলে তা পরিবার তথা দেশ ও জাতির জন্য হবে মঙ্গলজনক।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, শিশু বিকাশ কেন্দ্র
এ্যাপোলো হসপিটালস, ঢাকা
গ্রন্থনা : আতাউর রহমান কাবুল