খােলা বাজার২৪।। শুক্রবার ০৭ এপ্রিল ২০১৭: “গ্যাসের দাম বৃদ্ধি; মানুষের যাপিত জীবন কতোটুকু সমৃদ্ধি ?” শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে-এখানে গ্যাসের দামের বৃদ্ধির সাথে মানুষের যাপিত জীবন কেমন যাচ্ছে তার কথা ? মানুষের আয় কেমন এবং সে আয়ের ভিত্তিতে মানুষ ব্যয় করে কেমন আছে এবং সেই থাকার ভিত্তিতে এই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি তাদের জীবনে কেমন প্রভাব ফেলছে-সেটাই মুখ্য বিষয়। গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে অবশ্যই প্রভাব ফেলছে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে প্রভাব পড়লে অবশ্যই প্রভার রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর পড়ে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রভাবসমূহ নির্মূল করার বা যৌক্তিক কারণ বের করে তা সমাধান করার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনা যারা করে অর্থাৎ সরকারের উপরই বর্তায়। কেননা জনগণের কল্যাণের জন্যই রাষ্ট্রব্যবস্থা আর রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করেন সরকার। তাই জনগণের কল্যাণে সরকারকেই প্রথম দৃষ্টি দিতে হবে।
যাই-হোক, ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে এর্নাজি কমিশনের শুনানিতে অধিকাংশ স্টক হোল্ডার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে গেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার প্রায় দেড় বছরের মাথায় ১লা মার্চ থেকে আবারও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করেছে। ক্যাপটিভ পাওয়ার, বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, বাণিজ্যিক, সিএনজি, চা-বাগান ও গৃহস্থালির কাজ-এই আটটি ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। গৃহস্থালির কাজে আবার মিটার ভিত্তিক, সিঙ্গেল চুলা ও ডাবল চুলার জন্য আলাদা-আলাদা (নির্ধারণ) করা হয়েছে।
খাতসমূহ ১লা মার্চ এর আগে দাম ১লা মার্চ থেকে দাম
ক্যাপটিভ পাওয়ার ০৮ টাকা ৩৬ পয়সা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ০৮ টাকা ৯৮ পয়সা
বিদ্যুৎ ০২ টাকা ৮২ পয়সা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ০২ টাকা ৯৯ পয়সা
সার ০২ টাকা ৫৮ পয়সা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ০২ টাকা ৬৪ পয়সা
শিল্প ০৬ টাকা ৭৪ পয়সা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ০৭ টাকা ২৪ পয়সা
বাণিজ্যিক ১১ টাকা ৩৬ পয়সা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ১৪ টাকা ২০ পয়সা
সিএনজি ৩৫ টাকা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ৩৮ টাকা
চা-বাগান ০৬ টাকা ৪৫ পয়সা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ০৬ টাকা ৯৩ পয়সা
গৃহস্থালির কাজ
ক. মিটার ভিত্তিক ০৭ টাকা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ০৯ টাকা ১০ পয়সা
খ. সিঙ্গেল চুলা ৬০০ টাকা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ৭৫০ টাকা
গ. ডাবল চুলা ৬৫০ টাকা ১লা মার্চ থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা
উপরের ছকে দেখা যায় ০১ লা মার্চ থেকে ক্যাপটিভ পাওয়ারে প্রতি ঘনমিটারে ০৮ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বেড়ে ০৮ টাক ৯৮ পয়সা হয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ইউনিটে ০২ টাকা ৮২ পয়সা থেকে বেড়ে ০২ টাকা ৯৯ পয়সা হয়েছে। প্রতি ঘনমিটারে সিএনজি’র দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৩৮ টাকা হয়েছে। শিল্প খাতে প্রতি ঘনমিটারে ০৬ টাকা ৭৪ পয়সা থেকে বেড়ে ০৭ টাকা ২৪ পয়সা হয়েছে। বাণিজ্যিক খাতে ১১ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে বেড়ে ১৪ টাকা ২০ পয়সা হয়েছে। আর গৃহস্থালির কাজে মিটার ভিত্তিক প্রতি ঘনমিটারে ০৭ টাকা থেকে বেড়ে ০৯ টাকা ১০ পয়সা হয়েছে। সিঙ্গেল চুলার ক্ষেত্রে ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা এবং ডাবল চুলা ৬৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে গৃহস্থালির কাজে দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে-সিঙ্গেল চুলা প্রতি ২৫% এবং ডাবল চুলা প্রতি ২৩% এর একটু বেশি। গ্যাসের এ দাম বৃদ্ধির ফলে নাগরিক জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় যে, সরকারী চাকুরিজীবীদের বেতন প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু দেশে বর্তমানে প্রায় ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে কতোজন সরকারী চাকুরি করে। শতকরা হিসেবে সেটা অবশ্যই কম। বেশিরভাগ করে বে-সরকারী চাকুরি। বে-সরকারী চাকুরিতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় দিন দিন বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বেকারত্বের এই বৃদ্ধি সমস্যা নিয়েই বে-সরকারী চাকুরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি সক্রান্ত নীতিমালা চুড়ান্ত না করেই সরকারী চাকুরির বেতন প্রায় দ্বিগুন করা কেমন হয় ? গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারী চাকুরিজীবীরা চলতে পারলেও দেশের অধিকাংশ বে-সরকারী চাকুরিজীবীদের ব্যয় নির্বাহ করতে নাভিঃশ্বাস উঠছে, নাভিঃশ্বাস উঠছে দিনমজুর, কৃষক, সাধারণ মানুষের। কেননা, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে বাজারে নিত্য দ্রব্য-জিনিসের দামও বাড়ছে। পরিবহণ খাতে ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনিতেই যখন সরকারী চাকুরিজীবীদের বেতন প্রায় দ্বিগুন করা হয় তখনই বাসা ভাড়া, কাঁচা-বাজার, চাল-তেল-ডাল, মাছ-মাংসসহ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে তখনই সাধারণ মানুষ, বে-সরকারী চাকুরিজীবীরা তাদের প্রাপ্ত আয়ে বা বেতনে প্রত্যহিক জীবন-যাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছিল। তার উপরে এবার আবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে আবারও বাসাভাড়া বাড়ীওয়ালারা বৃদ্ধি করছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও দাম বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষসহ বেসরকারী চাকুরিজীবীদের চলাও বেশ কষ্টকর হচ্ছে। এছাড়াও তো খেটে খাওয়া দিনমজুর, উদ্বাস্তু, বেকার লোকজন তো আছেই। সৃষ্ট রাজনৈতিক ভয়-ভীতিমূলক পরিবেশের জন্য এসব বিষয়ে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কথা বলতে সাহস পায় না। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষি উপকরনের দামে প্রভাব ফেলায় কৃষিখাতও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। শিল্পখাতের অবস্থাও খারাপ। শিল্পখাতে নতুন কোন বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। দেশে নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন তো দুরের কথা অনেক শিল্প-কারখানা উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে-সেখানে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি যেন ‘মরার উপর খারার ঘাঁ’। এসব ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যায় বিনিয়োগের অভাবে শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমে গেলে রাপ্তানী আয় কমবে, রাজস্ব আদায় কম হবে-যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির উপর প্রভার ফেলবে। ব্যাক্তি পর্যায়ে সঞ্চয় না থাকলে বা ঘাটতি থাকলে বা সমস্যায় থাকলে তা পরিবারে প্রভাব পড়বে। পরিবার থেকে তা সমাজে প্রভাব পড়বে। আর সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব তো রাষ্ট্রের উপর আসবেই। কেননা, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ নিয়েই তো রাষ্ট্র। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রতি স্তরে দাম বৃদ্ধির প্রভাব ফেলায় স্বাভাবিকভাবে মানুষ কষ্টে আছে। আমার দেখা একজনের সমস্যা এরকমই বাস্তব। তার ছদ্মনাম নাজমা। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় নাজমার স্বামী মারা যায়। থাকে তাদের ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তান। নাজমা ছেলের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে করে না। অল্প বয়সেই বিধবার শাড়ী পড়ে আর সে শাড়ীর আঁচলে ¯েœহ-মায়ার বন্ধনে ছেলেকে মানুষ করার মানসে (লেখাপড়া খুব বেশী না হলেও একেবারে আবার কমও না।) একটা এনজিও-তে চাকরি নেয়। অনেকটাই পুরুষনির্ভর বা শাসিত যাই বলি না কেন- এই সমাজে; পারিবারিক বিয়ের চাপ সত্ত্বেও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে না করে-নানা প্রতিকুল পরিবেশে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বেতনের টাকায় ছেলেকে লেখাপড়া শিখাচ্ছে। ছেলেও মেধাবী বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন প্লাস নিয়ে শহরে নামকরা কলেজে পড়ছে। কিন্তু নাজমা এবার আর সংসারের হিসেবে কুলে উঠতে পারছে না। তার সীমিত বেতন দিয়ে ছেলের লেখা-পড়ার খরচ দিতে হিমশিম খাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে রাতে কিছু হাতের কাজও করছে প্রতিদিন দু’টো উপরি টাকা কামানোর জন্য-যাতে একমাত্র বুকের মানিক এর লেখাপড়ার কোন ক্ষতি টাকার অভাবে না হয়। কিন্তু এবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধিতে সে একেবারে হিমশিম খাচ্ছে। তাই নিজে তিন বেলার জায়গায় দু’বেলা খেয়ে ছেলের অর্থের যোগান দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতোদিন। কি করবে নাজমা ? যে ছেলের ভবিষ্যতের জন্য নাজমা নিজের জীবনের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়েছে-সে ছেলেকে তো লেখা-পড়া শিখে মানুষ বানাতেই হবে। তাই নাজমা প্রত্যহিক জীবনের ব্যয়ভার কোন মতে মিলাতে একমাত্র কলিজার টুকরাকে মানুষ করার জন্য নিজে দু’বেলা; অনেকসময় একবেলাও খেয়ে থাকছে…………।
প্রত্যহিক ব্যয়ভার বৃদ্ধির ফলে এ চিত্র শুধু নাজমা’র একা নয়। এ চিত্র অনেক আছে। গুমরে গুমরে এ চিত্র কাদঁছে। এ চিত্র এ সমাজেরই যাপিত জীবনের একটা অংশ।
তাই গ্যাসের দাম আমাদের দেশীয় আবহে যৌক্তিকভাবে ঠিক করা সার্বিকভাবেই আমাদের জন্য শ্রেয়। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আগে এর অবকাঠমোগত দিক সু-দৃষ্টি দিলে গ্যাস অপচয় অনেক রোধ করা যাবে। শিল্প- কলকারখানায় অনেক ত্রুটিপূর্ণ ব্যস্থার কারণে গ্যাসের প্রচুর অপচয় হয়। এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়-আর্ন্তজাতিক মান অনুসারে প্রতি টন সার উৎপাদনে ২৪-২৫ হাজার ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হলেও আমাদের সরকারী সার কারখানাগুলোতে ব্যয় হয় ৪০-৫০ হাজার ঘনফুট। বোঝাই যাচ্ছে অপচয় কতো ? এছাড়া চুরি তো আছেই। জাতীয় দৈনিক ‘যায়যায়দিন ১৮-০২-২০১৬ এর একটি রিপোর্ট অনুসারে কেবলমাত্র নরসিংদী-নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরে ৬০০ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস লাইনের মাধ্যমে দৈনিক ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়। জাইকার তথ্য অনুযায়ী কেবলমাত্র ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎখাতে ৫২০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হয় যা দিয়ে ১৩০০ মেগাওয়াট একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো সম্ভব। এছাড়াও ত্রুটিপূর্ণ মিটার, অবৈধ সংযোগ, গ্যাসের আগুনে বাসা-বাড়ীতে কাপড় শুকানো, রান্না হয়ে গেলেও অপ্রয়োজনে চুলা জ্বালিয়ে রাখা ইত্যাদি কারণে প্রতি বছর প্রচুর পরিমান আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
সুতারাং দেখা যাচ্ছে গ্যাসের অপচয়, চুরি, অব্যবস্থাপনা রোধ করলে অনেক গ্যাস বেঁচে যাবে। তখন যোক্তিকতার ভিত্তিত্বে যা না হলেই নয় তা থেকেও ভূর্তুকি দিয়ে গ্যাসের দাম বজায় রাখলে সার্বিকভাবে ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ আর্থিক উপকৃত হয় বা এগিয়ে যায়। আর সমাজব্যবস্থা এগিয়ে গেলেই সার্বিকভাবে দেশও এগিয়ে যাবে।
লেখকঃ মোঃ মিজানুর রহমান-সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট।