রেজানুর রহমান । খােলা বাজার২৪।। রবিবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৭: নাসিরুদ্দিন শাহ্ বলে কথা! উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা। ভারতের অধিবাসী। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাঁকে কাছ থেকে একনজর দেখতে পাওয়াও তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। বোধকরি সে কারণেই বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের নবরাত্রি হলের সামনে এত ভিড়। শুধু ভিড় বললে ভুল হবে; ভিড়ের চেয়েও বেশি কিছু। শুধু নাসিরুদ্দিন শাহেকই নয়, তাঁর স্ত্রী জনপ্রিয় অভিনেত্রী রত্না পাঠক শাহ্ ও কন্যা হেবা শাহেকও দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার মঞ্চে তাঁরা একসঙ্গে অভিনয় করবেন। নাটকের নাম ‘ইসমাত আপা কি নাম’। নাসিরুদ্দিন শাহ্ ও রত্না পাঠক শাহেক এ দেশের মানুষ চিনেছেন চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দায়। কিন্তু মঞ্চে অভিনয় করতে দেখেননি অনেকে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এটাই সুযোগ। এক. প্রিয় অভিনেতাকে সরাসরি দেখা। দুই. সরাসরি তাঁর অভিনয় অবলোকন করা।
নবরাত্রি হলের গেট খোলার কথা সন্ধ্যা ৬টায়। বিকেল ৪টার মধ্যেই হলের সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে গেল। বিকেল ৫টার দিকে দর্শকের লাইন এতই বড় হলো যে তা দেখার মতো। একজন নাট্যকর্মী হিসেবে আমার বুকের ভেতর আনন্দ আর সুখের অনুভূতি খেলে যাচ্ছে। মঞ্চনাটক দেখার জন্য এত মানুষের ভিড়! আহ! কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! যাকে পাই তাকেই ফোন করি। ভাই খবর আছে। মঞ্চনাটক দেখার জন্য দর্শকের বিরাট লাইন পড়েছে। অসাধারণ, অনন্য এক ঘটনা। না দেখলে হয়তো আমিও বিশ্বাস করতাম না। হ্যাঁ, ঘটনা সত্যি। নাটক শুরু হবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। বিকেল ৪টা থেকে দর্শক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে… হঠাৎ এক তরুণের ডাকে চমক ভাঙল—ভাই, কেমন আছেন?
তরুণ একজন নাট্যকর্মী। তাদের একটি নাটকের গ্রুপ আছে। চরম প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তাদের দলের ছেলে-মেয়েরা শিল্পকলার মঞ্চে নিয়মিত নাটক করে। অধিকাংশ শোতে প্রডাকশন খরচের টাকা তো ওঠেই না; বরং আট-দশ হাজার টাকা ‘লস’ গুনতে হয়। দলের কর্মকর্তাদের কেউ চাকরি করে, কেউ ব্যবসা, কেউ টিউশনি করে। তারাই সম্মিলিতভাবে প্রডাকশন খরচের ক্ষতিটা পুষিয়ে নেয়। একবার শিল্পকলার মঞ্চে তাদের দলের নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। অনবদ্য প্রযোজনা। কিন্তু হলে দর্শক নেই। দলের একজন কর্মকর্তা বিরস মুখে বলল, ভাই, আজ দলের লস হবে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। তবে এ নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। আমরা নাটক চালিয়ে যাব।
তরুণ আমাকে একটা কঠিন প্রশ্ন করে বসল, ভাই, আমাদের শিল্পকলার মঞ্চে ছোট দলের কথা না হয় বাদই দিলাম, কোনো বড় দলের নাটকেও কি দর্শকের এত লম্বা লাইন দেখেছেন? আজ এই যে এত মানুষ নাসিরুদ্দিন শাহ্র নাটক দেখতে এসেছে, এদের ২০-২৫ শতাংশও যদি আমাদের শিল্পকলার মঞ্চে নিয়মিত হতো, তাহলে আমাদের মঞ্চনাটকের দুর্দিন থাকত না; আমরা টিকে যেতাম। তরুণকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, অয় মিয়া, তুমি এসব কি বলতেছ? মানুষটা কে? তাঁকে চেনো? মানুষটা নাসিরুদ্দিন শাহ্! চলচ্চিত্র জগতের একজন কিংবদন্তি। তাঁকে দেখার জন্য ভক্তরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে—এটাই তো স্বাভাবিক। তরুণ আবার আমাকে তার কথা বোঝাতে চাইল, ভাই, আপনি ভুল বুঝছেন। আমি নাসির শাহেক নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। আমিও তাঁকে দেখার জন্য এসেছি। আমি প্রশ্ন তুলেছি আমাদের নাটকের দর্শকের ব্যাপারে। এই যে আজকে যারা এখানে এসেছে, তাদের ৯০ শতাংশ মানুষ ঢাকার মঞ্চে নাটক দেখে না অথবা দেখার আগ্রহও প্রকাশ করে না। অথচ তারা যদি…
আমি তরুণের প্রতি অনেকটাই বিরক্ত। বললাম, ভাইরে আজ এ প্রসঙ্গ থাক। অন্য দিন না হয় এ ব্যাপারে কথা বলব। দেখলাম তরুণ খুশি হয়নি। বিরস বদনে আমাকে সালাম দিয়ে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর আমার ভেতরে হঠাৎ করে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করল। ছেলেটি আসলে কী বলতে চেয়েছিল? এই যে একটি মঞ্চনাটক দেখার জন্য এত মানুষ একসঙ্গে জড়ো হয়েছে, তারা যদি শিল্পকলার মঞ্চে…
নবরাত্রি হলের সামনে হেঁটে হেঁটে অসংখ্য মানুষের মুখ দেখলাম। স্মৃতির পাতা খুললাম। এদের কাউকে শিল্পকলার মঞ্চে দেখেছি কি? হ্যাঁ, কারো কারো মুখ দেখতে পারছি। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই অপরিচিত। অনেকে বসে, দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষায়ই কথা হচ্ছে বেশি। বলা বাহুল্য, সবাই আমাদের দেশের অগ্রসরমাণ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। আহা রে, এই প্রিয় স্বজনরা যদি নিয়মিত আমাদের মঞ্চ, আমাদের চলচ্চিত্র, আমাদের সংগীত নিয়ে আন্তরিক ভাবনায় যুক্ত হতো, তাহলে বোধকরি আমাদের অনেক অস্থিরতা দূর হয়ে যেত।
কথা হলো কয়েকজন দর্শকের সঙ্গে। আমাদের মঞ্চনাটক দেখেন? প্রশ্ন তুলতেই কয়েকজন বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, আমাদের মঞ্চে কি আসলেই নাটক হয়? আপনি সর্বশেষ কোন নাটকটি দেখেছেন, যাকে নাটক বলে মনে হয়নি? আমার পাল্টা প্রশ্নের কেউই সঠিক জবাব দিতে পারেনি। তার মানে আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা ব্যাপারে ‘মাইন্ডসেট’ হয়ে আছে, আমরা কিছুই পারি না। আমাদের নাটক, নাটক হয় না। আমাদের চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্র হয় না। আমাদের গান আগের মতো গান না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা বলার জন্য বলি। এই লেখাটির প্রয়োজনে পরিচিত-অপরিচিত প্রায় ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে ৩৯ জনই জীবনে মঞ্চনাটক দেখেনি। কেন দেখেনি? প্রশ্নের জবাবে বলেছে, সময় পাই না। তা ছাড়া শুনেছি আমাদের মঞ্চনাটক নাকি আগের অবস্থায় নেই। আগে কী ছিল, এখন কী নেই? এই প্রশ্নের সঠিক জবাব কেউই দিতে পারেনি। বরং কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে বলেছে, আপনি হঠাৎ মঞ্চনাটক নিয়া মাথা ঘামাচ্ছেন কেন রে ভাই!
৫০ জনের মধ্যে সবাই সিনেমা দেখে। কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমার প্রতি কারোরই আগ্রহ নেই। গত এক বছরে ৫০ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন বাংলাদেশের সিনেমা দেখেছে। বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে তাদের বিস্তর অভিযোগ। আমার এই লেখাটি কাউকেই দোষারোপ করার জন্য নয়। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতি বোঝার জন্য সবাইকে অনুরোধ করব। আমাদের নাটক, সিনেমা কিছুুই ভালো না। এ ধরনের একটি ‘মাইন্ডসেট’ তৈরি করার পর আমরা অনেকে সেখান থেকে সরিও না, নড়িও না। ওটা খারাপ। কিন্তু ওটা আদৌ খারাপ কি না তা আমরা অনেকেই ভেবে দেখি না। অথবা ভেবে দেখার প্রয়োজনও মনে করি না। মঞ্চনাটকের প্রসঙ্গ তুললে অনেকে যানজট, পথের দূরত্বের কথা বলে। অথচ সেদিন ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ছুটে এসেছিল নবরাত্রি হলে নাসিরুদ্দিন শাহ্র মঞ্চনাটক দেখতে। এখানেই আন্তরিকতার প্রশ্ন।
আচ্ছা, আমাদের কি একবারও মনে হয় না, আমাদেরও একজন নাসিরুদ্দিন শাহ্ দরকার। যাকে দেখার জন্য বিদেশেও মানুষ এমন হুমড়ি খেয়ে পড়বে? সে জন্য বোধকরি আন্তরিক ভাবনাটাই জরুরি। আমাদের কিছুই ভালো না। নাটক ভালো না, সিনেমা ভালো না, গান ভালো না। কেন ভালো নয়? এই প্রশ্নটা কি একবারও করেছি? আমরা কি আন্তরিকভাবে তালি দিই নিজেদের জন্য? ভেবে দেখুন তো একবার শিল্পকলার মঞ্চে তিলধারণের ঠাঁই নেই। একটি ছোট দলের নাটক হচ্ছে। দর্শকের মুহুর্মুহু তালি পড়ছে। আমি নিশ্চিত বলে দিতে পারি দলটি একদিন ঘুরে দাঁড়াবেই। ওই দলেই হয়তো একদিন জন্ম নেবে আরেকজন নাসিরুদ্দিন শাহ্! তিনি বিদেশে হাজার হাজার বিদেশি দর্শকের সামনে বললেন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের নাম। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি… তুমুল করতালি হচ্ছে…।
প্রিয় পাঠক, শুনতে পাচ্ছেন কি সেই তালির শব্দ! আসুন না সবাই মিলে নিজেদের জন্য একটা তালি দিই!
লেখক: সাংবাদিক ও নাট্যকার